মডেলিং দিয়ে কর্মজীবন শুরু তানিয়ার

নাহিন আশরাফ

তানিয়া আহমেদ বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি মডেলিং ও উপস্থাপনাও করেছেন একাধারে। অসাধারণ অভিনয় ও সুন্দর বাচনভঙ্গির জন্য ভক্তদের প্রশংসা কুড়িয়েছে তিনি। মডেলিং দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু হলেও পরে তিনি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেন। ‘সেকু সিকান্দার’ নাটকে মৈরন ও ‘রঙের মানুষ’ নাটকে মাঞ্জেলা চরিত্র দুটি তাকে পরিচিতি দেয়। পরবর্তীতে তিনি টেলিভিশন নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি সংগীত ভিডিও পরিচালনায় মনোনিবেশ করেন। ২০০৪ সালে হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘শ্যামল ছায়া’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি প্রশংসিত হন এবং শ্রেষ্ঠ পার্শ্বঅভিনেত্রী বিভাগে বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া তিনি হাস্যরসাত্মক ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ও ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ২০১৬ সালে ‘কৃষ্ণপক্ষ’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রে অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৭ সালে তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘ভালোবাসা এমনই হয়’ মুক্তি পায়। তানিয়ার কর্মজীবন শুরু হয় মডেলিং দিয়ে। শুরুতে তিনি মডেলিং করতে চাননি। কিন্তু তার এক বন্ধু তার পুরোনো ছবি দেখে তাকে মডেলিং শুরু করতে বলেন এবং তার ছবি আফজাল হোসেনকে দেখান। আফজাল তাকে অডিশনের জন্য ডাকেন এবং তিনি অডিশনে নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে তিনি প্রথম ডায়মন্ড হেয়ার অয়েলের বিজ্ঞাপন চিত্রে কাজ করেন।

১৯৯২ সালে ‘সম্পর্ক’ নাটক দিয়ে তার টেলিভিশন পর্দায় অভিষেক হয়। নাটকটি পরিচালনা করেন ফারিয়া হোসেন। ১৯৯৭ সালে নন্দিত নাট্যনির্দেশক সাইদুল আনাম টুটুল পরিচালিত ‘সেকু সিকান্দার’ নাটকে মৈরন চরিত্রে অভিনয় করে তিনি সর্বপ্রথম জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তানিয়া ১৯৯৯ সালে গানের ভিডিও পরিচালনা শুরু করেন। এই কাজে তাকে সাহায্য করেন তার ছোট ভাই রানা। এ সময়ে তিনি তিনটি গানের ভিডিওর অ্যালবাম পরিচালনা করেন। অ্যালবামগুলো হলো ‘মুহূর্ত’, ‘ময়নিস’ ও ‘আর কত কাঁদাবে’। তিনি জুয়েল, নিলয়, রাশেদ ও এস আই টুটুলের গানের ভিডিও পরিচালনা করেন, যা ২০০৪ সালের ঈদে চ্যানেল আই-তে প্রচারিত হয়। ২০০৪ সালে আসিফ আকবরের গাওয়া ‘উড়ো মেঘ’ গানের ভিডিও নির্দেশনা দেন। এই ভিডিওতে চলচ্চিত্র অভিনেতা রিয়াজ সহ বেশ কয়েকজন নবীন শিল্পী কাজ করেন।

২০০৪ সালে হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘শ্যামল ছায়া’ চলচ্চিত্র দিয়ে তার বড় পর্দায় অভিষেক হয়। এতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন নৌকায় করে পলায়নরত এক নারী ডাক্তার রাত্রির চরিত্রে তার অভিনয় বাংলাদেশের পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্বেও সামাদৃত হয়। এই কাজের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পার্শ্বঅভিনেত্রী বিভাগে বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন। ২০০৪ ও ২০০৫ সালে তিনি ‘৬৯’, ‘বেলাভূমি’, ‘শ্রীকান্ত’, ‘আমাদের আনন্দবাড়ি’, ‘ঘুণপোকা’, ও ‘সুখনগর অ্যাপার্টমেন্ট’ নাটকে অভিনয় করেন। ২০০৫ সালে তিনি সাইফুল ইসলাম মান্নু পরিচালিত ‘সাপলুডু’ টেলিভিশন ধারাবাহিকে খল চরিত্রে অভিনয় করেন। পরবর্তীতে তিনি মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ চলচ্চিত্র, ও স্বল্পদৈর্র্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘বিস্মরণের নদী’-তে কাজ করেন। ২০১১ সালে তিনি ‘সাপলুডু’তে অভিনয়ের ছয় বছর পর প্রত্যাবর্তন করে টেলিভিশন ধারাবাহিকে পুনরায় খল চরিত্রে অভিনয় করেন। সানোয়ার পরিচালিত এই নাটকে তিনি একজন ধনী ব্যক্তিকে বিয়ে করেন, যার পূর্বের বিয়ের দুই সন্তান রয়েছে। বিয়ের পর তানিয়ার চরিত্রের খল সত্তা প্রকাশিত হয়।

একই বছর তিনি ভিট চ্যানেল আই টপ মডেল অনুষ্ঠানে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১-১২ সালে তাকে সকাল আহমেদ পরিচালিত ‘টার্মিনাল’ টেলিভিশন ধারাবাহিকে দেখা যায়। ধারাবাহিকটি এনটিভিতে প্রচারিত হয়। এতে তিনি একটি নারী হোস্টেলের পরিচালক চরিত্রে অভিনয় করেন। ২০১২ সালে তিনি রিপন নবী পরচালিত টেলিভিশন ধারাবাহিক ‘আপন পর’, এটিএন বাংলায় প্রচারিত হিমেল আশরাফের ‘মায়াজাল’ ও মাসুদ সেজানের ‘পুতুল খেলা’; এনটিভিতে প্রচারিত অরণ্য আনোয়ারের ‘রূপকথা’ এবং চ্যানেল আই-তে প্রচারিত আজিজুল হাকিমের ‘সকাল সন্ধ্যা রাত’ টেলিভিশন ধারাবাহিকে অভিনয় করেন। তাকে মায়াজাল নাটকে খল চরিত্রে এবং রূপকথা নাটকে প্রযোজক চরিত্রে দেখা যায়। ২০১২ সালে তিনি ৩৫ পর্বের ‘দ্য এ টিম’ টেলিভিশন ধারাবাহিক পরিচালনা করেন। ধারাবাহিকটি ইংল্যান্ডে চিত্রায়িত হয়। তার নিজের ও সহশিল্পীদের সাথে ঘটে যাওয়া একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এই ধারাবাহিকে অভিনয় করেন মোশাররফ করিম, বিজরী বরকতুল্লাহ, এস আই টুটুল ও তিনি নিজে।

২০১৪ সালে তিনি তার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করেন। শুরুতে চলচ্চিত্রটির নাম রাখা হয় ‘গুড মর্নিং লন্ডন’। পরে তা ‘ভালোবাসা এমনই হয়’ নামে পরিবর্তন করা হয়। এটি বাবা ও মেয়ের দ্বন্দ্বের গল্প। এতে শ্রেষ্ঠাংশে অভিনয় করেন বিদ্যা সিনহা মিম, ইরফান সাজ্জাদ, তারিক আনাম খান, মীর সাব্বির। চলচ্চিত্রটি ২০১৭ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ভালোবাসা দিবস উপলক্ষ্যে মুক্তি পায়। ২০১৫ সালে তিনি মাছরাঙ্গা টেলিভিশনে প্রচারিত রায়হান খানের ‘সুপারস্টার’ ও এনটিভিতে প্রচারিত হিমেল আশরাফের ‘একদিন ছুটি হবে’ টেলিভিশন ধারাবাহিকে কাজ করেন। ঈদুল আযহায় বাংলাভিশন চ্যানেলে প্রচারিত ‘সিকান্দার বক্স এখন নিজ গ্রামে’ মিনি ধারাবাহিকে প্রধান চরিত্রের বড় বোনের ভূমিকায় অভিনয় করেন। তানিয়া ২০১৬ সালে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে মেহের আফরোজ শাওন নির্মিত ‘কৃষ্ণপক্ষ’ চলচ্চিত্রে জেবা চরিত্রে অভিনয় করেন। এই কাজের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্র অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ২০১৭ সালে এস আই টুটুলের গীত, সুর ও সংগীতে ‘বন্ধু’ ও ‘পুড়ে যাবি’ গান দুটির ভিডিও পরিচালনা করেন। এপ্রিল মাসে কক্সবাজার ও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গান দুটির চিত্রায়ন হয়।

তানিয়া ১৯৯৯ সালের ১৯শে জুলাই সংগীতশিল্পী এস আই টুটুলকে বিয়ে করেন। তাদের দুই সন্তান শ্রেয়াশ আহমেদ ও আরশ আহমেদ। ২০২১ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। তানিয়ার পিতা জনাব নাসিম আহমেদ বিশ্বাস একজন অধ্যক্ষ ছিলেন। তানিয়া আহমেদের পৈতৃক নিবাস পটুয়াখালী জেলার কলাপড়া থানার লালুয়া ইউনিয়নের চান্দুপাড়া গ্রামের বিশ্বাস বাড়িতে। তার ছোট ভাই অমিতাভ আহমেদ রানাও একজন নাট্য পরিচালক।

অভিনয়ের পাশাপাশি নাচতে ভীষণ ভালোবাসেন তানিয়া আহমেদ। অসাধারণ ফ্যাশন সেন্সের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন বারবার। তার বেশিরভাগ শাড়ি ও পোশাক তিনি নিজেই ডিজাইন করে থাকেন। ছোটবেলা থেকে বেশ দুষ্টুমি করে বড় হয়েছেন তানিয়া আহমেদ। ছোটবেলায় বন্ধুদের সাথে মারামারি ও গাছে ওঠা ছিল তা নিত্যদিনের কাজ। ভীষণ খেলাধুলা করতে ভালবাসতেন তিনি। খেলাধুলা ও নাচের জন্যই মূলত তিনি মনে করেন তার ফিটনেস সব সময় ঠিক থেকেছে। এলার্জি থাকার কারণে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তানিয়া আহমেদ এক গ্লাস চিরতার রস পান করেন। খাবারের ক্ষেত্রে ভাজাপোড়া ও জাংক ফুড থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেন তিনি। সকালবেলা একটু দেরিতে নাস্তা করেন, দিনের বেলা সবজি ও রাতের খাবার তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলার চেষ্টা করেন। দিনে দুবারের বেশি ভারী আহার করেন না তিনি।

তানিয়া আহমেদ মনে করেন একজন মানুষের আসল রূপের রহস্য তার মনের ভেতরে। একজন মানুষ দেখতে যতই সুন্দর হোক না কেন তার মনটা যদি সুন্দর না হয় তাহলে তার প্রভাব তার রূপের উপর পড়বেই। তাই তিনি সবসময় চেষ্টা করেন নেগেটিভ মানুষ ও নেগেটিভ ব্যাপার থেকে নিজেকে দূরে রাখার। জীবন যত খারাপ সময় পার করুক না কেন তিনি সবসময় পজিটিভ থাকার চেষ্টা করেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে জীবনে যা হয় তা ভালোর জন্যই হয়। স্পষ্টবাদী মানুষদের তানিয়া আহমেদ বেশ পছন্দ করেন, যারা সামনে এক পেছনে আর পেছনে আরেক, তাদের থেকে সবসময় দূরে থাকেন তিনি। সৎ মানুষের সঙ্গে থাকতে তিনি ভালোবাসেন ও নিজের জীবনের সব জায়গায় সবসময় সৎ থাকার চেষ্টা করেন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সেলিব্রেটি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × one =