স্বপ্নবাজ এক নায়িকার প্রাপ্তি

ঋষিকা

রিকশা থেকে মাইকিং হচ্ছে, ‘আ…সিতেছে, আ…সিতেছে’। শুনেই এক দৌড়ে বেরিয়ে এলো এক কিশোরী। তার চোখে হাজার স্বপ্ন। একদিন সে ঠিক নায়িকা হবেই। সেই রিকশার পেছনে সে দিলো দৌড়। এটা যদি একটা সিনেমার দৃশ্য হতো তাহলে এই দৌড়ের কল্যাণে কিশোরী একজন যুবতী নারীতে পরিণত হয়ে যেত। যার চোখ ভরা স্বপ্ন, সে একদিন নায়িকা হবে। তারপর পুরো সিনেমাজুড়ে দেখানো হতো তার জীবনের চড়াই উতরাই। কিন্তু এই কিশোরী একটি বাস্তব মানুষ। যিনি আশির দশক মাতিয়ে রাখেন তার অনবদ্য অভিনয় দিয়ে। উপহার দেন অনেক সুপার হিট সিনেমার। সর্বশেষ ২০২৩ সালে তিনি অর্জন করেছেন আজীবন সম্মাননা। এই নায়িকার নাম রোজিনা।

স্বপ্ন ছিল নায়িকা হবেন

ছোটবেলা থেকেই সিনেমার প্রতি আসক্তি ছিল নায়িকা রোজিনার। স্কুল পালিয়ে এবং বাবা-মার চোখ ফাঁকি দিয়ে হলে গিয়ে সিনেমা দেখতেন তিনি। নতুন কোনও সিনেমা মুক্তি পেলেই বান্ধবীদেরকে সাথে নিয়ে তিনি ছুটে যেতেন সিনেমা হলে। সেই সিনেমা আসক্তি থেকে এক সময়ে হয়ে ওঠেন বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি অভিনেত্রী। বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী রোজিনার পারিবারিক নাম রওশন আরা রেনু। সিনেমা করতে এসে নাম পাল্টে হয়ে যায় রোজিনা। ১৯৭৬ সালে তিনি নামের এই পরিবর্তন ঘটান। যে ছবির জন্য তার নাম পরিবর্তন করে রোজিনা করা হয় সে ছবি তার আর করা হয়নি। এর মাঝে আরো একটি ছবিতে তিনি চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন, হঠাৎ ওই সময় অসুস্থ হয়ে গেলে পরিচালক অন্য একজন নায়িকাকে নিয়ে ফেললে রোজিনা ভীষণ কষ্ট পান। এরপর তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যেভাবেই হোক চলচ্চিত্রে নিজের অবস্থান তৈরি করবেন। ১৯৭৭ সালে ‘আয়না’ ছবিতে শায়লা নামের একটি ছোট চরিত্র নিয়ে প্রথম দর্শকের সামনে আসেন রোজিনা। এরপর ‘রাজমহল’ ছবিতে নায়িকা হিসেবে তার অভিষেক হয়। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটি সে সময় সুপার হিট হওয়ায় রোজিনাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। পুরো আশির দশকে রোজিনা ছিলেন ঢালিউডের অন্যতম জনপ্রিয় নায়িকা।

পালিয়ে নায়িকা হওয়া

রোজিনা রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দে তার নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার শিশু ও কৈশোরকাল কেটেছে নিজ বাড়ি রাজবাড়ী শহরেই। তার পিতা দলিল উদ্দিন ছিলেন একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। মা খোদেজা বেগমের অমতে অভিনয় জগতে প্রবেশ করেন রোজিনা। ভীষণ রাগী মাকে সামলে কাজ করতে হয়েছে তাকে। চার বোন ও দুই ভাইকে তাদের মা সবসময় কড়া নজরদারিতে রাখতেন। কিন্তু রোজিনা ছাড়ার পাত্র নন। তিনি শুনতেন না মায়ের মানা। সিনেমার প্রতি টান তাকে মায়ের প্রতি আরও অবাধ্য করে তোলে। রাজবাড়ীর চিত্রা হলে নতুন কোনো ছবির প্রদর্শনী মানেই বান্ধবীদের সঙ্গে তা দেখতে যাওয়া চা-ই চাই রোজিনার। স্কুল পালিয়ে বান্ধবীদের নিয়ে যেতেন সিনেমা হলে। হাঁ করে তাকিয়ে দেখতেন শাবানা, কবরী, সুচরিতাদের অভিনয়। সেখান থেকে শুরু করেন স্বপ্ন দেখা। তার প্রবল ইচ্ছা জাগে তিনিও শাবানার মতো নায়িকা হবেন। এই স্বপ্ন থেকেই একসময় মাকে নানা বাড়ি বেড়ানোর কথা বলে পালিয়ে আসেন ঢাকায়। তারপর অনেক ইতিহাস।

যেভাবে এলেন অভিনয়ে

ঢাকায় যে আত্মীয়র বাসায় থাকতেন রোজিনা সেই মহল্লায় একটি মঞ্চ নাটক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নাটকটি মঞ্চায়িত হওয়ার কয়েক দিন আগে সেই নাটকের নায়িকা অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে রোজিনা সেই নাটকে অভিনয় করেন। এরপর একদিন জাতীয় সংসদ এলাকায় ঘুরতে যান। দেখেন একটি সিনেমার স্যুটিং চলছে, সিনেমাটির নাম ‘জানোয়ার’। সিনেমায় ট্রে নিয়ে যাওয়ার ছোট একটি চরিত্র ছিল। রোজিনা সেখানে থাকায় স্যুটিংয়ের একজন তাকে অফার দেন অভিনয় করার জন্য। এতেই মহাখুশি হয়ে অভিনয়ের জন্য রাজি হয়ে যান তিনি। টিম তাকে মেকআপ করে দেয়। রোজিনা শুনতে পান ছবির ক্যামেরাম্যান অন্য একজনকে বলছেন, ‘মেয়েটি দেখতে তো বেশ সুন্দর। ওর কয়েকটি স্টিল ছবি তুলে রাখ।’ তারা কয়েকটি ছবি তুলে নেন রোজিনার। সেদিন অভিনয়ের জন্য রোজিনা পান ১০ টাকা। সেই ১০ টাকাই তার জীবনের প্রথম অভিনয় করার সম্মানি।

অফার এলো যেভাবে

এরপর কয়েকটি বিজ্ঞাপনের অফার আসে রোজিনার কাছে। তিনি তখন মায়া বড়ির একটি বিজ্ঞাপনে মডেল হন। এসএমসির জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ির ক্যালেন্ডারে একটি মেয়ের ছবি দেখে হঠাৎই চমকে উঠল সবাই। রক্ষণশীল সমাজে জন্ম নিয়ন্ত্রণ বিষয়টি মানেই এক ধরনের লজ্জা। সেদিনের এই বিজ্ঞাপন অনেকটাই চিরায়িত সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড চপোটাঘাত। বিজ্ঞাপনের মডেল রোজিনা পিছু হটেননি। বরং সাহস করে রুখে দাঁড়িয়েছেন সকল কুপমণ্ডকতার বিরুদ্ধে। জীবনে চলার পথ মসৃণ ছিল না রোজিনার। সিনেমায় ছোট চরিত্র দিয়ে অভিনয় শুরু করেন। কিন্তু নায়িকা হতে একটু সময় লেগে যায়। সিনেমায় নাম ঘোষণা হওয়ার পর বাদ পড়েছেন এমন ঘটনাও আছে তার জীবনে। নানা চড়াই-উতরাই গেছে তার অভিনয় ক্যারিয়ারে। নায়িকা হিসেবে তার প্রথম সিনেমা ‘রাজমহল’। এটি মুক্তির পর সৃষ্টি হয়েছে ইতিহাস। দর্শকের মন জয় করে ক্রমেই এগিয়ে গেছেন। অনেক সামাজিক ও রোমান্টিক সিনেমা দিয়ে দর্শকের হৃদয়ে পৌঁছে গেছেন। এভাবেই হয়ে ওঠেন আশির দশকের হার্টথ্রব নায়িকা।

সম্মাননা

১৯৮৬ সালে ‘হাম দো হায়’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য পাকিস্তানের ‘নিগার অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন রোজিনা। ভারতীয় উপমহাদেশে এক চমক সৃষ্টি করেন তিনি। পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য সুনাম বয়ে নিয়ে আনেন। রোজিনা তৎকালীন ভারতের জনপ্রিয় নায়ক মিঠুন চক্রবর্তী, পাকিস্তানের জনপ্রিয় নায়ক নাদিমসহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত বহু অভিনেতার বিপরীতে নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছেন। অভিনয়ের জন্য চিত্রনায়িকা রোজিনা ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ছোট বড় প্রায় ১৫টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তার অভিনীত ছবির সংখ্যা ২৫৫টি। ১৯৯০ সালের পর তিনি কোলকাতায় পাড়ি জমান এবং সেখানে প্রায় ২০টি সফল ছবিতে নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেন। ২০০৫ সালে ‘রাক্ষুসী’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ইতি টানেন এই নায়িকা।

ইচ্ছা পূরণ

শুধু নায়িকা হতে পারাই যে তার স্বপ্ন ছিল যা তিনি পূরণ করতে পেরেছেন এমন না। যে মায়ের অবাধ্য সন্তান ছিলেন রোজিনা, সেই মায়ের নামেই বানিয়েছেন মসজিদ। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে তুরস্কের নকশায় মায়ের নামে ‘দশ গম্বুজ খাদিজা জামে মসজিদ’ নির্মাণ করেছেন আশির দশকের জনপ্রিয় এই চিত্রনায়িকা। জানা যায়, পৌনে ২ কোটি টাকা ব্যয়ে মসজিদটি নির্মাণে টানা দুই বছর লেগেছে। এই চিত্রনায়িকা আরও জানান সেখানে একটি চক্ষু হাসপাতাল করার চিন্তা আছে তার। সহযোগিতা পেলে সেটাও বানিয়ে ফেলবেন তিনি।

হাইলাইট

১৯৮৮ সালে ‘জীবন ধারা’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পান নায়িকা রোজিনা। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য প্রদত্ত সর্বাপেক্ষা সম্মানীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ‘আজীবন সম্মাননা’। যা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের অংশ হিসেবে ২০০৯ সাল থেকে প্রতি বছর দেওয়া হয়। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আসরে প্রধান অভিনেত্রী ও পার্শ্ব অভিনেত্রী হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু এবার পেলেন আজীবন সম্মাননা। আর এটাই শিল্পীজীবনের সার্থকতা বলে মনে করেন তিনি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

eleven − seven =