মানহা’স কিচেন: ঘরোয়া খাবারে আপ্যায়ন

নাহিন আশরাফ

বাসায় অতিথি আসবে কিন্তু আপনি ভীষণ ব্যস্ত। রান্না করার সময় নেই। আবার তাদের ঘরোয়া খাবার দিয়েই আপ্যায়ন করতে চান। সেক্ষেত্রে কেমন হয় যদি ঘরে তৈরি করা খাবার আপনি অর্ডার দিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসতে পারলেন। বেশ কয়েক বছর ধরেই বাড়িতে রান্না করে গ্রাহকদের হাতে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে উদ্যোক্তারা। নারীরা এ কাজে অনেক বেশি এগিয়ে থাকলেও পিছিয়ে নেই পুরুষরাও। আজ জানব এমন একজনের কথা যিনি অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে গৌরবের সাথে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচয় দিতে পারছেন।

নাম মোরশেদ মহিউদ্দিন। ছোটবেলা থেকেই রান্নাবান্নার প্রতি ভীষণ আগ্রহ। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পুরুষদের রান্নাঘরে আনাগোনা অনেকেই ভালো চোখে দেখেন না। ছোটবেলায় যখন মায়ের পাশে বসে মোরশেদ রান্না দেখতেন কিংবা টুকটাক কিছু করার চেষ্টা করতেন তখন মা তাকে বকে রান্নাঘর থেকে বের করে পড়তে বসিয়ে দিতেন। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন বাবা। তিনি কখনও মোরশেদের স্বপ্নকে ছোট করে দেখতেন না। বরং তিনি মনে করতেন যার যেখানে আগ্রহ সেখানে কাজ করতে দিলেই সে সফলতা লাভ করবে।

রান্নার প্রতি প্রবল আগ্রহ আর মায়ের বকুনি খেতে খেতে ছেলেবেলা কাটলো। মোরশেদ ভর্তি হলেন ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে। শুরুতে ইচ্ছা ছিল হোটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়ার। কিন্তু নানা কারণে তা না হওয়ায় পড়াশোনার জন্য ফ্যাশনকেই বেছে নেন। পড়াশোনার সুবাদে তাকে হোস্টেলে থাকতে হতো। তখন নিজের রান্না নিজেই করতেন। রুমের সবাই তার খাবার খেয়ে ভীষণ প্রশংসা করতেন। কোনো উৎসবে তার কাঁধেই পড়তো রান্নার দায়িত্ব। আগ্রহ ছিল ছোটবেলা থেকেই কিন্তু রান্নার হাত পাকা হয় হোস্টেল জীবনেই। তার বন্ধুরাও তাকে বেশ উৎসাহ দিতে থাকে। ২০১৪ সালে তিনি জার্মানিতে পাড়ি জমান রিটেইন ট্রাড অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের কোর্স করার জন্য। জার্মানিতে তিনি কিছু ভিনদেশিদের সাথে হলে থাকতেন। তার রান্নার প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ে সেখানেও। নেপাল, পাকিস্তান ও ইউরোপের কিছু মানুষ তার সাথে হলে থাকতেন। তার হাতের রান্না খেয়ে তারা বলেছেন, এমন রান্না তারা আগে কখনো খাননি।

মোরশেদ যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন সে বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যাপনায় যোগ দেন। কিছুদিন চাকরি করার পর তিনি আর অধ্যাপনায় আনন্দ পাচ্ছিলেন না। নানাধরনের সমস্যায় কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলে পাশে ছিলেন সহধর্মিনী ও তার বাবা। তার বাবা মোরশেদকে বলতেন, যদি রান্না নিয়ে কাজ করতে চাও অবশ্যই মশলা সম্পর্কে পড়াশোনা করতে হবে। সঠিক জ্ঞান অর্জনের পরই তিনি যেন চাকরি ছাড়েন। মোরশেদের সফলতার পেছনে বাবার ভূমিকা অনেক বেশি যা তিনি বারবারই বলছিলেন। শুরুতে তার পরিবারের কেউই তাকে সহযোগিতা করেননি। ৯ ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হবার কারণে তার প্রতি সবার আশা ছিল একটু বেশি। তাই ভাইবোনরাও ভরসা করতে পারছিলেন না যে তিনি আসলে রান্নার পেশায় ভালো করবেন কি না।

কিন্তু মোরশেদ মহিউদ্দিন কখনো থেমে থাকেননি। বাবার কথা মতো মশলা বিষয়ে নিজের জ্ঞান আরো বৃদ্ধি করছেন। কোন মশলার মিশ্রণে কি হতে পারে তা নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা শুরু করেন। যখন তিনি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন যে এখন তিনি কাজের জন্য প্রস্তুত তখন চাকরি ছেড়ে দেন। তবে প্রথমে তিনি ঘটা করে প্রচার কিংবা ব্যবসা শুরু করেননি। শুধুমাত্র কাছের বন্ধুরাই তার রান্নার ব্যাপারে জানতেন ও তাকে অর্ডার দিতেন। কোনো অনুষ্ঠানে তাকে রান্না করে দিতে বলতেন। সবার প্রশংসা ও উৎসাহে তিনি মানহা’স কিচেন নামে ফেসবুক পেইজ খোলেন। তার বড় মেয়ের নাম মানহা, পেইজের নামকরণ করেন মানহা। শুরু হয় মানহা’স কিচেনের পথ চলা।

ফেসবুকের কল্যানে তার প্রচার বাড়তে থাকে। একজনের মাধ্যমে আরেকজনের কাছে তার নাম ছড়িয়ে যায়। অর্গানিক পণ্য, নিজের হাতে করা ৩৫ রকমের মসলা, ফ্রোজেন ফুড ও ক্যাটারিং সার্ভিস দিয়ে ধীরে ধীরে নিজের পেইজ সাজান তিনি। ক্যাটারিংয়ে তিনি সর্বোচ্চ ১৩০ জনের খাবারের অর্ডার নেন। যেহেতু নিজের হাতে সব রান্না করেন ও নিজের রান্নাঘরে সব করেন তাই কিছু সীমাবদ্ধতা থেকেই যায়। মসলা তিনি নিজে তৈরি করে থাকেন। যেহেতু মসলা নিয়ে কাজ করা তার নেশা তাই তিনি কেনা মসলা রান্নায় ব্যবহার করেন না। রোস্ট, বিরিয়ানি, মাছের কারি, কাবাব, বিফ, চিকেন, চটপটি, বোরহানি, আচারি, চাট, নুডলস, আখনি, রেজালা; এমন সব ধরনের মসলা তার কিচেনে পাওয়া যায়। অর্গানিক পণ্যের মধ্যে রয়েছে নারকেল তেল, বাদাম কটকটে, সরের ঘি, মধু, মাখন, খিরসা, মালাই মাওয়া, দুধ চা পাতা, হলুদ ডাল বড়ি, নারকেল চিড়া, কালোকেশি চিড়া, ক্রিমের গাওয়া ঘি, মোজেরেলা চিজ, আখ ও খেজুর গুড়, পেঁপের মোরব্বা ইত্যাদি। নানা রকম পিঠাও রয়েছে যেমন গোলাপ, ভাপা, ডিম সুন্দুরি, বিবি খানা, তেলের পোয়া, নারকেলের মালাই লাড্ডু ইত্যাদি।

মোরশেদ মহিউদ্দিন বলেন, দেশের অনেক ঐতিহ্যবাহী খাবার হারিয়ে যাচ্ছে। তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খাঁটি জিনিস সংগ্রহ করার চেষ্টা করি, যাতে সবার হাতে ভালো মানের পণ্য দিতে পারি। তিনি বিশ্বাস করেন, ব্যবসা করতে চাইলে গ্রাহকদের কখনো ঠকানো যাবে না। কারণ ভালো জিনিস দিতে পারলে অবশ্যই গ্রাহক আবার আসবে। কিন্তু খারাপ জিনিস দিয়ে একবার লাভ করলেও সেই কাস্টমারকে হারাতে হবে। তার কাছে সবচেয়ে বড় অর্জন গ্রাহকের আস্থা। তিনি জানান, তিনি রান্নায় নানা রকম পরীক্ষা-নীরিক্ষা করতে পছন্দ করেন। কোন মসলার সাথে কোনটা ভালো হবে, কোনটার সাথে কি মসলা দিলে আরো ভালো রান্না হবে এসব নিয়েই তার ভাবনা। তবে ফিউশন করতে চাইলে অবশ্যই মসলা সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। তা না হলে রান্না নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বাবার পরে যিনি সবসময় তার পাশে থেকেছেন তিনি তার সহধর্মিনী। সবসময় তার কাজের উপর আস্থা রেখেছেন। তার সব সিদ্ধান্তকে সম্মান করেছেন। তার মেয়েরা এখন বাবার দেখাদেখি রান্নায় আগ্রহী হয়ে উঠছে।

এই দীর্ঘ পথচলায় পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন কয়েকবার। ফরিদপুরে জন্ম হলেও চট্টগ্রাম শহরেই তার বেড়ে ওঠা। তাই খাবারে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের ছোঁয়া রাখেন তিনি। চট্টগ্রামের রেড কার্পেট কমার্শিয়াল আয়োজিত ফুড ফিয়েস্টায় প্রথম বেস্ট হোমমেড ফুড অ্যাওয়ার্ড পায় মানহা’স কিচেন। চট্টগ্রাম ফুড কার্নিভালে বেস্ট ফুড সেলার অ্যাওয়ার্ডও পান তিনি। এছাড়া চট্টগ্রাম ৯৬/৯৮ ক্লাব আয়োজিত ফুড ফেস্টিভ্যাল অ্যাওয়ার্ডস জিতেন। ক্লাসি ৬৯ আয়োজিত ফুড অ্যান্ড লাইফ স্টাইলে পান বেস্ট ফুড অ্যাওয়ার্ড।

মানহা’স কিচেন নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভবিষ্যৎ এ তার একটি শপ দেওয়ার ইচ্ছা আছে। যেখানে বিভিন্ন রকমের স্পাইস হাব হবে, দেশীয় মসলা সবার সামনে তৈরি করে বাজারজাত করা হবে। এছাড়া সবসময় রান্নার সাথেই থাকতে চান ও নতুন অনেক কিছু শিখতে চান। তার সবচেয়ে ভালো লাগে যখন কেউ তার হাতের রান্না খেয়ে তৃপ্তি পান। কখনোই তিনি পণ্যের মান নিয়ে আপোষ করতে চান না। নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে সেরা পণ্যটি সবার হাতে তুলে দিতে চান।

মোরশেদ মহিউদ্দিনের মতে দেশে এখন হোমমেইড পণ্যের অনেক চাহিদা। কিন্তু ভালো মানের পণ্য অনেকেই দিতে পারছেন না। ভবিষ্যতে যারা হোমমেড ফুডের সাথে যুক্ত হতে চান তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, এ ব্যবসায় আসার আগে মসলা ও খাবার নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করতে হবে। দেশের সকল স্থানের ঐতিহ্যবাহী খাবার সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। ফিউশনের মাধ্যমে খাবারের মধ্যে নিজস্বতা নিয়ে আসতে হবে। কারণ রান্না একটি শিল্প ও রাঁধুনি একজন শিল্পী। রান্নায় কোনো নারী পুরুষ নেই, যে কেউ রান্না করতে পারে। রান্না শুধু নারীদের জন্য, এই ধারণা থেকে সবার বেরিয়ে আসা জরুরি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ইন্টারপ্রেনিওর

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

seven − 5 =