পুরান ঢাকা ইতিহাস-ঐতিহ্য

পুরান ঢাকা নামের সঙ্গে পুরান শব্দটি শুনেই বোঝা যায় অতীতের সঙ্গে এর সম্পর্ক বেশ গভীর। পুরান ঢাকার গলিতে গলিতে রয়েছে অতীত ঐতিহ্যের ছোঁয়া। এ অঞ্চলের পুরোনো আমলের ভাঙাচোরা ভবনগুলো জানান দেয় এক সময় জৌলুসের কমতি ছিল না। বর্তমানে ঢাকার অভিজাত এলাকা হিসেবে বারিধারা গুলশান বনানী বিবেচিত হলেও আজ থেকে চার শ বছর আগে শহুরে সভ্যতার উত্থান ঘটেছিল বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা জনপদকে ঘিরে। ব্যবসা বাণিজ্য আভিজাত্য বনেদিয়ানা সমস্ত কিছুর প্রাণকেন্দ্র ছিল শহরের এই অংশে। কালের বিবর্তনে যা আজ পুরান ঢাকা নামে পরিচিত। হাসান নীলের প্রতিবেদন।

গোড়াপত্তন ও নামকরণ

পুরান ঢাকার নামকরণের ইতিহাস জানতে হলে যেতে হবে কয়েক শ বছর পেছনে। বুড়িগঙ্গা তখন ছিল জঙ্গলে ঢাকা। সেসময় রাজা বল্লাল সেন ওই জঙ্গলে দেবী দুর্গার বিগ্রহ খুঁজে পান। বিগ্রহটি জঙ্গলে ঢাকা ছিল ফলে দেবীর নামকরণ করা হয় ঢাকেশ্বরী। পরে এই নামে মন্দিরও নির্মাণ করা হয়। এই ঢাকেশ্বরী নাম থেকেই শহরের নাম হয়ে ওঠে ঢাকা। তবে এই গল্প সবাই বিশ্বাস করেন না। তারা মনে করেন, ইসলাম খান চিশতির হাত ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ঢাকা। বাংলার বারো ভুইয়ার শেষ জমিদার মুসা খাঁর পতনের মধ্য দিয়ে ঢাকা মোঘলদের অধীনস্ত হয়। তখন ইসলাম খানের হাত ধরে শুরু হয় এই ঐতিহাসিক যাত্রার। মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬১০ সালে ঢাকাকে রাজধানী ঘোষণা করেন। এতে ভীষণ আনন্দিত হন সুবাদার ইসলাম খান। ঢাকার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত ঢাক বাজিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন তিনি। কথিত আছে এই ঢাক শব্দটি থেকেই ঢাকা নামের উদ্ভব।

বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলি

পুরান ঢাকার অলিখিত নাম বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলি। অতীত ইতিহাস না মিললেও ধারনা করা হয় অগণিত গলি ও বাজারই এ নামের কারণ। আদি এই শহরে যেমন গলির অভাব নেই তেমনই এর পাড়ায় পাড়ায় রয়েছে বাজার। সেকারণেই এটি অনেকের কাছে বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলি নামেও পরিচিত।

ইতিহাস মিশে আছে পুরান ঢাকায়

পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকার নামকরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একেকটি গল্প। ঢাকায় থাকেন অথচ ওয়ারির নাম শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। এটি পুরান ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। ১৮৮৪ সালে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন মি. ওয়্যার। শোনা যায়, তার নামানুসারেই এলাকাটির নাম হয়ে যায় ওয়ারি। একটা সময় অভিজাত শ্রেণির লোকের বাস ছিল ওয়ারিতে। অঞ্চলটির রাস্তাঘাট পুরান ঢাকার অন্য অংশের তুলনায় প্রশস্ত ও দৃষ্টিনন্দন। আর্মানিটোলার সঙ্গেও মিশে আছে আরেক গল্প। সতেরো শতকের দিকে ঢাকায় আসে আর্মেনীয়রা। ৪০০ বছরের পুরানো এ শহরে তারা এসেছিল ব্যবসার উদ্দেশ্যে। পসরা সাজিয়েছিল পাট, বস্ত্র, লবণ আর সুপারির। তারা যে অংশটিতে থাকত সেটি ধীরে ধীরে আর্মানিটোলা নামে পরিচিতি পায়।

চানখাঁর পুলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ব্যাঞ্জো বাদক চান খাঁর নাম। শোনা যায় তার নাম অনুসারে এলাকাটির নাম চানখাঁর পুল নামে পরিচিতি পায়। সেসময় নদীবেষ্টিত ঢাকার চারপাশ বরষা মৌসুমে জলে টইটম্বুর হয়ে যেত। শহরের ভেতরেও ছিল ছোট ছোট খাল বিল। আষাঢ়-শ্রাবণে যাতায়াতের জন্য সেসব খানাখন্দের ওপর বসানো হতো পুল বা সেতু। সব মিলিয়ে দৃষ্টিনন্দন এক পরিবেশের সৃষ্টি হতো। এ কারণে ঢাকাকে পশ্চিমের ভেনিস বলা হতো।

ব্রিটিশ আমলে ঢাকা ছিল রূপবতী শহর। এ শহরে যিনি একবার আসতেন দুচোখ ভরে নিয়ে যেতেন মুগ্ধতা। গেন্ডারিয়াও তার ব্যতিক্রম ছিল না। একবার এক ইংরেজ ভদ্রলোক ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ধোলাই নদীর ওপর লোহার পুলের কাছে এসে লাগাম টানেন। চারদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি বলে উঠেন, হোয়াট এ গ্র্যান্ড এরিয়া। এরপর থেকে জায়গাটির নাম হয় গেন্ডারিয়া। ঢাকার প্রথম আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছিল এই গেন্ডারিয়ায়। এখানে রয়েছে বেশকিছু দর্শনীয় স্থান। এরমধ্যে সীমান্ত পাঠাগার, সুচিত্রা সেনের শ্বশুরবাড়ি, সাধনা ঔষধালয়, গেন্ডারিয়া রেলস্টেশন, ব্যারাক মিল অন্যতম।

ফরাশগঞ্জ বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীরে গড়ে ওঠা জনপদ। এক সময় ফরাসি বণিকদের হাঁক-ডাকে মুখরিত থাকতো এ এলাকা। সতের শতকের মাঝামাঝিতে ঢাকায় বাণিজ্য করতে আসে তারা। স্থান হিসেবে বেছে নেয় বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তরের তীরবর্তী এলাকা। ফরাসিদের বাণিজ্যিক কেন্দ্র হওয়ার পর থেকেই জায়গাটি ফরাশগঞ্জ নামে পরিচিত হয়। পরে ব্রিটিশদের দ্বারা ফরাসিরা বিতাড়িত হলেও স্থানটির নাম ঠিকই রয়ে যায় তাদের নামানুসারে।

নবাবপুরের নাম ছিল উমেরপুর। কেননা এই অঞ্চলে বাস করতেন আমির ওমরাগণ। পরে ইসলাম খানের আমলে এই রাস্তা দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করতেন নবাব বাহাদুর। নবাবের বিচরণের কারণে উমেরপুর হয়ে ওঠে নবাবপুর। সূত্রাপুর নামটি এসেছে সূত্রধর থেকে। একসময় এখানে সূত্রধরদের বাস ছিল। তারা মূলত কাঠের কাজ করতেন। বাড়ি-ঘর, নৌকাসহ কাঠ দিয়ে যত নির্মাণ হতো তারাই করতেন। এই সম্প্রদায়ের নামানুসারেই স্থানটির নাম হয় সূত্রাপুর। ঢাকার প্রথম মুঘল সুবেদার ও মুঘল বাহিনীর প্রধান ছিলেন ইসলাম খান চিশতি। তার নামানুসারে নামকরণ হয়েছে ইসলামপুরের। এক সময় এই এলাকা কাঁসা-পিতল, ঘড়ি, বই-পুস্তক প্রভৃতি পণ্যের ব্যবসার জন্য বিখ্যাত ছিল।

একটা সময় ধূমপান বিলাসীরা হুকায় তামাক সাজিয়ে টানতেন। এজন্য কাঠ-কয়লার গুঁড়া দিয়ে গোল করে এক ধরনের জিনিস বানানো হতো। এগুলোর নাম ছিল টিকিয়া। তামাক সাজানোর পর আগুন দিতে এই টিকিয়া ব্যবহার করা হতো। টিকিয়া প্রস্তুতকারীরা বাস করতেন টিকাটুলিতে। তাদের পেশার নামানুসারেই অঞ্চলটি পরিচিত হয়ে ওঠে। এছাড়া সদরঘাট, গুলিস্তান, নারিন্দা, ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশনসহ পুরান ঢাকার অন্যান্য এলাকার নামের সঙ্গেও এরকম একেকটি গল্প মিশে আছে।

পুরান ঢাকার মানুষগুলো

ইতিহাস ঐতিহ্যে পুরান ঢাকার যেমন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে তেমনই এর জনগোষ্ঠীও অন্যদের চেয়ে আলাদা। এখানকার অধিবাসীদের ভাষা, জীবনযাত্রা রীতি-নীতির ভিন্ন। আলাদা তাদের সংস্কৃতিও। পুরান ঢাকার অধিবাসীদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে দিল্লীর বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এ অঞ্চলের স্থানীয় বসিন্দাদের ঢাকাইয়া কিংবা কুট্টি বলা হয়। তারা কথা বলার সময় বিদেশি শব্দ বিশেষ করে আরবি, উর্দু ব্যবহার করে থাকেন। পুরান ঢাকার জনগোষ্ঠী অতিথি আপ্যায়নে যাকে বলে দিলখোলা। মেহমানদারিতে অন্যান্য অঞ্চলের মানুষজন ধারেকাছে আসতে পারবে না ঢাকাইয়াদের।

পাশাপাশি তারা নিজেরাও খেতে ভালোবাসে। তাদের প্রথম পছন্দ মসলাদার খাবার। সেইসঙ্গে রয়েছে উত্তর ভারতীয়, মোঘল খাবার। যেমন বিরিয়ানি, কাচ্চি, হালিম, কাবাব। একদম শাহী ব্যাপার স্যাপার। এখানকার উল্লেখযোগ্য খাবারগুলো হলো: টিক্কা, জালি কাবাব, কাঠি কাবাব, শামি কাবাব, বটি কাবাব, নার্গিস কাবাব, শিক কাবাব, দই বড়া, মুরগি মুসল্লম, পায়া, কাচ্চি বিরিয়ানি, পাক্কি বিরিয়ানি, মোরগ পোলাও, নান রুটি, বাকরখানি, নিহারি, বোরহানি, লাবাং ইত্যাদি। পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের এসব খাবারের জনপ্রিয়তা শুধু তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, দেশজুড়ে তা আজ বিখ্যাত। অনেকেই খাবার উপভোগ করতে পুরান ঢাকায় যান বিরিয়ানি হাউজগুলোতে।

এছাড়া এ জনগোষ্ঠী বেশ ধার্মিক। এখানে বিভিন্ন ধর্মের লোক বাস করলেও মুসলমানরা সংখ্যায় বেশি। প্রতিটি পাড়া মহল্লায় এক থেকে দুটি করে মসজিদ দেখা যায়। পুরান ঢাকার জনগোষ্ঠীর আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো আদব-কায়দা। এখানে বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি বেশ সম্মান প্রদর্শন করা হয়।

পুরান ঢাকার বাসিন্দারা উৎসবপ্রিয়ও বটে। বিশেষ দিনগুলো তারা বেশ জমিয়ে উদযাপন করে থাকে। বিশেষ করে ধর্মীয় উৎসবগুলো। দুই ঈদে তারা আয়োজনের কমতি রাখে না। আর শবে বরাতের রাতে পুরান ঢাকার আকাশ আলোকিত হয় অগণিত ঝাড়বাতি মরিচবাতিতে। মসজিদে মসজিদে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সারারাত ইবাদতে রত থাকেন। বাংলা নববর্ষ উদযাপনেও স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ থাকে তাদের।

সাকরাইন উৎসব

যে উৎসব পুরান ঢাকায় একযোগে পালিত হয় সেটি সাকরাইন উৎসব। পৌষ সংক্রান্তিতে তারা মেতে ওঠে এই উৎসবে। এটি মূলত ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব। এদিন পুরান ঢাকার ছাদগুলোতে বসে ঘুড়ি উড়ানোর আসর। লাল নীল হলুদ হরেক রঙের হরেক রকমের ঘুড়িতে সেজে ওঠে পুরান ঢাকার আকাশ। ঘুড়িতে ঘুড়িতে কাটাকুটি খেলা সাকরাইনের জৌলুশ বাড়িয়ে দেয়। ছেলে বুড়ো সবাই প্রাণ খুলে অংশ নেয় ঐতিহ্যবাহী সাকরাইন উৎসবে। উৎসব দেখতে শহরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উৎসুক জনতা এসে জড়ো হয় পুরান ঢাকায়। সাকরাইন উৎসব মূলত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের হাত ধরে এসেছে। তাই মুসলমান সম্প্রদায় ঘুড়ি নিয়ে মেতে থাকলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এদিন পূজা অর্চনাও করে থাকেন।

দর্শনীয় স্থান

কী নেই পুরান ঢাকায়? ইতিহাসের স্মৃতিবিজড়িত লালবাগ কেল্লা, ঢাকেশ্বরী মন্দির, তারা মসজিদ, হোসেনি দালান, আহসান মঞ্জিল, শাঁখারি বাজার, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, বড় কাটারা, ছোট কাটারা, বাহাদুর শাহ পার্ক পাশাপাশি রয়েছে এখানে।

বাণিজ্যিক কেন্দ্র

পুরান ঢাকা দেশের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র। প্রথমেই আসে চকবাজারের নাম। সুই থেকে কাফনের কাপড় সব পাওয়া যায় এখানে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষটিও চকবাজারের নাম জানেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের খুচরা, পাইকারি বিক্রেতারা এখানে আসেন পণ্য কিনতে। আর থান কাপড়ের জন্য বিখ্যাত ইসলামপুর। বিভিন্ন অঞ্চলের কাপড় ব্যবসায়ীরা এখানে আসেন ব্যবসার জন্য থান কাপড় কিনতে। দেশের বৃহত্তর চামড়া প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল পুরান ঢাকার হাজারিবাগে। এছাড়া নিত্য প্রয়োজনীয় পচনশীল খাদ্যদ্রব্যের বৃহত্তম বিক্রয় অঞ্চল পুরান ঢাকা। রোজ শহরের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা এখানে হাজির হন ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে। সেইসঙ্গে দেশের বৃহৎ একটি অংশ কর্মসংস্থানের খোঁজে ছুটে আসেন এখানে।

পুরান ঢাকার সীমানা

সবশেষে জেনে নেই ঠিক কোন এলাকা থেকে কোন এলাকা পর্যন্ত পুরান ঢাকার আওতাভুক্ত। পুরান ঢাকা পূর্ব-পশ্চিমে গেন্ডারিয়া ফরিদাবাদ থেকে হাজারিবাগ ট্যানারি মোড় পর্যন্ত বিস্তৃত। আর দক্ষিণে এর সীমানা সদরঘাট থেকে নবাবপুর পর্যন্ত বিস্তৃত। কয়েক শ বছর ধরে কতশত ইতিহাসের সাক্ষী এই পুরান ঢাকা।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: কোথায় কি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

5 × 5 =