মিমি’স রসুইঘর

নাহিন আশরাফ

কেউ ব্যবসা করে, কেউ বা চাকরি। দুটো একসাথে করা বেশ কঠিন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ব্যবসার নেশায় চাকরি ছেড়ে দেন অনেকে। কিন্তু স্রোতের বিপরীতে হাঁটছেন আফরোজা ইসলাম চৌধুরী। ডাক নাম মিমি। চাকরি এবং ব্যবসা দুটোই সামলে যাচ্ছেন আত্মবিশ্বাসের সাথে। নিজের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠা করেছেন অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা ‘মিমি’স রসুইঘর’।

মিমি’স রসুইঘরে রান্না হয় বাহারি সব খাবার। ঘরোয়া পরিবেশে স্বাস্থ্যসম্মত রান্নার জন্য আজকাল হোম মেইড ফুড পেইজগুলো সবার কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যান্ত্রিক জীবনে অতিথি আপ্যায়নে হোমমেইড খাবারের অনলাইন পেইজগুলো যেন এখন সকলের শেষ ভরসা। রান্নাঘর সামলানোর পাশাপাশি আফরোজা ইসলাম ফুল টাইম চাকরি করছেন উন্নয়ন কর্মী হিসেবে।

আফরোজা ইসলামের বেড়ে উঠা ঢাকাতেই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স সম্পন্ন করেছেন। ছোটবেলা থেকে ভিন্ন পরিবেশে বড় হয়েছেন তিনি। দেশের প্রেক্ষাপটে বাড়ির পুরুষরা তেমন রান্নাঘরে যাওয়া আসা করে না, কিন্তু মিমির বাড়িতে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃশ্য। ছোটবেলা থেকে দেখেছেন বাড়ির প্রত্যেকটি সদস্য রান্নার প্রতি ভীষণ আগ্রহ। শুধু মা, চাচীরা নন পরিবারের বাবা-চাচা-মামা-ভাই সকলে মিলে রান্না করতেন। রান্নার ক্ষেত্রে তাদের বাড়িতে কোনো ভেদাভেদ চলতো না। রান্না ও খাদ্য রসিক এক পরিবারে বেড়ে উঠেন তিনি। তার পরিবারের রান্নারও বেশ সুনাম ছিল। বন্ধুবান্ধবরা তার কাছে আবদার করতো তার বাড়ির বিভিন্ন ধরনের খাবার খাওয়ার। তাদের বাড়িতে যেদিন ছেলেরা রান্না করতেন সেদিন মেয়েরা আর রান্নাঘরের কাছে যেতেন না। বাবা-চাচারা যেদিন রান্না করতেন সেদিন তুমুল আগ্রহ নিয়ে তারা খাবারের অপেক্ষা করতেন। এমন একটি পরিবেশে যিনি বড় হয়েছে তার রান্নার প্রতি আগ্রহ থাকা খুব স্বাভাবিক। তার পরিবার বিশ্বাস করে রান্না একটি শিল্প, আর শিল্পের কোনো লিঙ্গ হয় না। নারী ও পুরুষ সমানতালে যে কোনো কাজ করলে কাজটি আরো ভালো হয়।

তবে ছোটবেলায় মা তাকে রান্নাঘরে বেশি ঢুকতে দিতেন না। দুই ভাইয়ের পর একমাত্র মেয়ে হবার কারণে তাকে রান্না থেকে কিছুটা দূরে থাকতেই বলা হতো। কিন্তু বাড়িতে বিশেষ অতিথি এলে মিমি দু’একটি পদ আয়োজন করে রান্না করতেন। মিমির কাছে সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল যখন তার হাতের রান্না খেয়ে কেউ বলতেন ‘তোমার রান্না তো একদম তোমার মায়ের মতো’। কারণ তার মায়ের হাতের রান্না পরিবার ও বন্ধুদের সকলের খুব প্রিয় ছিল। তার বন্ধুরা প্রায়ই তার মায়ের হাতের রান্নার কথা বলতো। ঠিক এভাবেই রান্নার প্রতি আগ্রহ নিয়ে বড় হতে থাকেন মিমি। তবে রান্না নিয়ে কাজ করার কোনো ইচ্ছা ছোটবেলায় ছিল না তার। পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। চাকরির মাধ্যমেও তিনি জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।

‘মিমি’স রসুইঘর’ এর যাত্রা শুরু হয় করোনার সময়। মায়ের মতো মিমির রান্নার সুনাম পরিবার ও বন্ধুমহলে ছড়িয়ে যায়। যেকোনো উৎসব আয়োজনে রান্নার দায়িত্ব দেওয়া হতো মিমিকেই এবং হাসিমুখে সে দায়িত্ব পালনও করতেন তিনি। কারণ এটি তার প্রিয় জায়গা। প্রায়ই তার কাছের মানুষরা তাকে উৎসাহ দিতেন রান্না নিয়ে কাজ শুরু করার জন্য। করোনার সময় পুরো বিশ্ব গৃহবন্দী হয়ে গেল। মিমি তখন ঘরে বসে অনলাইনে অফিস করছেন। সেসময় কয়েকজন উদ্যোক্তা তার কাছে আসেন যারা নিজেদের পরিচয় না দিয়ে পেছনে থেকে ব্যবসা করতে চান। তখন মিমির মনে হয় তাদের নিয়ে রান্নার কাজ শুরু করা যেতে পারে। তখন পেইজ খুলে শুরু করে দেন হোমমেইড খাবারের ব্যবসা। তার সাথে কাজ শুরু করেন কয়েকজন নারী উদ্যোক্তা।

মিমি বলেন, এ ব্যবসার যুক্ত হবার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল যারা নিজের পরিচয় গোপন রেখে কাজ করতে চায় তাদের সাহায্য করা ও নিজের হাতের রান্না সবার কাছে পরিবেশন করার ইচ্ছা থেকে। করোনার সময় পুরো পৃথিবী থেমে থাকলেও থেমে থাকেনি মিমি’স রসুইঘর। করোনাতে আক্রান্ত হয়ে যারা গৃহবন্দী হয়ে পড়েছিলেন, ঘর থেকে বের হতে পারছিলেন না, তাদের খাবার সরবরাহ করতেন তিনি। এমনও হয়েছে যে লকডাউনে করোনায় আক্রান্ত কোনো পরিবার ১৪/১৫ দিন তার কাছ থেকে খাবার নিয়েছে। বন্ধুমহলে ও একজনের থেকে আরেকজনের মাধ্যমে তার পেইজের কথা সবদিকে ছড়িয়ে যেতে থাকে।

করোনার মধ্যে ঘরে বসে অফিস করার ফলে তার কিছুটা সুবিধা হয় ব্যবসায় মনযোগ দিতে। কিন্তু করোনাকালীন সময়ের পর অফিসে যেতে হয়। তখন ব্যবসা ও চাকরি দুটো একসাথে সামলে উঠতে পারাটা তার জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল। সব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েও তিনি ব্যবসা সামলে নিতে থাকেন। মিমি’স রসুইঘর পরিচিতি পেতে থাকে। তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফ্রোজেন আইটেম। কারণ ফ্রোজেন খাবার বাচ্চাদের স্কুলে টিফিন হিসেবে দেওয়া যায়। এছাড়া কাচ্চি বিরিয়ানি, নানা রকমের পিঠা, আচার, তেহারি, সিজনাল ভর্তা এমন ধরনের খাবার তৈরি করে থাকেন তারা। এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১০০ জনের খাবারের অর্ডার নিয়েছেন। ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরের অর্ডার নেওয়ার পরিকল্পনা তাদের আছে।

ছোটবেলা থেকেই আফরোজা ইসলাম চৌধুরী মানুষকে সাহায্য করতে ভালোবাসেন। কারো বিপদে, কারো প্রয়োজনে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করেন ও পাশে থাকেন। বিশেষ করে সেসব নারীদের তিনি সাহায্য করেন যারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় ও নিজে কিছু করতে চায়। অনেক নারীরা উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করতে চায় কিন্তু সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে কাজ করতে পারে না। যেসব নারীদের তিনি পথ দেখান, নানাভাবে সহযোগিতা করেন। তিনি চেষ্টা করেন নারীদের পাশে থাকার। বিশেষ করে তার সবচেয়ে পছন্দের কাজ হচ্ছে কাউকে পড়ালেখা শিখতে সাহায্য করা। নারীদের পড়ালেখার বিষয়ে তিনি সবসময় আগ্রহ দিয়ে থাকেন। তার কাছে সাহায্য চাইলে তিনি খুশি মনে তাদের সাহায্য করেন। নানা ধরনের সমাজকর্মের সাথে জড়িত তিনি। চাকরি ও ব্যবসা একাধারে সামলে নিতে পারার পেছনে পরিবারের ভূমিকা রয়েছে বলে জানান মিম। ব্যবসা শুরুর দিন থেকে স্বামী তাকে সবসময় সহযোগিতা করেছেন। প্রথম যখন পেইজ খুলেন তার স্বামী তাকে সব শিখিয়ে বুঝিয়ে দেন কিভাবে পেইজ চালাতে হবে। সারাদিন অফিস করে বাসায় এসে অনেক সময় রান্না করতে ঝামেলার মধ্যে পড়তে হয়, তখন তার স্বামী ঘরের অন্যান্য কাজে তাকে সহযোগিতা করেন। অনেক সময় ডেলিভারির ঝামেলা হলে তিনি নিজেই ডেলিভারি দিয়ে আসেন। তার শ্বাশুড়িও রান্নাবান্নায় বেশ ভালো। শ্বশুর বাড়ির সকলে তাকে বেশ উৎসাহ দেন যাতে তিনি এই ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারেন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি পরিবারকে সময় দিতে কখনো ভুলেন না। ছেলের পড়ালেখা শেষ করানো ও সকল বিষয়ের তদারকি করার দায়িত্ব তিনি নিজেই পালন করেন। এতো কিছুর মধ্যে তার মধ্যে কখনো ক্লান্ত লাগে না কারণ তিনি পেশা হিসেবে নিজের শখের কাজকেই বেছে নিয়েছেন।

আফরোজা ইসলাম চৌধুরী বলেন, সবদিক সামলাতে চাইলে টাইম ম্যানেজমেন্ট অনেক বেশি জরুরি। নিজের কাজের একটা রুটিন থাকা প্রয়োজন যে কখন কোন কাজ করব ও কখন কোন কাজ থেকে বিরতি নিব। নারীর জীবনে পরিবারের সহযোগিতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নারীরা পরিবারের সহযোগিতার না পেলে তাদের চলার পথটা কঠিন হয়ে যায়। সেদিক থেকে তিনি নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করেন। কারণ তার ব্যবসা ও চাকরির শুরুর দিন থেকে তার পরিবারের সকলে তাকে সহযোগিতা করছেন। যেসব নারীরা উদ্যোক্তা হতে চান তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, উদ্যোক্তা হতে হলে প্রথমে প্রচণ্ড ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। কারণ ব্যবসা করা সহজ নয়, অনেক ওঠা-নামা জীবনে আসবে তা মেনে নিয়ে আবারও সুন্দর করে পথ চলতে হবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ইন্টারপ্রেনিওর

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

11 − seven =