মিস্ত্রি থেকে খ্যাতিমান অভিনেতা সব্যসাচী

মাধবী লতা: একজন মিস্ত্রি কিভাবে সবার চোখের মণি হয়ে গেলেন সেই গল্পই বলবো। যে মানুষটিকে নিয়ে কথা হচ্ছে তার নাম সব্যসাচী চক্রবর্তী। কলকাতা ও বাংলাদেশের জনপ্রিয় মুখ তিনি। বাঙালি দর্শকের তাকে চেনে ‘ফেলুদা’ হিসেবে। ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ফাখরুল আরেফীন খানের ‘জ্যাঁ কুয়ে ১৯৭১’র বাংলাদেশ প্রিমিয়ারে ঢাকায় এসেছিলেন অভিনেতা সব্যসাচী। এখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডায় ও সাক্ষাৎকার পর্বে সব্যসাচী চক্রবর্তী শুনিয়েছেন তার নানা অভিজ্ঞতার গল্প।

কেমন করে এমন হলেন সব্যসাচী

এক সাক্ষাৎকারে সব্যসাচী চক্রবর্তী বলেন, ‘আমি আগাগোড়া একজন মিস্ত্রি ছিলাম। আমার কাজ ছিল হাতুড়ি, স্ক্রুড্রাইভার, ছেনি, মাল্টিমিটার, সোলডারিং আয়রন এগুলো নিয়ে। আমি জীবনে কখনো শিল্পী হতে চাইনি। আমাকে জোর করে শিল্পী করে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য আমার পিসেমশাই এবং বাবা দুজন দায়ী। আমি মিস্ত্রি হতে চেয়েছিলাম, মিস্ত্রির কাজই করতাম। ক্যামেরা, এডিটিং, সাউন্ডের কাজ করতাম। তারা বললেন, এসব করার লোক অনেক আছে, তুমি অভিনেতা হয়ে যাও। তাদের কথামতো অভিনয় শুরু করলাম। তবে আমার মনে-প্রাণে ইচ্ছা ছিল লোকে যেন আমাকে বর্জন করে এবং লোকে বলে খুব খারাপ হচ্ছে। কিন্তু সেটা হলো না। হলো উল্টো। সবাই পছন্দ করে ফেলল, তাই আর বেরুতে পারলাম না। ছোটবেলায় আমার ইচ্ছা ছিল হয় ডাক্তার হব, না হয় ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট বা পুলিশ। কিছুই হতে পারিনি।’

সবার প্রিয় বেনু দা, কে এই সব্যসাচী

সব্যসাচী চক্রবর্তী পশ্চিমবঙ্গের ছোটপর্দা এবং বড়পর্দার জগতে এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তার জন্ম ১৯৫৬ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর পূর্ব ভারতের কলকাতায়। তার বাবার নাম জগদীশ চন্দ্র চক্রবর্তী এবং মায়ের নাম মনিকা চক্রবর্তী। ছোটবেলা থেকেই তাকে আদর করে ‘বেনু’ বলে ডাকেন বাবা-মা। সিনেমার জগতের মানুষেরাও ভালোবেসে তাকে এই নামে সম্বোধন করেন। ১৯৭৫ সালে সব্যসাচী দিল্লির এন্ড্রু কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। দিল্লির বিখ্যাত হংস রাজ কলেজ থেকে বিএসসি ডিগ্রি নেন। ১৯৭৮ সালে তিনি দিল্লিতে এএমআই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অভিনয় ছাড়াও প্রকৃতি-পরিবেশের প্রতি তার অসীম ভালোবাসা। একজন ভালো মানের ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফারও তিনি।

সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা ও অন্যান্য

১৯৯২ থেকে সমান তালে অভিনয় করে আসছেন সব্যসাচী চক্রবর্তী। ছোট পর্দা ও বড় পর্দা সব খানেই সমান জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। প্রথম সাড়া ফেলেন জোছন দস্তিদারের সোনেক্সের তেরো পার্বন সিরিয়ালে অভিনয় করে। পশ্চিমবাংলার ঘরে ঘরে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন ওই সিরিয়ালের কল্যাণে। এরপর ‘রুদ্রসেনের ডায়েরি’ টেলিসিরিয়ালে প্রথম গোয়েন্দা চরিত্রের অভিনয় করেন তিনি। পরে বাঙালি গোয়েন্দা চরিত্রের এক অন্য অসাধারণ চরিত্র হয়ে ওঠেন। সব্যসাচীর সব থেকে উল্লেখযোগ্য কাজ সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা। সন্দীপ রায়ের বাক্স রহস্য টেলিফিল্ম এবং ফেলুদার উপর টেলিফিল্ম সিরিজে অভিনয় করার পর তিনি ফেলুদার ভূমিকায় বোম্বাইয়ের বোম্বেটে সিনেমায় অভিনয় করেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অসাধারণ ফেলুদা চিত্রায়নের পরেও তাকে বাঙলি দর্শক ফেলুদা হিসাবে যথেষ্ট সমাদরের সাথে গ্রহণ করেছে। সব্যসাচী বলিউডের কিছু হিন্দী সিনেমায় অভিনয় করেছেন। দিল সে, খাকি, পরিণীতা, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সব্যসাচী

শুধু ভারতেই নয়, বাংলাদেশেও ভীষণ জনপ্রিয় সব্যসাচী। অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রেও। শিকারি (২০১৬), নবাব (২০১৭), গণ্ডি (২০২০) চলচ্চিত্রগুলো দেখেছেন অনেকেই। সর্বশেষ বাংলাদেশের ‘জ্যাঁ কুয়ে ১৯৭১’ সিনেমায় অভিনয় করেছেন সব্যসাচী। এই সিনেমার প্রিমিয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশে এসে সব্যসাচী বলেন, আগেও অনেকবার বাংলাদেশে এসেছি, এবারই প্রথমবার আসা নয়। প্রত্যেকবার যেমন ভালো লেগেছে, এবারও তেমনি লাগছে। বাংলাদেশ বরাবরই আমার ভালো লাগে। প্রথমবার দর্শকদের সঙ্গে সিনেমা প্রায় সব কটিই দেখেছি। তবে হ্যাঁ, আমার অভিনীত ‘জ্যাঁ কুয়ে ১৯৭১’র বাংলাদেশ প্রিমিয়ার শো প্রথমবার হলভর্তি দর্শকের সঙ্গে দেখা হলো। ভালো লেগেছে। তবে এই ছবিটির গুরুত্ব হচ্ছে, ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যারা প্রভাবিত হয়েছিল, যারা বিপদে পড়েছিল, যারা শরণার্থী হয়েছিল, সেই তাদের বাচ্চারা যখন না খেয়ে থেকেছিল তখন ভারত সরকারও চেষ্টা করেছিল তাদের রিহ্যাবিটেশন করার। কিন্তু যথেষ্ট করে উঠতে পারেনি। সে জন্য সেই অবস্থাটা দেখে এই ফরাসি ভদ্রলোক বলেছিলেন, আমার কুড়ি টন ওষুধ আর খাবার চাই, যেটা বাচ্চাদের সুস্থ রাখবে। বাংলাদেশের যে অবস্থায় জন্ম সেই অবস্থায় যাতে না যেতে হয় সেটারই কামনায়, প্রার্থনায় এ ছবিটি।’

বাংলাদেশের ফিল্ম নিয়ে সব্যসাচী বলেন, ‘বাংলাদেশে ভালো ভালো ফিল্ম হচ্ছে, ইদানীংকালে আরও বেশি। যেগুলো ওটিটিতে আসছে। বড়পর্দার জন্য তেমনভাবে ছবি তৈরি হচ্ছে না। আর হলেও খুব কম।’

অভিনয় ছাড়ার ঘোষণা

সম্প্রতি অভিনয় ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন সব্যসাচী চক্রবর্তী। নানা কারণে আর অভিনয়ের সঙ্গে থাকতে চান না এই অভিনেতা। এই বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখন মনে হচ্ছে যথেষ্ট হয়েছে, আর না। আমি তো অমিতাভ বচ্চন, রজনীকান্ত, ব্রাডপিট কিংবা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নই। তাই জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত অভিনয় করে যাওয়ার কারণ নেই। আমি অলরেডি ঘোষণা দিয়েছি আর অভিনয় করব না। অনেক পরিচালক এসেছেন তাদের না করে দিয়েছি। আমার আর অভিনয়ে ফেরার সম্ভাবনা নেই। যদিও এ রকম সিদ্ধান্তে পরিবারের মানুষ অসন্তুষ্ট। এখন লেখালেখি নিয়ে সময় কাটাব। এ ছাড়া অনেক কাজ আছে। অবসরে ঘরের কাজ করব, ঘরের বাসন মাজব, নিজের জুতা পলিশ করব, নিজের আলমারি গোছগাছ করব। আমার স্ত্রীকে সহযোগিতা করব। আমি এখন অনেক জায়গায় বেড়াতে যেতে পারছি। আমার ছবি তোলার অভ্যাস ও ইচ্ছা আছে। সেটা অবশ্যই বন্য প্রাণীর, সেটা তুলব। টিভিতে খেলা দেখা, কম্পিউটারে ছবি এডিট করা আর বই পড়া তো আছেই। আমি আর কাজ করব না। আমার সময় শেষ। আমি এখন রিটায়ার। এখন অবসরপ্রাপ্ত।’

সব্যসাচীর পরিবার

১৯৮৬ সালে তিনি মিঠু চক্রবর্তীকে বিয়ে করেন; যিনি বাংলা টিভি জগতে একজন জনপ্রিয় মুখ। তাদের দুই ছেলে গৌরব ও অর্জুন। তারও অভিনয় করেন। আগামী দিনের মেধাবী অভিনেতা হিসেবেই হয় তো সাক্ষর রাখবেন তারা।

সব্যসাচী অভিনীত জনপ্রিয় বাংলা সিরিয়াল

সব্যসাচী অভিনীত জনপ্রিয় বাংলা সিরিয়ালগুলোর মধ্যে আছে ‘তেরো পার্বণ’, ‘সেই সময়’, ‘একাকী অরণ্যে’, ‘উডনচন্ডী’ ও ‘দ্বিরাগমন’।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

5 × 3 =