মুক্তিযুদ্ধের আধুনিক উপস্থাপনা ‘১৯৭১ সেই সব দিন’

নূর জাহান

হৃদি হক পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘১৯৭১ সেই সব দিন’ মুক্তি পেয়েছে ১৮ আগস্ট। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে গুণী অভিনেতা ইনামুল হকের গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে ২ ঘণ্টা ২৭ মিনিট দৈর্ঘ্যরে সিনেমাটি। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে মুক্তিযুদ্ধের গল্পে নির্মিত সিনেমায় সবসময়ই উঠে এসেছে গ্রামীণ জীবন। শহুরে জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখা গেছে খুবই কম। হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ সিনেমায় দেখা গেছে অবরুদ্ধ ঢাকা। নির্মাতা হৃদি হক ‘১৯৭১: সেই সব দিনগুলি’ সিনেমায় শহুরে জীবনের প্রতিচ্ছবিকে তুলে আনলেন রূপালি পর্দায়।

গল্প

বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ‘১৯৭১ সেই সব দিন’ সিনেমার গল্প মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরেই। নির্মাতা হৃদি হক বেছে নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শহরের মানুষের গল্প। ঢাকার শান্তিবাগ এলাকার ১৭ নাম্বার বাড়িকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে সিনেমাটি। মুক্তিযুদ্ধের সময় শহরের উত্তাল দিনগুলোর চিত্রায়ণ করা হয়েছে। এছাড়াও সিনেমায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সাংস্কৃতিক জগতের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। সিনেমায় দেখা গেছে প্রেম আবার কখনো দেখা গেছে পরিবারের প্রতি মায়া। দেখা গেছে দেশ স্বাধীন করার জন্য সবকিছু ত্যাগ করার ইচ্ছা।

চিত্রনাট্য

হৃদি হক অভিনেতা ইনামুল হকের মেয়ে। বাবার লেখা গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি। ‘১৯৭১ সেই সব দিন’ সিনেমার কাহিনীকার ইনামুল হক। সিনেমার চিত্রনাট্য সাজিয়েছেন নির্মাতা নিজেই। চিত্রনাট্য নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয় সিনেমার স্টার্টিংয়ের কথা। শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যে সিনেমার প্রতিটি চরিত্রের সঙ্গে খুব সহজেই কানেক্ট করে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন নির্মাতা শক্ত চিত্রনাট্যের জন্য। চিত্রনাট্যে বেশি দুর্বলতা দেখা যায়নি। অনেক অভিনয়শিল্পী থাকলেও চিত্রনাট্যের জন্য সবাই গুরুত্ব পেয়েছে স্ব স্ব চরিত্রে। স্ক্রিন প্লে টানটান উত্তেজনায় ঘেরা ছিল না। কিন্তু কখনো একঘেয়েমি চলে আসেনি। এটাই বিগ অ্যাডভান্টেজ। ইমোশনাল কানেকশন ছিল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধের সিনেমায় এটাই সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল। কাব্যিক সংলাপ বিনিময় দেখা যায় সিনেমার বেশ কিছু সিকুয়েন্সে।

অভিনয়

মাল্টিকাস্টিং নির্ভর সিনেমা। প্রবীণ থেকে তরুণ একঝাঁক গুণী শিল্পীকে হাজির করেছেন নির্মাতা। বলতেই হয়, ‘১৯৭১ সেই সব দিন’ সিনেমাটি আর্টিস্ট নির্ভর সিনেমা নয়; এটি মূলত গল্প নির্ভর। গল্পটাই ছিল সিনেমার মূল নায়ক। সিনেমাটি একটি পরিবারের গল্প নিয়ে। পরিবারের সদস্যদের ভূমিকায় দেখা যায় ফেরদৌস আহমেদ, আব্দুল নূর সজল, লিটু আনাম, হৃদি হক, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, শিল্পী সরকার অপু, তারিন জাহান, আনিসুর রহমান মিলন, মৌসুমী হামিদ সহ আরো অনেককে। পরিবারের সবাইকে একসঙ্গে বেশ ভালো মানিয়েছে। বয়স ও চরিত্র অনুয়ায়ী পারফেক্ট সিলেকশন করেছেন নির্মাতা। ফেরদৌস আহমেদ বেশ ভালো করেছেন। লিটু আনাম রাফ অ্যান্ড কাট চরিত্রে বেশ ভালোভাবে মিশে গিয়েছেন। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় ও শিল্পী সরকার অপু বরাবরের মতোই ন্যাচারাল পারফরম্যান্স করেছেন। আনিসুর রহমান মিলনকে বহুদিন পর পর্দায় দেখে ভালো লাগলো। তারিন জাহান ভালো করার চেষ্টা করেছেন। অনেক সময় ওভার অ্যাকটিং করার প্রবণতা ছিল। আবদুর নূর সজল ও সানজিদা প্রীতির রসায়ন ছিল বেশ মধুর।

মামুনুর রশীদ, আবুল হায়াত, মুনমুন আহমেদ, সাজু খাদেম, নাজিয়া হক অর্ষা, জুয়েল জহুর, গীতশ্রী চৌধুরী সকলেই স্ব স্ব চরিত্রে বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। গীতশ্রী চৌধুরীর কিছু সিকুয়েন্স দুর্দান্ত হয়েছে। আউটস্ট্যান্ডিং পারফরম্যান্স করেছেন কেউ তা বলার সুযোগ নেই। ফেরদৌস-হৃদি হক জুটির রোমান্স অনেক সময় জমে উঠেনি। হৃদি হকের চরিত্রে অন্য কাউকে দেখা গেলে মন্দ হতো না। চরিত্রটার সঙ্গে অনেক সময়ই তিনি পেরে উঠছিলেন না। চরিত্রের মাঝে যতটুকু ইমোশন কিংবা এক্সপ্রেশন দরকার ছিল তা তিনি করে দেখাতে অনেক সময়ই ব্যর্থ হয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা এতো স্টার কাস্টের সমাহারে সব চরিত্রকে স্বাভাবিকভাবে পোট্রে করার পারদর্শিতা দেখিয়েছেন হৃদি হক।

টেকনিক্যাল পার্ট

সিনেমার টেকনিক্যাল দিক দুর্দান্ত। সিনেমার কিছু শট খুবই ইউনিকভাবে নেওয়া হয়েছে যা চোখে আরাম দেয়। ক্যামেরা হাতে জুটি বেঁধে মুগ্ধ করেছেন মেহেদী রনি ও ফরহাদ হোসেন। সিনেমার আবহ সংগীত বেশ শ্রুতিমধুর হয়েছে। কলকাতার দেবজ্যোতি মিশ্র সংগীত পরিচালনার দায়িত্বটা পালন করেছেন খুবই যত্ন সহকারে। সিনেমার কালার গ্রেডিং বেশ ভালো হয়েছে। একদম চোখে লেগে থাকার মতো। এডিটিং চোখ বুঝে লেটার মার্ক পাবে। সিনেমার লোকেশনগুলো অন্য এক ঢাকার সঙ্গে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেবে। বারবার ইচ্ছে হবে এই জায়গাটা কোথায় জানতে! মনের অজান্তেই যেতে ইচ্ছে করবে। গল্পের প্রয়োজনে যেমন লোকশেন প্রয়োজন ছিল ঠিক তেমন লোকেশনের দেখা মিলেছে সিনেমায়।

সংগীত

সিনেমার প্রতিটি গানই শ্রুতিমধুর। গল্পের আবহের সঙ্গে মিল রেখে উর্দু ভাষার গানও রাখা হয়েছে সিনেমায়। সিনেমার শুরুতেই ‘যাচ্ছো কোথায়’ শিরোনামের গানটি শোনা যায়। কামরুজ্জামান রনি ও ইশরাত এ্যানীর দ্বৈতকণ্ঠে গানটি লিখেছেন নির্মাতা হৃদি হক। সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন দেবজ্যোতি মিশ্র। গানের দৃশ্যায়নে সজল-প্রীতির রসায়ন আর মিষ্টি কণ্ঠে গানটি পরিপূর্ণ রূপ ধারণ করে। ‘ইয়ে শামে’ শিরোনামে উর্দু ভাষার গানটির মিউজিক্যাল আয়োজন বেশ ছিল। এছাড়া আবেগঘন মুহূর্তে বেশকিছু গানের ব্যবহার দেখা যায়; যা পারফেক্ট সিলেকশন হয়েছে। সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে ‘ও আমার দেশের মাটি’ শোনা যায়। আবার জাতীয় সংগীত ব্যবহার করে অন্যরকম অনূভুতি জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন নির্মাতা।

নির্মাণ

অনুদানের সিনেমা মানেই অখাদ্য হয়, এমন ধারণা তৈরি হবে না ‘১৯৭১ সেই সব দিন’ সিনেমাটি দেখার সময়। নির্মাতা হৃদি হক প্রথম সিনেমায় নিজের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন বলতেই হয়। দেশপ্রেম আর মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলেছেন নতুন ভঙ্গিতে, যা দর্শকদের তৃপ্তি দিয়েছে। সিনেমার প্রতিটি ডিপার্টমেন্টে যত্ন সহকারে কাজ করেছেন। হৃদি হক মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা আগে যেভাবে হয়েছে ঠিক সেভাবে করতে চাননি। তিনি নতুনত্ব এনেছেন সিনেমা জুড়ে। নির্মাণের দিক থেকে সিনেমাটি লেটার মার্ক পাবে।

আমরা যত এগিয়ে যাচ্ছি আশেপাশে ততই আধুনিকতার ছোঁয়া দেখা যাচ্ছে। শহর থেকে গ্রামে সবখানে পৌঁছে গিয়েছে আধুনিকতা। মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল ও আবহ ফুটিয়ে তোলা আসলেই কষ্টসাধ্য। কেননা এখন প্রায় সব গ্রামেই দেখা যায় পাকা রাস্তা, পাকা বাড়ি। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা নির্মাণ করা আসলেই চ্যালেঞ্জের বিষয়। হৃদি হক এই চ্যালেঞ্জ সফলভাবে উতরে গিয়েছেন। সবকিছুর মিশেলে তিনি পরিণত একটি কাজ উপহার দিয়েছেন দর্শকদের।

নেগেটিভ দিক

সিনেমায় নেগেটিভ দিক তুলনামূলক কম। সিনেমার রানটাইম খানিকটা কমিয়ে আনলে মন্দ হতো না। সবগুলো চরিত্রের শেষ গন্তব্য কোথায় হলো তা দেখানো গেলে ভালো হতো। অপারেশনের দৃশ্যগুলো আরেকটু যত্ন সহকারে করা যেতো।

পজিটিভ দিক

সিনেমার গল্প অন্য পাঁচটি মুক্তিযুদ্ধের ছবির মতোই। যেখানে থাকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই। চেনা-জানা গল্পকে ভিন্নভাবে বলতে পারাটাই মুখ্য বিষয়। এ ছবিতে সেটাই ঘটেছে। এখানেই নির্মাতার সার্থকতা। তিনি ভিন্ন কিছু করে দেখাতে পেরেছেন। মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত তারিখ অনুযায়ী সবকিছু খুব পরিকল্পনা মাফিক তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের বেশিরভাগ সিনেমা গল্প-উপন্যাস থেকে নির্মিত হয়েছে। কিন্তু ‘১৯৭১: সেইসব দিন’ ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের গল্পকে সাহিত্য-সংস্কৃতির মিশেলে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী নাটক ‘রক্তকরবী’র রঞ্জন, নন্দিনী, রাজা চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে নাটকে যে মুক্তির চেতনা রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন তার সাথে মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার চেতনাকে একাত্ম করা হয়েছে। নজরুলের গান, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা’ ছবিটিতে নতুন মাত্রা এনেছে। বলতেই হয়, মুক্তিযুদ্ধের সিনেমায় এটি নতুন একটি সংযোজন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সিনেমালোজি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

16 − 10 =