লিটল বয় ফ্যাটম্যান

মাহবুব আলম

লিটল বয় বলতে আমরা বুঝি কিশোর বয়সের পিচ্চি স্বভাবের কোনো লাজুক বালক। মা-খালা আর ফুফুদের নেওটা। আবার কখনো মনে হয় ভীষণ চঞ্চল একটু দুষ্টু দূরন্ত স্বভাবের কোনো বালক। যে পড়ার সাথী আর স্কুল বন্ধুদের সাথে দুরন্তপনা করে ঘরে ফেরে। আর ঘরে ফিরে পুরো ঘর, পুরো বাড়ি তোলপাড় করে। কখনো কখনো পুরো পাড়ায় হুলুস্থুল কাণ্ড বাধিয়ে বসে। আবার কখনো চাহিদা মতো কিছু না পেয়ে রাগে ফোঁসে। এসব দেখে মা-খালারা অভ্যস্ত হয়ে গেলেও বাবার চিন্তা বাড়ে। এই ছেলে কোন দিন কি না কি করে বসে। বাবার এই দুশ্চিন্তা নিছক কোনো ঘটনা নয়। যখন বাড়ি ফেরার পথে প্রতিবেশীরা বলে, তোমার ছেলেটা ভারি দুষ্টু হয়েছে। ইদানিং প্রায়ই পাড়ার ছেলেদের সাথে মারপিট করে। যান বাড়ি গিয়ে দেখেন, আজ মার খেয়ে ঘরে ফিরেছে। দেখলাম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। আবার মা-খালারা বলে, ছেলেটা কেমন যেন হয়েছে। একেবারে ঘর কুনো। আত্মীয়-স্বজন আসলে ঠিকমতো কথা বলে না। ও ভীষণ লাজুক স্বভাবের। এই তো হলো লিটল বয়, ছোট ছেলে।

একইভাবে ফ্যাটম্যান বলতে আমরা বুঝি বেশ মোটাসোটা একটা মানুষ। যে বেশি বেশি খায়, বেশি বেশি ঘুমায় আর হাঁটাহাঁটি না করে সবসময় রিকশা, বাস বা গাড়িতে চলাচল করে। রিকশায় চড়লে পাশে বসার কোনো জায়গা থাকে না। বাসে একজনেরই দুই সিট লাগে, আর বিমানের সিটে স্থান সঙ্কুলান হয় না। সবাই তার দিকে তাকিয়ে দেখে। বিমানবালারাও মুচকি হাসে। আর ব্যায়াম? এর ধারে কাছেও নেই। তারপরও বলে যে, ভুড়িটা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। কি যে বলবো কালকে রাতে খাওয়াটা বেশ জম্পেস হয়েছে। গরুর মাংসের সঙ্গে মাত্র দুই পিস রুই মাছ আর মাত্র একটা রোস্ট কিন্তু ঠিক হয়নি। আরো কয়েক পিস মাছ আর কয়েক পিস রোস্ট হলে ভালো হতো। এই যা।

এই মানুষগুলো ভুঁড়ি এলিয়ে হেলে দুলে থপাস থপাস করে হাঁটে। এদের হাঁটার সময় পাশের সব মানুষজন না তাকিয়ে পারে না। অনেকে আবার স্বগতোক্তি করে বলে, এই মোটা মানুষগুলো খুব হাসিখুশি আর প্রাণচঞ্চল হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এদের সাদা মনে কালো দাগ থাকে না। থাকবে কি করে? এরা তো খাওয়া ছাড়া আর কিছু ভাবতেই সময় পায় না।

লিটল বয় যখন দাগি চোর, জেল ফেরত আসামি আর ডাকাত রানির ঘরে বড় হয় তখন কিন্তু লিটল বয় ছোট ছেলেটি আর ছোটদের মতো থাকে না। বরং আচরণে সে দুরন্ত নয় হিংস্র হয়ে ওঠে। নেকড়ে হায়েনার মতো হিংস্র হয়ে ওঠে। একইভাবে কোনো ফ্যাটম্যান মোটা মানুষ যখন হিংস্র পরিবেশে বড় হয় তখন দানব হয়ে ওঠে। আবার সেই দানবকে যদি মার্কিন প্রশাসন আশ্রয়-প্রশ্রয় ও লালন-পালন করে তাহলে তো কথাই নেই। তবে এই লিটল বয় ও ফ্যাটম্যান মনুষ্য প্রজাতির নয়। এই লিটল বয় ও ফ্যাটম্যান হচ্ছে, বিজ্ঞানাগারে তৈরি দানব মারণাস্ত্র। প্রাণঘাতী মারণান্ত্রের নাম লিটল বয় আর ফ্যাটম্যান দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পুরো মানবজাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছে। যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বালক ও মোটা লোকদের লজ্জায় ডুবিয়েছে।

আর তাই তো বিশ্ব দেখল, লিটল বয় আর ফ্যাটম্যান মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে গুঁড়িয়ে ধূলিসাৎ করে দিল জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরকে। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকালের এক রোদ্রোজ্জ্বল দিনে যখন হিরোশিমার মানুষ স্কুল-কলেজ অফিস-আদালত মুখী হয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলছে, ঠিক সেই সময় ৮টা ১৫ মিনিটে শহরের বুকে নেমে এলো দানবীয় থাবা। হয়ে গেল মহাপ্রলয়। মার্কিন বিমানবাহিনীর এনোলা গে নামের একটি বোমারু বিমান শহরে ঢুকে আকাশ থেকে ছুঁড়ে মারলো লিটল বয়কে। ১০ ফুট দৈর্ঘ্যরে ৪৪০০ কেজির এই আণবিক বোমা লিটল বয় ভূমিতে পড়তে সময় নেয় মাত্র ৫৭ সেকেন্ড। মুহূর্তেই আগুনের বিশাল কুণ্ডলি পাকিয়ে বিস্ফোরণ ঘটালো। এই বিস্ফোরণের মাত্রা ছিল ১৩ কিলোটন টিএনটির সমান। এটা দেখে বিমানের পাইলট কর্নেল পল লিবার্টিস বলে উঠলেন, ‘হায় ঈশ্বর, আমরা কি করলাম।’ কিন্তু ততক্ষণে ধ্বংসযজ্ঞ আর মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছে। সরকারি হিসাবে বলা হয়, তাৎক্ষণিকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ। পরে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৩৭ হাজার। আর নিমিষেই গুঁড়িয়ে মাটির সাথে মিশে যায় পুরো শহর।

লিটল বয় আর ফ্যাটম্যানের যখন অভিভাবক বাবা-মা মার্কিন প্রশাসন আর তার প্রধান প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান তখনতো এই অবস্থাই হবে। চেঙ্গিস খানের উত্তরসূরী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান এই ধ্বংসযজ্ঞ আর হত্যাকাণ্ড দেখে কর্নেল পলের মতো বিবেকের দংশন অনুভব করেননি। বরং খুশি হয়ে আনন্দের সঙ্গে আরও একটি বোমা বর্ষণের নির্দেশ দেন। এবার আর লিটল বয় নয়। এবার নির্দেশ দেন ফ্যাটম্যান বর্ষণের।

মার্কিন বোমারু বিমান বি২৯, ৯ আগস্ট জাপানের নাগাসাকি শহরের আকাশসীমায় ঢুকে ফ্যাটম্যান নামের একটি আণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। ১০ ফুট ৭ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও ৫ ফুট ব্যাসার্ধের এই ফ্যাটম্যানের ওজন ছিল ৪ হাজার ৬৩৩ কেজি। আর এর ধ্বংস ক্ষমতা ছিল ৭৫ মিলিয়ন ডিনামাইটের সমতুল্য। তেজস্ক্রিয় প্লুটেনিয়াম ২৯৩ দিয়ে তৈরি এই বোমা নিক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ৭৪ হাজার মানুষ। পরে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৫ হাজার। সেইসাথে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় নাগাসাকি শহরটি। আর এই বোমাবর্ষণে আহত হয়ে চিরতরে পঙ্গু বা প্রতিবন্ধীতে পরিণত হয় ২ লাখ ৫১ হাজার ৮৩৪ জন (দুই শহরের হিসাব)। এই হিসাব সেই সব আহতদের যারা আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেননি। ওরা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ধুঁকে ধুঁকে মরেছে। এদের জাপানি ভাষায় বলা হয় হিবাকুশ। এই হিবাকুশদের এখনো কেউ কেউ জীবিত আছেন। যারা জনসম্মুখে আসেন হিরোশিমা দিবসের আগে ও পরে।

কেন এই মানবতাবিরোধী বর্বর হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আজও দেয়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানের আত্মসর্মপণের পেছনে এই বোমাবর্ষণের ভূমিকা, এর প্রতিক্রিয়া ও যৌক্তিকতা অনস্বীকার্য। তবে এই নিয়ে তীব্র মতভেদ ও বিতর্ক আছে। কারণ এই বোমাবর্ষণের বেশ কয়েক মাস আগে কার্যত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে হিটলারের আত্মহত্যা ও বার্লিনের পতন এবং সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে জার্মানির নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে।

উল্লেখ্য, বার্লিনের পতন নিশ্চিত বুঝতে পেরে হিটলার ৩০ এপ্রিল একটি বাংকারে ঢুকে আত্মহত্যা করেন। এরপর মাত্র তিন দিনের মাথায় বার্লিনের পতন হয় রুশ লাল ফৌজের হাতে। বার্লিন সামরিক বাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পন করে বার্লিন শহরকে তুলে দেয় রুশ সেনাদের হাতে। এরপর তো ইতিহাস। ৮ মে মধ্যরাতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জোসেফ স্তালিনের নির্দেশে মার্শাল ঝুকভের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে জার্মান বাহিনী। এর মধ্য দিয়ে ইউরোপে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। তবে এশিয়ায় জাপান যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। কিন্তু রুশ বাহিনী মাঞ্চুরিয়া দখল করলে জাপান কার্যত হতাশ হয়ে যুদ্ধ থামানোর জন্য গোপনে চিঠি চালাচালি শুরু করে। তাই তো জাপান আজও বলে, হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা বর্ষণ অপ্রয়োজনীয় ছিল। কেননা যুদ্ধ থামানোর জন্য তারা গোপনে কাজ করে যাচ্ছিল।

কিন্তু তারপরও কেন বোমা বর্ষণ? কারণ যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিমত্তা প্রদর্শন। সারা দুনিয়ার প্রতি এক ধরনের ভীতি প্রদর্শন। বিশেষ করে উদীয়মান পরমাণু শক্তি সোভিয়েত রাশিয়াকে ভীতি প্রদর্শন। সেই সাথে এটা ইয়ালটা চুক্তি অনুযায়ী মাঞ্চুরিয়া দখলের পর সোভিয়েত রাশিয়াকে জাপান আক্রমণ থেকে বিরত রাখা। এবং বিনা উস্কানিতে পোর্ট পার্ল হারবারে জাপানের হামলার প্রতিশোধ ও জাপানকে উচিত শিক্ষা দেওয়া। এক কথায় যুক্তরাষ্ট্রের পরাশক্তি হয়ে ওঠার অভিষেক পর্বে নব্য সাম্রাজ্যবাদের হিংস্রতার একটা নমুনা প্রদর্শন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: রম্য রচনা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

20 + 9 =