সেফটি পিনের বয়স ১৭৪ বছর

গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত

দৈনন্দিন জীবনযাপনে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের প্রয়োজন পড়ে যা দেখতে ক্ষুদ্র হলেও তার প্রয়োজনীয়তা অনেক। তেমনি একটি প্রয়োজনীয় জিনিস হলো সেফটি পিন। আপনি জানেন কী সেফটি পিন আবিষ্কার হয়েছিল ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে! আকারে ছোট্ট কিন্তু অতি প্রয়োজনীয় এই বস্তুর উদ্ভাবনের স্মরণে প্রতিবছর ১০ এপ্রিল আন্তর্জাতিক সেফটি পিন দিবস পালিত হয়। আজ থেকে ১৭৪ বছর আগে ১৮৪৯ সালে উদ্ভাবিত হয় সেফটি পিন।

সেফটি পিন শব্দটা শুনেই বোঝা যাচ্ছে সুরক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয়। ভেঙে বললে সেফটি ও পিন। নারীদের ফ্যাশনের ক্ষেত্রে সেফটি পিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। নারীরা ব্লাউজের সঙ্গে শাড়ি আটকাতে কিংবা জামার সঙ্গে ওড়না আটকাতে আবার হিজাব পরিধানের ক্ষেত্রে প্রতিদিনই সেফটি পিন ব্যবহার করে থাকে। এজন্যই সেফটি পিনের আদি নাম ছিল ‘ড্রেস পিন’। কীভাবে এই ছোট জিনিসটি নারীদের দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠলো তা জানানোর চেষ্টা করবো আমরা আজ।

সেফটি পিন মূলত একটি ইংরেজি শব্দ। যার সমার্থক অর্থ হলো আবদ্ধক ও সুরক্ষা আবদ্ধক। সেফটি পিনে একটি বা দুটি দণ্ডের তৈরি একটি লুপ থাকে এবং অন্যপাশে একটি সূচালো দণ্ড থাকে যেটিকে প্রয়োজন মাফিক খোলা ও বন্ধ করা যায়। সেফটি পিন মূলত বিভিন্ন অংশকে একসাথে আবদ্ধ করে রাখতে ব্যবহার করা হয়।

জানা যায়, ১৮৪৯ সালে ওয়াল্টার হান্ট নামের এক ভদ্রলোক প্রথম তৈরি করেছিলেন সেফটি পিন। তিনি ছিলেন একজন আমেরিকান যন্ত্রকৌশলী। ছোটখাটো জিনিস উদ্ভাবনের জন্য ওয়াল্টার হান্ট বেশ পরিচিত ছিলেন। ওয়াল্টার হান্ট একসময় বেশ ঋণগ্রস্ত ছিলেন এবং ঋণ পরিশোধ করার জন্য তিনি নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার করার পরিকল্পনা করলেন। ওয়াল্টার হান্ট তার এক বন্ধুর কাছ থেকে ১৫ ডলার ধার করেছিলেন। তিনি কিছুতেই সে ধার শোধ করতে পারছিলেন না। পরিকল্পনা করলেন এমন কিছু একটা তৈরি করা যায় কি না, যার উপার্জিত অর্থ দিয়ে ধারটা শোধ করা যায়। একপর্যায়ে লম্বা তারের টুকরা বেঁকিয়ে সেফটি পিনের আকারের একটা জিনিস তৈরি করে ফেললেন। যার মাথার দিকটায় লাগিয়ে দিলেন একটা খাপ, যাতে শরীরে আঘাত না লাগে। সেখান থেকেই তৈরি হয়ে গেল সেফটি পিন।

প্রশ্ন আসতেই পারে ওয়াল্টার হান্ট কীভাবে সেফটি পিন তৈরি করলেন? ঋণ পরিশোধ নিয়ে চিন্তিত ওয়াল্টার হান্ট একদিন দেখলেন স্ত্রীর পোশাকের বোতাম ভেঙে গিয়েছে এবং তা ঠিক করার জন্য বোতামের পরিপূরক হিসেবে তিনি একটি লম্বা তারের টুকরো আড়াআড়ি দুবার বাঁকালেন এবং যাতে গায়ে আঘাত না লাগে তার জন্য মাথায় খাপ বসালেন। এটি তৈরি হওয়ার পর তিনি বুঝতে পারলেন এটি সকলের কাছে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ১৮৪৯ সালের ১০ এপ্রিল তিনি পেটেন্ট করিয়ে নিলেন।

সেই পেটেন্ট বিক্রি করে পেলেন ৪০০ ডলার। এই অর্থের বিনিময়ে তিনি তার ঋণ পরিশোধ করেন। তার কিছুদিন পর সেফটি পিন বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হলে তিনি লাখ লাখ ডলারের মালিক হয়ে ওঠেন। সেফটি পিন যুক্ত কলম, ছুরি ধারালো করার টুল, স্পিনার সহ নানান দরকারি জিনিসও তৈরি করেছিলেন তিনি। এমনকি একটি সেলাই মেশিনও বানিয়েছিলেন ওয়াল্টার হান্ট।

ওয়াল্টার হান্টের এই আবিষ্কারকের নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তাদের মত অনুযায়ী, খ্রিষ্টপূর্ব ১৩০০ থেকে ১৪০০ শতকের সময় গ্রিসের পেলোপন্নীয়াসরা ফিবুলা ও ব্রোচ (রূপক কাঠি) ব্যবহার করতো। যেটিকে সেফটি পিনের পূর্বসূরী হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই আধুনিক সেফটি পিন সকলের কাছে সহজলভ্য হওয়ার পিছনে ওয়াল্টার হান্টের আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

বর্তমানে শিশুদের ব্যবহারের জন্য আমরা যেসব অল ইন ওয়ান ডায়াপার দেখতে পাই; ঊনিশ শতকেও কিন্তু আমেরিকা ও ইউরোপে এরকম ডায়াপার ব্যবহার করা হতো। যার নাম ছিল ফ্ল্যাট। এই ফ্ল্যাটকে অল ইন ওয়ান ডায়াপারের পূর্বসূরি হিসেবে ধরা হয়। ফ্ল্যাটগুলো প্রথমে আটকানো থাকতো পিন দিয়ে। তবে ১৮৪৯ সালের পর থেকে সেফটি পিন দিয়ে কাজটি করা হয়। কারণ পিনে যেহেতু খাপ থাকে না তাই সহজে খুলে যায় এবং গায়ে আঘাত লাগার সম্ভাবনা থাকে। সেফটি পিনে সেটির সম্ভাবনা থাকে না। ঊনিশ শতকে ইউরোপ এবং আমেরিকা নারীরা যে ধরনের পোশাক পরিধান করতো তাতে পিনের মতো কিছুর প্রয়োজন হতো। সে জায়গা পূরণ করে সেফটি পিন।

সেফটি পিন তখন এতোটাই জনপ্রিয়তা পায় যে ১৯৯৪ সালে ইতালিয়ান ফ্যাশন ডিজাইনার জিয়ান্নি ভার্সেসে ব্রিটিশ অভিনেত্রী এলিজাবেথ হার্লের জন্য বিশেষ একটি সেফটি পিন ডিজাইন করেন। সেফটি পিন শুধু ফ্যাশন মঞ্চের রঙিন দুনিয়া কিংবা ইউরোপ-আমেরিকার মডেলদের জন্য নয়। আমাদের দেশের সাধারণ নারীরা প্রতিদিন ব্যবহার করে চলেছেন সেফটি পিন।

ফ্যাশনজগতে সেফটি পিন আইকন হয়ে ওঠে বেশ পরে। ১৯৭০ সালের দিকে। সেফটি পিন ফ্যাশন জগতে জনপ্রিয় করে তোলায় বিশেষ অবদান রাখে পাংক রক শিল্পীরা। পাংক রক হলো একটি রক আন্দোলন যা বিভিন্ন রক ব্যান্ড একযোগে গান গেয়ে আন্দোলন করে। পাংক রক শিল্পীদের অনেকেই ফ্যাশনের জন্য সেফটি পিন ব্যবহার করতেন। এ ছাড়া বিভিন্ন পোস্টারেও সেফটি পিন ব্যবহার করে গেছেন তারা। পাংক রক এবং সেফটি পিনের কথা উঠলেই উঠে আসে সত্তরের দশকের বিখ্যাত ব্যান্ড ‘সেক্স পিস্তল’-এর কথা। মূলত এই গানের দলটি সেফটি পিনকে ফ্যাশনের জগতে প্রতিষ্ঠা করে গেছে। ব্রিটিশ এই পাংক রক ব্যান্ডের ‘গড সেভ দ্য কুইন’ শিরোনামের একটি গানে ব্যান্ডের মেইন ভোকালিস্ট জনি রেটনের অনেকগুলো সেফটি পিন দেওয়া একটি শার্টের ছবি প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর থেকেই পাংক রক ঘরানার সংগীত শিল্পীদের মাঝে সেফটি পিনের ব্যবহার দেখা যায় বলে অনেকে মনে করে।

তবে জনি বেটনের অনেক আগে ৭০ দশকে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ডিজাইনার ভিভিয়ান ওয়েস্টউড তার নকশা করা পোশাকে সেফটি পিনের ব্যবহার করছেন; বিশেষ করে টি-শার্টে। এছাড়াও জান্ড্রা রোডস, জুডি ব্লেমের মতো ফ্যাশন ডিজাইনাররাও তাদের পোশাক ও গয়নায় সেফটি পিন ব্যবহার করেছিলেন। অনেকে ভাবতে পারেন হয়তোবা সেফটি পিনের ধারাবাহিকতা কিছুটা থমকে গেছে, তবে না বিশ্ব ফ্যাশন জগতে এই ধারা চলতে থাকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। স্টিফেন স্প্রাউস কিংবা জিন পল গালটিয়ারের মতো বিখ্যাত ডিজাইনাররা এবং বিশ্ববিখ্যাত অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা ফ্যাশন জগতে সেফটি পিনকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। সেই ধারাবাহিকতা বর্তমানেও চলমান। আজও বিখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ড ও ডিজাইনাররা সেফটি পিন ব্যবহার অব্যাহত রেখেছেন।

২০১৬-১৭ সালে বালেনসিগা, ভায়নেট ও সোনিয়া রাইকিয়েলের মতো বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনাররা তাদের পোশাকের কালেকশনে সেফটি পিনকে আবারও ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। ২০১৯ সালে সংগীতের সবচেয়ে বড় আয়োজন গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডে ব্রিটিশ গায়িকা ডুয়া লিপার পোষাকে সেফটি পিনের ব্যবহার দেখা যায়। পোষাকটি পরিধান করে পুরষ্কার নেওয়ার পর ফটোসেশন করেন। যা ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডে বেশ আলোচনায় আসে সেসময়। এছাড়াও বলিউডের জাহ্নবী কাপুর, অনন্যা পান্ডে, ক্যাটরিনা কাইফকে সেফটি পিন ড্রেসে দেখা যায়। আমেরিকান মডেল বেলা হাদিদকে একবার দেখা যায় সেফটি পিন ড্রেসে। তাকে একটি ক্রপড ডেনিম টপ পরতে দেখা যায় যেটিতে সিলভার সেফটি পিন ক্রস করা হয়েছে।

আরেক আমেরিকান মডেল জিজি হাদিদ একটি অনুষ্ঠানে ব্লেজার সুরক্ষিত করার জন্য বড় সোনার সেফটি পিন ব্যবহার করেছিলেন, যা ভিন্ন এক ফ্যাশন ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছিল। এছাড়াও নানান সময়ে হলিউড ও বলিউডের অনেক মডেল ও শিল্পীকে সেফটি পিন ড্রেস, সেফটি পিন ব্যাগ ও নানান ধরনের সেফটি পিন যুক্ত পোষাকে দেখা যায়। ছেলেদের পাংক সেফটি পিন জ্যাকেট ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডে বেশ জনপ্রিয় একটি পোশাক। মুসলিম দেশগুলোতে বোরকা ও হিজাবের স্তর সুসজ্জিত রাখতে সেফটি পিনের ব্যবহার দেখা যায়। ফ্যাশনের জন্য নারীরা শাড়ি পরার সময় সেফটিপিন ব্যবহার করে থাকে। বর্তমান সময়ে নানা ধরনের পোষাকে বাহারি ডিজাইনের সেফটি পিন দেখা যায়। এখন ফ্যাশনের ছোঁয়া লেগেছে সেফটি পিনের মধ্যেও। শিশুদের জন্যও বিশেষ ডিজাইনের সেফটিপিন রয়েছে বাজারে। প্রজাপতি, মৌমাছি, ফুল তার মধ্যে অন্যতম।

মার্কেটে এবং ফ্যাশন ব্রান্ডে বিভিন্ন ডিজাইনের সেফটি পিন চোখে পড়ে। বিভিন্ন সাইজের সেফটি পিন রয়েছে বাজারে। হাতের নাগালেই সেফটি পিন পাওয়া যায়। দাম কম হওয়ার ফলে সকলেই সহজে কিনতে পারে। সেফটি পিন যে শুধু কাপড়কে একসাথে আটকিয়ে রাখতে সাহায্য তা কিন্তু নয়। নারীদের সুরক্ষার জন্য সেফটি পিন ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে বিভিন্ন রকম ধাতুর সেফটি পিন এবং হরেক রকম ডিজাইনের সেফটি পিন পাওয়া যায়। বলতেই হয় সেফটি পিন ছোট্ট একটি বস্তু হলেও দৈনন্দিন জীবনে অনেক বড় উপকার করছে প্রতিদিন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আবিষ্কার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

7 − six =