খাদ্যরসিকদের পছন্দ বাকলাভা

হাসান নীল

দাওয়াতে বা ঘরোয়া আয়োজনে খাওয়ার শেষে মিষ্টি মুখ করাটা প্রচলিত রীতির মধ্যে পড়ে। এক সময় পায়েস কিংবা দই দিয়ে এ চাহিদা পূরণ করা হতো। গ্রাম বা মফস্বলে এখনও এসবের কদর আছে। তবে পাল্টে গেছে শহরের খাবার তালিকা। দই-মিষ্টির জায়গা দখল করে নিয়েছে মিষ্টিজাত দ্রব্য কিংবা ডেজার্ট। এগুলোর একটি হলো বাকলাভা। বাইরে ডিমের আবরণ, ভেতরে বাদাম কুচি এবং স্তরে স্তরে সাজানো মাখনে তৈরি এই খাবার সবার প্রিয়।

বাকলাভার ইতিহাস

বাকলাভার ইতিহাস জানতে হলে যেতে হবে প্রাচীন কালে। সেসময় থেকেই ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোতে যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, মোনাকো, ইতালি, মালটা, স্লোভেনিয়া প্রভৃতি) বাকলাভার রাজত্ব ছিল। এখনও ওইসব দেশের মানুষজনের কাছে এটি একটি ভালোবাসার নাম। তবে সময়ের সাথে সাথে ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোর গণ্ডি ছাড়িয়ে বাকলাভা ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন দেশে। সেইসঙ্গে বদলে গেছে এর ধরন। এছাড়া ডেজার্টটি তৈরির উপকরণের তালিকায় যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন উপাদান। ফলে স্বাদ ও গন্ধে বাকলাভায় এসেছে ভিন্নতা। তবে এই পেস্ট্রির মধ্যে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেছে অটোমন শাসনামলের বাকলাভা। সেসময় তৈরি এই পেস্ট্রির মধ্যে সেরা ছিল বলকান দেশগুলোর বাকলাভা। আজও ওই ডেজার্টগুলো স্বাদ-গন্ধে খ্যাতির শীর্ষে রয়েছে।

ফল ভর্তি ঝুড়ির দেশের

ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলো নানা ধরনের ফল ফলাদিতে ভরপুর। এ অঞ্চলকে ফলভর্তি ঝুড়িও বলা হয়ে থাকে। প্রায় সব ধরনের খাবারেই তারা গম, যব, বার্লি বা ভুট্টা, প্রচুর বাদাম আর ফল ব্যবহার করে থাকেন। বাকলাভাও এর ব্যতিক্রম নয়। এর বাইরে থাকে ময়দা ও ডিমের আস্তরণ। বাদামি রঙের মচমচে এই অংশের ভেতর থাকে নানা রকম বাদাম, কিশমিশ।

বাকলাভার উৎপত্তি

বাকলাভার উৎপত্তি নিয়ে রয়েছে নানা মত। তবে এর উৎপত্তি সম্পর্কে সবচেয়ে প্রাচীন তথ্যটির ওপরই জোর দেওয়া হয়। ঘটনাটি খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতকের। তখনকার দিনে আসিরিয়ানরা রুটিতে বাদাম ও মধু মিশিয়ে সেঁকে খেত। ধারনা করা হয়, বাকলাভার উৎপত্তি মূলত সেখান থেকেই। পরে পঞ্চদশ শতকে অটোমান শাসকরা ইস্তাম্বুল দখল করে নেয়। ইস্তাম্বুলের তৎকালীন নাম ছিল কনস্টান্টিনোপল। দখলদার অটোমানদের অভ্যাস ঐতিহ্যও ভর করে দেশটির ওপর। ফলে ইস্তাম্বুলের রান্নাঘরে জায়গা করে নেয় বাকলাভাসহ অটোমানদের হরেক রকম খাবার। ফাতিহ সময়ের টপকাপি প্যালেসের রসনার নোটবুকে সেই সময়ে বাকলাভা-সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যায়। বইটিতে উল্লেখ আছে, সমাজের ধনাঢ্য শ্রেণিদের আপ্যায়নে জুড়ি ছিল না এই পেস্ট্রি জাতীয় খাবারের।

শাহী বাকলাভা অন্যতম

বাকলাভার মধ্যেও রয়েছে শ্রেণিভেদ। তালিকার শীর্ষে রয়েছে শাহী বাকলাভা। এটি সাধারণত রাজা বাদশাহদের জন্য তৈরি করা হতো। রাজ বাবুর্চিরা খুব যত্ন করে তৈরি করতেন শাহী বাকলাভা। তৈরির সময়ে সৃজনশীলতার পাশাপাশি স্বাদ অক্ষুণ্ন আছে কি না পরখ বিশেষ করতেন বিশেষ কৌশলে। কৌশলটি আমাদের নিছক মজার মনে হলেও তাদের কাছে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পরীক্ষার জন্য রন্ধনশিল্পীরা ব্যবহার করতেন সোনার মুদ্রা। তারা বাকলাভা’র ময়দার তৈরি পাতলা ফিলোগুলোর আধা মিটার উঁচু থেকে সোনার কয়েন ফেলতেন। কয়েনটি লম্বালম্বিভাবে ট্রের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গেলেই ধরে নেওয়া হতো বাকলাভা পরিবেশন যোগ্য। এর ব্যত্যয় ঘটলেই ফেরত পাঠানো হতো বাকলাভা ভর্তি ট্রে। সেগুলো আর পাতে দেওয়া হতো না। তবে বাকলাভা একসময় নিজের গণ্ডি ছাড়ায়। রাজা বাদশাহর দরবার থেকে ধনীদের খাওয়ার টেবিলে পৌঁছে যায়। একসময় অভিজাত শ্রেণির প্রিয় খাবারে পরিণত হয় এটি।

বাকলাভা প্যারেড

বাকলাভা নিয়ে একটি গল্প রয়েছে। সপ্তদশ শতকের দিকে ইস্তাম্বুলে রোজার দিনে দেশটির সৈন্যরা বাকলাভা ট্রে হাতে কুচকাওয়াজে অংশ নিত। স্থানীয়দের কাছে বেশ মজার বিষয় ছিল এটি। তারা সারি বেঁধে কুচকাওয়াজ দেখত আর উৎসাহ দিত হর্ষধ্বনি দিয়ে। রমজান মাসের ছুটির দিনে আয়োজিত এ কুচকাওয়াজকে বলা হতো বাকলাভা প্যরেড। এবার বিভিন্ন অঞ্চলের বাকলাভা নিয়ে কথা বলা যাক। সময়ের পরিক্রমায় বিভিন্ন দেশে পৌঁছে স্বাদে ভিন্নতা পেয়েছে বাকলাভা। সেই সঙ্গে উপকরণেও এসেছে ভিন্নতা।

অঞ্চলভেদে বাকলাভার ভিন্নতা

অঞ্চলভেদে কখনও ময়দার তৈরি পাতলা ফিলো, ডিম বা ভিনেগার দিয়ে ফাইলো শিটের পুরুত্বে, কখনও শুধু এক পদের বাদাম দিয়ে, কখনও আবার সিরাপ তৈরিতে দারুচিনি, লবঙ্গ, মধু ব্যবহার করে বাকলাভা তৈরি করা হয়। যে অঞ্চলে যে জিনিস বিখ্যাত, সেটি-ই ব্যবহার করা হয় বাকলাভা তৈরিতে। চলুন জেনে নেই কোন দেশের বাকলাভায় বিশেষ কী উপকরণ থাকে। গ্রিসের বাকলাভায় মাখন দেওয়া হয় না। তার পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় অলিভ ওয়েল। সাথে দেওয়া হয় তিল বীজ। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব গ্রিসে এই চল দেখা যায়। ইরানে বাকলাভা তৈরিতে ব্যবহার করা হয় পেস্তা, আখরোট, কাঠবাদাম, কাজুবাদাম ইত্যাদি। আবার হাঙ্গেরিতে পাওয়া যায় বাকলাভার অ্যাপ্রিকোট ভার্সন।

সিরিয়ার আলেপ্পোতে ব্যবহার করা হয় স্থানীয় পেস্তা আর হামা থেকে উৎপাদিত সামনা। বর্তমানে বাকলাভার সঙ্গে আর কিছু উপকরণ যোগ করা হয় স্থান ভেদে। এরমধ্যে খেজুর, চেরি, চকলেট চিপস, ক্রিমের ব্যবহার অন্যতম। এ তো গেল তৈরির উপকরণের কথা। এবার আসি ধরন নিয়ে। বেশ কয়েক ধরনের বাকলাভা তৈরি করা হয়। এরমধ্যে গাজিয়ান্তেপ, সোবিয়েত, পেস্তার শর্মা, বার্মিজ কাদায়েফ, বুলবুল ইউভাসি বা বুলবুল পাখির বাসা, ব্যাল্লোরিয়েহ, তাজ আর মালেক, আসাবি, বুকাজ, কুরু বাকলাভা উল্লেখযোগ্য।

বিশ্ববিখ্যাত বাকলাভা

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাকলাভার প্রচলন থাকলেও কিছু দেশের এই পেস্ট্রির রয়েছে বিশেষ সুনাম। এরমধ্যে তুরস্কের গাজিয়ান্তেপ ও ইস্তাম্বুল, ইরানের তেহরান ও ইয়াজদ আর গ্রিসের বাকলাভাগুলো বিশ্ববিখ্যাত।

বাকলাভা নামটি কীভাবে এলো

বাকলাভা দুটি শব্দযোগে গঠিত। প্রথম অংশ ‘বাখ’ অর্থ বীজ জাতীয় কিছু। এটি আর্মেনিয়ান শব্দ। অন্যদিকে ‘হালভা’ অর্থ মিষ্টি। এই শব্দটি নেওয়া হয়েছে তুর্কি থেকে। ধারণা করা হয় বাকলাভার মূল শব্দ ‘বায়লা’। এর অর্থ গাদা করে রাখা। বাকলাভা শব্দটি ইংরেজিতে যুক্ত হয় ১৬৫০ সালে। সৌদি আরবেও বাকলাভার বেশ চাহিদা। তবে দেশটিতে বাকলাভাকে ডাকা হয় বাকলাওয়া।

বাকলাভার দাবিদার দেশগুলো

বাকলাভার দাবীদারও একাধিক দেশ। বিশেষ করে তুরস্ক, গ্রিস, আরব, সিরিয়া, লেবানন, ইরান, আর্মেনিয়া, বুলগেরিয়াসহ আরও বেশকিছু দেশ। দেশগুলো অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকায় সংস্কৃতিসহ খাদ্যাভ্যাসে মিল রয়েছে। ওই জায়গা থেকে বাকলাভা তাদের সকলেরই প্রিয়। সেকারণেই তারা সবাই বাকলাভাকে নিজেদের খাবার বলে দাবি করে থাকে।

পছন্দের তালিকায় বাকলাভা

বাকলাভা সকল ধর্মের মানুষের প্রিয়। হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সবার পছন্দের তালিকায় আছে বাকলাভা। ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোতে ঈদ বড়দিনসহ বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা তাদের ধর্মীয় উৎসবগুলোতে ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে বাকলাভা তৈরি এবং পরিবেশন করে থাকে। এদিকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের গণ্ডি অনেক আগেই ছাড়িয়েছে বাকলাভা। স্বাদে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষজন আপন করে নিয়েছে এই পেস্ট্রি। এশিয়ায়ও ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে বাকলাভা। বাংলাদেশে অভিজাত মিষ্টির দোকানগুলোতে অন্যান্য মিষ্টির পাশাপাশি এখন বাকলাভা পাওয়া যায়। কিন্তু দাম বেশি হওয়ায় তা সাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় হয়নি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খাদ্য কথন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

20 − 5 =