শিশুর ইন্টারনেট ডায়েট

ময়ূরাক্ষী সেন

শাকিব ছয় বছরের শিশু। শাকিবের বাবা-মা দুজনেই চাকরিজীবী। সে দিনের বেশিরভাগ সময় তার দাদা-দাদির সাথে থাকে। তাদের সাথে থাকলেও তার সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হলো তার হাতে থাকা মোবাইল। এতে সে সারাদিন ভিডিও গেইম খেলে। তাকে তেমন কিছু বলা হয় না। কারণ সবাই মনে করে সে যেহেতু মা-বাবাকে ছাড়া সারাদিন থাকে তাই ফোন না দেখলে বাড়ির অন্যান্যদের বিরক্ত করবে। তাছাড়া সে ফোন ছাড়া খেতেও চায় না। এমনকি ছুটির দিনে বাবা-মায়ের সাথে কোথাও বেড়াতে গেলেও সে ফোনের আবদার করে। একবার শাকিবের প্রচণ্ড মাথা ব্যথা শুরু হলো। ডাক্তারের কাছে নেওয়ার পর জানা গেল অতিরিক্ত ফোন ব্যবহারের কারণে শাকিবের চোখের পাওয়ারে সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাবা-মা চিন্তিত হয়ে তাকে ফোন ধরতে নিষেধ করার সে চিৎকার করে কান্না করতে থাকে।

শাকিবের মতো ঘটনা এখন ঘরে ঘরে। বিশ্বে শিশুদের প্রযুক্তির উপর আসক্ত হবার হার আতঙ্কজনকভাবে বাড়ছে। বাবা-মা দুজনেই ব্যস্ত থাকায় ঝামেলা এড়াতে খুব অল্প বয়সেই তারা সন্তানদের হাতে প্রযুক্তি তুলে দিচ্ছেন। এখন মোবাইল, ট্যাব, কম্পিউটার সব শিশুদের হাতের মুঠোয়। বর্তমানে প্রযুক্তি ছাড়া একটি দিনও কেউ কল্পনা করতে পারে না, শিশুরাও এখন এর বাইরে নয়।অতিরিক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার মন ও স্বাস্থ্যে কিভাবে প্রভাব ফেলতে পারে তা জানবো আজ।

স্থূলতা

যে বয়সে মাঠে ছুটে বেড়ানোর কথা, সে বয়সে তারা ঘরের কোণে ডিভাইস নিয়ে শুয়ে-বসে দিন কাটাচ্ছে। যার ফলে তাদের স্থূলতা দেখা দিচ্ছে। অতিরিক্ত ওজন বেড়ে যাওয়া চিন্তা বিষয়। এখনকার শিশুরা জাংক ফুড বেশি খেয়ে থাকে। আবার তাদের কোনো শারিরীক পরিশ্রম হয় না। ফলে তারা প্রয়োজনের তুলনায় মুটিয়ে যেতে থাকে। ওজন বেড়ে যাওয়ার অল্প বয়সে তাদের নানারকম স্বাস্থ্য সমস্যা হতে থাকে। অনেকের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের মতো সমস্যা দেখা দেয়। মেয়ে শিশুর অল্প বয়সে হরমোনাল সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে। এছাড়া হার্টে নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়। স্থূলতার কারণে শিশু মৃত্যুহার কম নয়।

চোখে সমস্যা

অতিরিক্ত প্রযুক্তি ব্যবহারের চোখে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে ঢাকায় স্কুলে যাওয়া শিশুদের মধ্যে ৪০% শিশুর চোখের পাওয়ারে সমস্যা রয়েছে। শিশুরা অনেক সময় নিজেদের সমস্যার কথা বোঝাতে পারে না। অভিভাবকরা শিশু কোনো শারিরীক সমস্যার কথা বললে প্রথম অবস্থায় তারা তেমন গুরুত্ব দেন না। সেক্ষেত্রে সমস্যা শনাক্তে দেরি হয়ে যায়।

মানসিক সমস্যা

প্রযুক্তির প্রভাব পড়ে শিশু মনেও। দেখা গেছে, যেসব শিশু অতিরিক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা অস্থির প্রকৃতির হয়ে থাকে। লেখাপড়া সহ যাবতীয় কাজে তারা বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। এমনকি শিশুদের বিষণ্নতাও দেখা দিতে পারে। এখন এটি প্রমাণিত যে অতিরিক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার শিশুকে বিষণ্ন করে তোলে। বিষণ্নতায় ভোগা শিশুরা সারাক্ষণ ক্লান্তি অনুভব করে, তারা অস্থির হয়ে উঠে, ঠিকমতো খেতে পারে না। কোনো কারণ ছাড়া তাদের শরীরে ব্যথা করবে, যার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। তাদের মনের অবস্থা কোনোভাবেই তারা ব্যাখা করতে পারে না।

ঘুমের সমস্যা

৩ থেকে ৬ বছর বয়সী শিশুর ১১ থেকে ১২ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুর ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা ঘুম। ঘুমাতে যাবার কিছুক্ষণ আগে যেকোনো ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করলে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে।। ঘুমের সমস্যা থাকলে মাঝরাতে শিশুর ঘুম ভেঙে যাবে, আবার অনেক সময় একেবারেই ঘুম হয় না। আবার অনেকের রাতে পর্যাপ্ত ঘুম না হবার পরেও খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। শিশুর ঘুমের সমস্যা হলে সারাদিন তারা ক্লান্ত ও ঘুম ঘুম ভাব থাকে। দৈনন্দিন কোনো কাজে তারা উৎসাহ পায় না।

শিশু অসামাজিক হয়ে যায়

কোনো অনুষ্ঠান কিংবা দাওয়াতের সব শিশুরা নিজেদের মধ্যে গল্প না করে যে যার মতো মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত এ দৃশ্য খুবই পরিচিত। প্রযুক্তি শিশুদের অসামাজিক করে গড়ে তুলছে। তাদের কাছে বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করে সময় কাটানোর থেকে প্রযুক্তির সাথে থাকাটা বেশি আনন্দদায়ক। এতে তারা সহজে মানুষকে ভালোবাসতে শিখে না। প্রযুক্তি শিশুদের মধ্যে থেকে মমতাবোধ কমিয়ে দিচ্ছে। এতে করে আগামী প্রজন্ম আত্মীয়তা ও সম্পর্কের বন্ধন থেকে দূরে থাকবে।

শিশুকে এসব সমস্যা থেকে দূরে রাখতে প্রয়োজন ইন্টারেট ডায়েট। কারণ তারা এমন কিছু শিখে ফেলছে যা এই বয়সে তাদের শেখার কথা নয়। ইন্টারেট ও প্রযুক্তি থেকে সন্তানকে দূরে রাখতে বাবা-মা ও পরিবারের সদস্যদের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। বর্তমান সময় শিশুকে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি থেকে সম্পূর্ণভাবে দূরে রাখা কখনোই সম্ভব নয়। তবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আপনার শিশুর হাতে প্রযুক্তি দেওয়ার আগে মনে রাখবেন একবার সে এতে আসক্ত হয়ে গেলে ফিরিয়ে নিয়ে আসা কঠিন। প্রযুক্তি দেওয়ার আগে এর নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে তাকে স্পষ্ট ধারণা দিন। এটি অতিরিক্ত ব্যবহার করলে তার কি কি ধরনের সমস্যা হতে পারে তাকে জানিয়ে রাখুন। বাবা-মায়েরা শিশুকে সবচেয়ে বেশি ইন্টারনেট দিয়ে থাকে তাকে খাবার খাওয়ানোর সময়, কারণ এতে তারা বিরক্ত করে না। তবে এটি একটি অস্বাস্থ্যকর উপায়। জোর করে শিশুকে খাওয়াতে যাবেন না। ক্ষুধা লাগলে অবশ্যই সে প্রযুক্তি ছাড়াই খাবে।

ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা

ইন্টারনেট ব্যবহারের নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন। পড়ালেখার পাশাপাশি শিশুকে সাংস্কৃতিক দিকে উৎসাহিত করে তুলুন। নাচ, গান, কবিতা, ছবি আঁকা, গিটার শেখা কোনোদিকে তার আগ্রহ তা লক্ষ্য করুন। শারিরীক পরিশ্রমের জন্য সাঁতার কাটা কিংবা সাইকেল চালানো শিখাতে পারেন। এর ফলে রাতে ঘুমের সমস্যা হবে না। ঘুমের তিন ঘণ্টা আগে শিশুকে প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখুন। তাকে গল্পের বই পড়তে উৎসাহিত করুন। বাড়ির বড়দেরও প্রযুক্তি ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। শিশু যখন তার বাবা-মাকে সারাক্ষণ ফোন ব্যবহার করতে দেখবে তখন সে মনে করবে এটাই স্বাভাবিক। শিশুকে আপনার ছোটবেলার গল্প করুন, প্রযুক্তি ছাড়া কিভাবে সময় কাটাতেন তা নিয়ে কথা বলুন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্বাস্থ্য কথা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

1 × four =