‘হুব্বা’ প্রত্যাশা মেটাতে পারলো কতটা!

গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত

বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে একযোগে মুক্তি পেয়েছে ব্রাত্য বসু পরিচালিত সিনেমা ‘হুব্বা’। হুব্বা ব্রাত্য বসু’র নির্মিত পঞ্চম সিনেমা। সিনেমার গল্প পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কুখ্যাত গ্যাংস্টার হুব্বা শ্যামলের জীবন নিয়ে। হুগলির দাউদ ইব্রাহিম খ্যাত এই হুব্বা শ্যামলের প্রকৃত নাম শ্যামল দাস। সিনেমায় যাকে দেখতে পাবো হুব্বা শ্যামল নামে। খুন, মাদক পাচার, অরাজকতা তৈরি এসবই ছিল তার কর্মকাণ্ড। ফলে তার বিরুদ্ধে পুলিশ কেসও কম ছিল না। ২০১১ সালে বৈদ্যবাটীর এক খাল থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

‘হুব্বা’ সিনেমার শুরুতেই দেখা যাবে একটি খাল যেখান থেকে লাশ উদ্ধারের কাজ চলছে। শেষের দৃশ্য দিয়ে শুরু হলেও মূল গল্প শুরু হয় একটি পুলিশি অপারেশনের মধ্য দিয়ে। যথারীতি হুব্বাকে পুলিশ ধরতে পারে না। পুলিশ আসার আগেই কোনোভাবে তারা খবর পেয়ে সেখান থেকে সরে যায়। পুলিশকে বোকা বানানো এবং ধোঁকা দেওয়া হুব্বার কাছে সাধারণ বিষয়। ব্যবহার করতো ডজন খানেক ফোন। কোনো মোবাইল নম্বর ২ ঘণ্টার বেশি খোলা থাকতো না। পুলিশ কল রেকর্ড করলেও তাতে তেমন কোনো লাভ হতো না। হঠাৎ একদিন একটি সিনেমা হল থেকে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। রিমান্ডে নিয়ে প্রচুর মারধর করা হয় হুব্বা ও তার সহকর্মীকে। জিজ্ঞাসাবাদে উঠে আসে হুব্বা হয়ে ওঠার পেছনের ভয়ঙ্কর গল্প। শিক্ষকের মুখে কালি ছুড়ে মারা থেকে কম বয়সেই ছুরিকাঘাতে প্রথম খুন করা; সবকিছু জিজ্ঞাসাবাদে উঠে আসে। কিন্তু পুলিশ হুব্বাকে বেশিদিন জেলখানায় আটকে রাখতে পারেনি। কারণ শক্ত কোনো প্রমাণ পুলিশের কাছে ছিল না।

সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন ও গল্প লিখেছেন ব্রাত্য বসু। চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন ব্রাত্য বসু ও সুপ্রতিম সরকার। অভিনয়ের জন্য সবার আগে যার প্রশংসা করতে হবে তিনি হলেন বাংলাদেশের গুণী এবং জনপ্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিম। হুব্বা চরিত্রে তিনি শুধু অসাধারণই ছিলেন না, কিছু সময়ের জন্য মনে হবে সত্যিকারের একজন গ্যাংস্টার মোশাররফ করিম। কথায় কথায় চেচামেচি করা, এলাকা গরম করে ফেলা, খুন করে ফেলা অথবা কাউকে ভয় দেখানো সবকিছুই তিনি এমনভাবে স্ক্রিনে তুলে এনেছেন যে দর্শক তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হবেন। তার সংলাপ খুব বেশি শক্তপোক্ত ছিল না। কমেডি বেশি ছিল। হাসতে হাসতে বা মজার ছলেই চরিত্রটি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকতো।

মোশাররফ করিমের সাথে জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন লোকনাথ দে। একান্ত বিশ্বস্ত এই মানুষটি হুব্বার সাথে সবসময় থাকতেন। হুব্বার বেশিরভাগ ফোন কল তিনিই ধরতেন। রিমান্ডেও একসাথেই নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। তবে শেষে এই চরিত্রটি হুব্বা এবং দর্শককে একটু ধাক্কা দেবে। পুলিশের চরিত্রে দুর্দান্ত ছিলেন ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত। তার বডি ফিটনেস এবং চালচলন চরিত্র অনুযায়ী যা যা দরকার ছিল তেমনি দেখা গেছে। একজন অফিসার হিসেবে ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে জিজ্ঞাসাবাদ সেশনটি। ভালো লাগবে তরুণ বয়সী হুব্বার চরিত্রে থাকা গম্ভীরা ভট্টাচার্যর অভিনয়ও। যে বয়স থেকে অপরাধ জগতে পা রেখে বনে যান হুব্বা সেই বয়সটিকে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে ফুটিতে তোলেন তিনি। এছাড়াও হুব্বার প্রথম স্ত্রী ও দ্বিতীয় স্ত্রীর চরিত্রে যারা ছিলেন তারাও ভালো করেছেন। অর্থাৎ অভিনয়ে সকলে কমবেশি ভালো করেছেন।

সিনেমাটির টেকনিক্যাল দিকগুলোর দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। ক্যামেরার কাজ, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের ব্যবহার এবং সাউন্ডের কাজ অসম্ভব ভালো লেগেছে। যেহেতু ডার্ক কমেডি থ্রিলার ঘরানার সিনেমা ‘হুব্বা’ তাই স্বাভাবিকভাবেই কিছু কিছু সাউন্ড কানে লাগতে পারে। ডাবিং ভালো ছিল, কোথাও আনব্যালেন্স মনে হয়নি। কালার গ্রেডিংয়ের দিকেও সূক্ষ্ম নজর দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। স্ক্রিনে বেমানান লাগেনি একদমই। বিশেষ করে রাতের দৃশ্যগুলো খুব বেশি ভালো করে দেখানো হয়েছে। অন্ধকার ভাবটা দেখা যায়নি, যেটি পজিটিভ দিক।

একটি সিনেমার জন্য গান খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা গানই পারে সিনেমাটিকে দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতে। হুব্বার ক্ষেত্রে খুব বেশি গান সিনেমা রিলিজের আগে শোনা যায়নি, টাইটেল ট্র্যাক ‘হুব্বা’ ছাড়া। যদিও সিনেমায় ‘সব দুষ্ট লোক’ এবং ‘নিভে যায়’ শিরোনামে আরও দুটি গান আছে। সংগীত পরিচালক হিসেবে ছিলেন প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনটি গানই ভালো লেগেছে।

অত্যন্ত সাহসী নির্মাণ ছিল ‘হুব্বা’। কারণ একজন কুখ্যাত গ্যাংস্টারকে পর্দায় তুলে আনার চিন্তা করতেও বর্তমান সময়ে সাহসের প্রয়োজন হয়। যেটা পরিচালক ব্রাত্য বসু করে দেখিয়েছেন। গল্পটিকেও তিনি খুব বেশি এদিক সেদিক করেননি। শুধুমাত্র নাম পরিবর্তন করেছেন, হয়তো প্রশাসনিক ঝামেলা এড়াতে। এছাড়া পরিবর্তন তেমন লক্ষ্য করা যায়নি। হুব্বা শ্যামল সম্পর্কে আমরা যে গল্পগুলো বিভিন্ন মাধ্যম বা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি সেগুলোকেই স্ক্রিনে দেখতে পাবো। তাছাড়া শিল্পীদের কাছ থেকে অভিনয় আদায় করে নেওয়া এবং লোকেশন সিলেকশনে দারুণ পারদর্শিতা ছিল তার। মোশাররফ করিমকে তিনি যেভাবে পর্দায় এনেছেন সত্যিই প্রশংসা করার মতো।

তবে বেশ কিছু দুর্বলতা চোখ পড়েছে। তিনজন হুব্বার মধ্যে গম্ভীরা ভট্টাচার্যকে দেখানো হয়েছে দ্বিতীয় হুব্বা অর্থাৎ কম বয়সের হুব্বা চরিত্রে। তিনি অভিনয় ভালো করলেও তরুণ হুব্বার বয়স এবং প্রাপ্তবয়স্ক হুব্বার সাথে বয়সের একটি অসামঞ্জস্য স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। অন্যদিকে কিছু কিছু জায়গায় ব্যাপকভাবে এলোমেলো ভাবটা দেখা গেছে। একটি সিকোয়েন্সে বলা হচ্ছে হুব্বাকে ঠিকমতো কেউ চোখে দেখেননি। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হুব্বা শ্যামলের ছবি ছিল। কেউ না দেখে থাকলে অবশ্যই পুলিশের কাছে ছবি থাকার প্রশ্নই আসে না। যতই এআই ব্যবহার করে ছবি তৈরির চেষ্টা করা হোক না কেন। এছাড়া শেষদিকে এসে গুরুত্বপূর্ণ সিকোয়েন্স তাড়াহুড়ো করে দেখানো দৃষ্টিকটূ লেগেছে। হুব্বার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিকোয়েন্স শেষদিকে তাকে মেরে ফেলার দৃশ্যটি যেটা অনেক দর্শক দেখার জন্য মুখিয়ে ছিলেন যা একদমই দেখানো হয়নি। তাছাড়া খালে পড়ে থাকা লাশটি যে নকল পরিষ্কার সেটি বোঝা যাচ্ছিল। সিনেমার শেষ দিকে এসে প্রশ্নও রেখে গেছেন পরিচালক। জানি না কেন! তবে ‘হুব্বা’ সিনেমাটিকে খারাপ বলার অবকাশ থাকবে না।

‘হুব্বা’ সিনেমাটি হয়তো সবার কাছে ভালো লাগবে না। কারণ সিনেমাটিতে যথেষ্ট মাত্রায় গালাগাল, পাঞ্চ লাইন, যৌনতা এবং ভায়োলেন্স বিদ্যমান। যারা দেখে অভ্যস্ত তাদের কাছে কমও মনে হতে পারে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যাবে মোশাররফ করিমের অভিনয় দেখার পর। চরিত্রটিকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন তিনি। যারা সিনেমা হলে বসে সিনেমাটি দেখছিলেন সকলে তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। বাংলাদেশের কোনো সিনেমায় কবে এমন মোশাররফ করিমকে দেখা যাবে সেটার জন্য অপেক্ষা করতেই হচ্ছে!

সিনেমার নাম: হুব্বা

পরিচালক: ব্রাত্য বসু

দেশ: ভারত (পশ্চিমবঙ্গ)

ঘরানা: অ্যাকশন থ্রিলার কমেডি

মুক্তি: ১৯ জানুয়ারি, ২০২৪

দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা, ১৫ মিনিট

অভিনয়শিল্পী: মোশাররফ করিম, গম্ভীরা ভট্টাচার্য, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, জিনিয়া রায়, লোকনাথ দে, অনুজয় চ্যাটার্জি, অস্মিতা মুখোপাধ্যায়, কাঞ্চন মল্লিক।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সিনেমাল৭জি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

18 − 17 =