আজিজুল পারভেজ : পোড়ামাটির মধ্যে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি শাসকচক্র চাপিয়ে দিয়েছিল সশস্ত্র যুদ্ধ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধকালে হাজার বছরের ঐতিহ্যলালিত বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস চালায়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৯৩ হাজার ‘পরাক্রমশালী’ সৈন্য আত্মসমর্পণে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে স্বাধীন অস্থিত্ব ঘোষণা করে বাংলাদেশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখানো স্বপ্নে ভর করে প্রথমবারের মতো বাঙালি জাতি পেলে স্বাধীনতার স্বাদ। বাঙালি জাতির অভিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, ঠিকে থাকার জন্যই বাংলাদেশের সৃষ্টি। বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।
কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে থাকলো না। নানা রকম ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি আতঙ্কও ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু সব ষড়যন্ত্র-আতঙ্ক ছাড়িয়ে বাঙালি দাঁড়িয়ে গেছে শক্ত ভিত্তির উপর। বাংলাদেশকে এখন বলা হচ্ছে উন্নয়নের রোল মডেল।
ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কবলে দেশ
মার্কিন পরাশক্তির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর মার্কিন-পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে দেশ। স্বাধীন দেশটি যাতে দাঁড়াতে না পারে তার জন্য সব রকম ষড়যন্ত্রই চলে। প্রথম আঘাত আসে চুয়াত্তরে। দেশে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে দেশ গঠনের সংগ্রামে রাত-দিন পরিশ্রম করে যাওয়া জাতির পিতাকে সপরিবারে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায়। অথচ তিনিই জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন দেশটিকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার। জাতিকে জাগাতে গিয়ে পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরের মধ্যে ১৩ বছরই কারাগারে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পর যারা দেশটাকে পুনর্গঠন করতে পারতেন সেই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া জাতীয় নেতাদেরও হত্যা করা হয় জেলখানায় বন্দী অবস্থায়। জিয়া-এরশাদের হাত ধরে সামরিক যাতাকলে দেশ থাকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। এ সময়ে দেশ আবার ফিরে যায় পাকিস্তানি ভাবধারায়। মুক্তিযুদ্ধের পর নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আবার ফিরে আসে। ক্ষতবিক্ষত হয় সংবিধান। ভুলুন্ঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা-গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। হত্যার রাজনীতির ধারাবাহিকতায় নিহত হন রাষ্ট্রপতি জিয়াও। গণঅভ্যুত্থানে অবসান হয় সামরিক ধারার। তারপরও হত্যা-ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শেষ হয় না। বিএনপির শাসনামলে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয় তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনাকে। সেই শেখ হাসিনার হাতে এখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বÑ উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ নিয়ে দুর্ভাবনা ছড়াল তারা
একদিকে দারিদ্র্য, অন্যদিকে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ। তার উপর ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। জাতির পিতার নেতৃত্বে চলছে দেশ গঠনের সংগ্রাম। এর মধ্যে দুর্ভাবনা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলো নানা ভাবে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক হলিস বি. শেনারি ১৯৭৩ সালে বলেছিলেন, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৯০০ ডলারে পৌঁছাতে সময় লাগবে ১২৫ বছর।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে আখ্যায়িত করলেন ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’ বলে, যা ‘তলাবিহীন ঝুঁড়ি’ বা ‘বটমলেস বাস্কেট’ হিসেবেই ব্যাপক পরিচিতি পায়। পরবর্তী কয়েক দশক ধরে এ ব্যঙ্গাত্মক অপবাদ বয়ে বেড়াতে হয়েছে বাংলাদেশকে। তিনি বলেছিলেন, দেশটি বৈদেশিক ঋণ ফেরত দিতে পারবে না।
১৯৭৬ সালে অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফালান্ড এবং জন রিচার্ড পারকিনসন ‘বাংলাদেশ : দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘উন্নয়ন প্রত্যয়টি যদি বাংলাদেশে সফল হয়, তাহলে পৃথিবীর সব জায়গায় সফল হবে।’
সম্ভাবনার বাংলাদেশ : ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
উন্নয়নের ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে আলোচনায় আসা দেশটি সব বাধা পেরিয়ে ৫০ বছরের সময়কালে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংকের শ্রেণিকরণে ২০১৫ সালে নিম্ন-আয় থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পর সম্প্রতি জাতিসংঘের কাছ থেকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হওয়ার সুপারিশ পেয়েছে।
হেনরি কিসিঞ্জারের দেশের ঐতিহ্যবাহী সংবাদপত্র নিউ ইয়র্ক টাইমসের পুলিৎজার পাওয়া সাংবাদিক নিকোলাস ক্রিস্টফ সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে দারিদ্র্য বিমোচনের উপায় জানতে বাংলাদেশের কাছ শিক্ষা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের আরেক প্রভাবশালী দৈনিক ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল কয়েকদিন আগে লিখেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ‘তেজি ষাঁড়’। আর ওয়াশিংটন পোস্টের ভাষ্যকার মাইক বার্ড লিখেছেন, একসময় দক্ষিণ কোরিয়াকে উন্নয়নের মডেল হিসেবে উদাহরণ দেওয়া হতো। এখন সেই স্থান বাংলাদেশের।
নোবেলজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার ‘ভারত : উন্নয়ন ও বঞ্চনা’ গ্রন্থে লিখেছেনÑ বাংলাদেশ সামাজিক উন্নয়নের পথে দ্রুত এগিয়ে যাবে, এ কথা কেউ ভাবেনি। দেশ স্বাধীনের পর অনেকেই তখন বলেছিলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কেউ কেউ তাকে ‘বাস্কেট কেস’ বলে খরচের খাতায় ফেলে দিয়ে বলেছিলেন, এ দেশকে কোনো অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়াই উচিত নয়। কারণ, সে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খাদ্য উৎপাদন করে উঠতে পারবে না। এই গ্রন্থে তুলনামূলক আলোচনায় অমর্ত্য সেন বলেছেন, জীবনমানের নানা সুপ্রচলিত মাপকাঠিতে বাংলাদেশ কেবল ভারতের চেয়ে অনেক ভালো করছে না, অনেকটা এগিয়েও গেছে। অনেক সামাজিক সূচক, যেমনÑ গড় আয়ু, শিশুমৃত্যুর হার, টিকা দেওয়ার মাত্রা, সন্তান প্রজননের হার এবং এমনকি স্কুলশিক্ষার কিছু মাপকাঠিতে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে।
দ্রুততম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ
বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর অন্যতম দ্রুততম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ। পঞ্চাশের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১.৯ শতাংশ। এ সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রবৃদ্ধি ছিল ২.৭ শতাংশ। ষাটের দশকে এ ব্যবধান আরও বেড়ে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার দশকে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৩ শতাংশ। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা ৮.১৫ শতাংশে পৌঁছায়। যদিও কোভিড-১৯ এর কারণে গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) প্রবৃদ্ধি ৫.২৪ শতাংশে নেমে যায়। অবশ্য পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে করোনার বছরে অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি না হয়ে সংকোচন হয়েছে। বাংলাদেশে যতটুকু প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তা পৃথিবীতে তৃতীয় সর্বোচ্চ।
মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক হলিস বি. শেনারি বলেছিলেন, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৯০০ ডলারে পৌঁছাতে সময় লাগবে ১২৫ বছর। কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র ৪০ বছরে, ২০১১ সালে দেশের মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ৯২৮ ডলারে। বর্তমানে তা ২ হাজার ৬৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৮৮ ডলার। অর্থাৎ ৫০ বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রায় ১৬ গুণ।
দারিদ্র্য বিমোচন
১৯৭৩-৭৪ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্য পরিস্থিতির প্রথম হিসাব করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ওই সময় দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৮২ শতাংশ। সর্বশেষ প্রকাশিত খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। উল্লেখযোগ্য হারে দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশের অগ্রগতিকে সম্মান জানাতে ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবসে বাংলাদেশে আসেন বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। ওই সময়ে তিনি বলেছিলেন, শুধু বলার জন্য নয়, দারিদ্র্যবিমোচনে সত্যিই আজ ‘বিশ্বে রোল মডেল’। ২০১৬ সালের ভিত্তিতে ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের প্রাক্কলিত হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। কোভিডের কারণে গত বছর দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি হয়। সাম্প্রতিক বিভিন্ন জরিপ বলছে, এর অনেকটাই এখন পুনরুদ্ধার হয়েছে।
কৃষি নির্ভরতা থেকে শিল্পে রূপান্তর
শুরুতে দারিদ্র্যপীড়িত দেশটির অর্থনীতি ছিল বৈচিত্রহীন। কৃষিপ্রধান দেশ। উৎপাদনশীলতা ছিল খুব কম। শিল্প ও সেবাখাত ছিল খুব অনুন্নত। কৃষিপ্রধান থেকে শিল্প ও সেবাপ্রধান অর্থনীতিতে উত্তরণ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আধুনিকায়ন এনেছে। এখন জিডিপিতে কৃষির অংশ ১৩ শতাংশ। শিল্প এবং সেবার অংশ যথাক্রমে ৩৫ ও ৫২ শতাংশ। ১৯৭৫-৭৬ সালে বাংলাদেশ মাত্র ৩৮০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। কিন্তু ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানি ৪০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। তৈরি তৈরি পোশাকখাতের বিকাশের মাধ্যমে রপ্তানি খাত এগিয়ে গেছে দ্রুতগতিতে। বর্তমানে গার্মেন্ট শিল্পে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম। চীনের পরেই আমাদের অবস্থান। এ গার্মেন্টই বিশ্বে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’কে পরিচিতি দিয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সমৃদ্ধি
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। শুরুতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ২ কোটি ডলার। রেমিটেন্সের ওপর ভর করে মহামারির মধ্যেই রিজার্ভ ৪৪.১২ বিলিয়ন (৪ হাজার ৪০০ কোটি) ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন পাকিস্তানের দ্বিগুণেরও বেশি। রিজার্ভে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার যে রিজার্ভ রয়েছে, তা দিয়ে প্রায় এক বছরের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে পাকিস্তান। দেশটির রিজার্ভের অর্থ দিয়ে মাত্র ২ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। রিজার্ভে সমৃদ্ধির কারণেই বৈশ্বিক মহামন্দার আচড় লাগেনি বাংলাদেশের গায়ে। যে দেশকে শোষণ, বঞ্চনা, নানাবিধ আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করেছিল পাকিস্তান, আজ তারাই বাংলাদেশের মতো উন্নয়নের স্বপ্ন দেখে। তাদের সংসদেও বাংলাদেশের উন্নয়নের উদাহরণ টানা হয়। বলা হয়, উন্নয়ন না দিতে পারেন, অন্তত বাংলাদেশের মতো করে দেখান।
খাদ্য-শস্য-মাছ উৎপাদনে বিল্পব
স্বাধীনতার পর দেশে চাল উৎপাদন হয় মাত্র ১ কোটি মেট্রিক টন। সাড়ে সাত কোটি মানুষের খাদ্যও উৎপাদন হতো না। জনসংখ্যা এখন দ্বিগুণের বেশি, সতের কোটি হয়েছে। প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়ে কখনো কখনো রপ্তানিও হচ্ছে। চালের উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি। গেল অর্থবছরে চাল উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টন। আলু উৎপাদনেও শুধু স্বনির্ভর নয়, চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে চলতি অর্থবছরে দেশে ১ কোটি টনের বেশি আলু উৎপাদিত হয়। চাহিদা হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টন। আলু উৎপাদনে এখন বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০১৮-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় এবং বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। এফএও-এর তথ্যমতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। গরু ও ছাগলের মাংসের দিক থেকেও দেশ এখন স্বনির্ভর।
উন্নয়নশীল দেশের পথে উত্তরণ
বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের শ্রেণীকরণে ২০১৫ সালের ১ জুলাই নিম্ন আয় থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে ধারাবাহিক উন্নতির কারণে বাংলাদেশ এ তালিকায় আসে। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) থেকে উত্তরণের যোগ্য বলে স্বীকৃতি দেয়। গত ফেব্রুয়ারিতে ওই কমিটি বাংলাদেশকে উত্তরণের জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ করেছে। মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সামাজিক সূচকে উন্নতি এবং অর্থনীতির টিকে থাকার সক্ষমতার বিচারে বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্য মনে করছে জাতিসংঘ। ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হয়ে ভারত, চীন, মালয়েশিয়ার মতো এলডিসি নয় এমন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাবে বাংলাদেশ। এসব অর্জন বাংলাদেশের সক্ষমতার পাশাপাশি মর্যাদাও বাড়িয়েছে। এখন ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ।
কয়েকটি খাতে তুলনামূলক অগ্রগতির চিত্র
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটের আকার ৭২২ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকায়।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছর। গড় আয়ু এখন ৭২ বছরের বেশি।
শিশুমৃত্যু প্রতি হাজারে ১৬০ থেকে কমে ৩ দশমিক ৮ এবং মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১৬ থেকে ১.৭৩ শতাংশে নেমে এসেছে।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ রেমিটেন্স আসত ৮০ লাখ ডলার। ৫ দশকে তা ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
১৯৭২ সালে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ৪০০ মেগাওয়াট। চলতি বছর তা ২৪ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে।
তিন হাজার ৩১০ কিলোমিটার পাকা সড়ক থেকে ২২ হাজার কিলোমিটারে পৌঁছেছে।
এক সময় বাজেটের আগে অর্থমন্ত্রী বিদেশে গিয়ে টাকার জন্য ধর্না দিতেন। বিদেশি সাহায্যেই প্রণয়ন হতো বাজেট। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে আগে শতভাগ অর্থ বরাদ্দ করা হতো বৈদেশিক অনুদান থেকে। এখন প্রায় ৬৬ শতাংশ বরাদ্দ করা হয় দেশীয় সম্পদের উৎস থেকে। পদ্মা নদীর উপর সেতু হয়ে যাচ্ছে দেশীয় অর্থায়নে।
দেশে ১৯৭১ সালে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬.৮ ভাগ। বর্তমানে এ হার ৭৪.৭ শতাংশ। ১৯৭২ সালে শিক্ষার হার ছিল ২০ শতাংশ। বর্তমানে তা ৭২.৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ১৯৭০-১৯৭১ অনুযায়ী, মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ ছিল ছাত্রী। ব্যানবেইসের প্রতিবেদন ২০১৯ অনুযায়ী, প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫০.৩২ শতাংশই নারী। দেশে ১৯৭১ সালে মাত্র ২৯ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। বর্তমানে প্রাথমিক পর্যায়ের বিদ্যালয়ই আছে সোয়া লাখ। ১৯৭১ সালে দেশে ৬টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। আর বর্তমানে দেশে বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা ১৬১টি।
সত্তর-আশি দশকের ছনের গড় এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন। গরিব মানুষের বাড়িতেও এখন একটি টিনের ঘর দেখা যায়। মুজিববর্ষে সব ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের ঘর দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বাংলাদেশ
ক্রিকেটবিশ্বে বাংলাদেশের আবির্ভাব বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে নতুনরূপে পরিচিতি দিয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক আর ড. মুহাম্মদ ইউনুসের হাত ধরে এসেছে বিশ্ব শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। এ দেশে বিকশিত এনজিও ব্র্যাক পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় উদ্বাস্তু শিবির এখন বাংলাদেশে। ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে একসঙ্গে আশ্রয় দিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্ববাসীকে। বর্তমানে বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবহারে শীর্ষ দশে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। মহাকাশে রয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু-১’। বাংলাদেশের ওষুধ এখন ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার ৮০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
গত বছর বিখ্যাত সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট ৬৬টি সবল অর্থনীতির তালিকা প্রকাশ করে, যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য বা এমডিজির অনেক সূচক অর্জন করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কাড়ে বাংলাদেশ। এমডিজিতে ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি হারে কমাতে বাংলাদেশ সক্ষম হয়। এমডিজি অর্জনের জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশ।
বিখ্যাত সম্পদব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস ১১টি উদীয়মান দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশ রয়েছে এ তালিকায়।
বাংলাদেশ ২০২০ সালের বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫তম, অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান যথাক্রমে ৯৪তম ও ৮৮তম। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক সূচকে অগ্রগতির আরেকটি কারণ হলো নারীদের মোট সন্তান জন্মহার কমে যাওয়া। একটা সময় ছিল সত্তরের দশকে নারীপ্রতি গড় সন্তান জন্মহার ছিল ৭-এর কাছাকাছি। সেই অবস্থা থেকে আজকে এ হার মাত্র দুজন। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বাংলাদেশ জেন্ডার সমতায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের হিসাবে, গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৫০তম। পৃথিবীতে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে গত ৫০ বছরে পুরুষের চেয়ে নারীরা অধিক সময় শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন।
তবুও প্রশ্ন থেকে যায়
একজন সংবাদকর্মী হিসেবে লক্ষ্য করেছি, স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উৎসব যখন উদ্্যাপন করা হলো ১৯৯৬ সালে তখন সংবাদপত্রগুলোর প্রধান ইস্যু ছিল স্বাধীনতার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তীর হিসেব মিলানো। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশ্ন ছিল দেশ স্বাধীন করে কি পেলাম। অধ্যাপক কবি হুমায়ূন আজাদ প্রশ্ন করেছিলেনÑ এর রকম বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম? কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উদ্্যাপন হচ্ছে বাংলাদেশের অর্জনকে সামনে রেখে, সম্ভাবনার বাংলাদেশকে তুলে ধরে।
কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়। অগ্রগতির প্রশ্নে আমরা হিসাব মেলাচ্ছি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে। এতে অগ্রগতি দেখে তৃপ্তও হচ্ছি। কিন্তু বাংলাদেশের পরে জন্ম নেওয়া ভিয়েতনামের সঙ্গে যদি উন্নয়নের তুলনা করি তৃপ্তি কি মিলবে?
৫০ বছরের সাফল্যের পাশাপাশি কিছু হতাশার দিকও আছে। মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েই চলেছে। কোনো দেশের আয় ও সম্পদের অসমতা বোঝাতে ব্যবহৃত সূচক গিনি কো-ইফিসিয়েন্ট অনুসারে উচ্চ আয়ের ৫ শতাংশ মানুষের কাছে দেশের মোট সম্পদের ৫১ দশমিক ৩২ শতাংশ। আর নিম্ন শ্রেণির ৫ শতাংশের কাছে দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। এছাড়া মোট আয়ের ২৭ দশমিক ৮৯ শতাংশই উচ্চ শ্রেণির ৫ শতাংশ মানুষের দখলে। আর নিম্ন শ্রেণির ৫ শতাংশ মানুষের মোট দশমিক ২৩ শতাংশ। এ ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে।
দুর্নীতিতেও এক সময় বিশ্বে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে পরিস্থিতির কিছুটা উত্তরণ হয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুসারে দুর্নীতিতে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করা হলেও উত্তরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। দুর্নীতির পাশাপাশি উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে অর্থ পাচার। অর্থ পাচার নিয়ে কাজ করার আন্তর্জাতিক সংগঠন গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির তথ্য অনুসারে প্রতি বছর দেশ থেকে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে এটি রোধ করা জরুরি।
দেশ স্বাধীনের পর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ছিল দেশের জন্য প্রধানতম বোঝা। সেই জনসংখ্যা এখন সম্পদ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর মধ্যে সম্ভাবনার দিক হলো জনসংখ্যার মধ্যে তরুণদের সংখ্যা বেশি। দেশের প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মানুষের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। এদের জন্য কর্মসংখ্যান সৃষ্টি দেশের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
এ ছাড়াও পরমত সহিষ্ণুতার অভাব, গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব, সংস্কৃতি ও জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, চিন্তার স্বাধীনতায় বাধা, নারীর প্রতি সহিংসতা, শিশুর প্রতি নির্মমতা, ধর্মীয় উন্মাদনা, গুজব ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা, জঙ্গীবাদী তৎপরতা হতাশা জাগায়।
আরও অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা, দুর্নীতি প্রতিরোধ, অর্থ পাচার রোধ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান, মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রসার বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ।
ভূ-প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ একটি শান্তির দেশ। এখানে জাতিগত সংকট নেই, নেই দীর্ঘমেয়াদী কোনো রাজনৈতিক সংকট। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাই দেশটিকে এগিয়ে নিতে পারে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে চলা সেটাই প্রমাণ করেছে।
আজিজুল পারভেজ: বিশেষ প্রতিনিধি, কালের কণ্ঠ। ধুরুঁষঢ়ধৎাবু@মসধরষ.পড়স