৭১ এর সংগ্রাম

মৌ সন্ধ্যা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস অবলম্বন করে চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে এখনো। তরুণ প্রজন্মের অনেক নির্মাতারাও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন এবং প্রশংসা পাচ্ছেন। তেমনই একটি চলচ্চিত্র ‘৭১ এর সংগ্রাম’। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন মুনসুর আলী। দেশে-বিদেশে সুনাম অর্জন করেছে চলচ্চিত্রটি। চলচ্চিত্রটির প্রধান চমক হলো এতে দেশের অভিনয়শিল্পীরা যেমন অভিনয় করেছেন; তেমনি দেশের বাইরের কয়েকজন খ্যাতনামা অভিনয়শিল্পীও অভিনয় করেছেন।

মুক্তির আলোয় ‘৭১ এর সংগ্রাম’

চলচ্চিত্রটিতে একজন ব্রিটিশ সাংবাদিকদের একজন প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধার সাথে কথা বলা চিত্রিত করা হয়েছে যিনি একাত্তরের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের লড়াইয়ের সময় তার অতীত, জড়িত হওয়া, ক্ষতি এবং লড়াইয়ের কথা প্রকাশ করেছেন। ২০১৪ সালে মুক্তির আলোয় আসে চলচ্চিত্রটি। ১০ ফেব্রুয়ারি রিচ মিক্স সিনেমাতে চলচ্চিত্রটির প্রথম প্রাইভেট স্ক্রিনিং হয়। ২৭ মার্চ ঢাকার যমুনা ফিউচার পার্কের ব্লকবাস্টার সিনেমায় চলচ্চিত্রটির প্রিমিয়ার হয়। ২৮ মার্চ বাংলাদেশের ৫০টি সিনেমা হলে মুক্তি পায়। ১৪ জুলাই লন্ডনের দ্য ও টু অ্যারেনায় মুক্তি পায় এবং যুক্তরাজ্যে ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে লন্ডনের লিসেস্টার স্কোয়ারে একটি বিশেষ স্ক্রিনিং হয়। এরপর ইউরোপ এবং মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে মুক্তি পায়। বাংলাদেশে চলচ্চিত্রটির শিরোনাম ‘৭১-এর সংগ্রাম’। চলচ্চিত্রটির উপশিরোনাম দেওয়া হয় ‘স্ট্রাগল ফর লাভ অ্যান্ড সার্ভাইভাল’।

লন্ডনে বড় পরিসরে ‘৭১ এর সংগ্রাম’

বাংলাদেশে মুক্তির পাঁচ বছর পর ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যে আবারও বড় পরিসরে মুক্তি পায় সিনেমাটি। যুক্তরাজ্যের ২৬টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় এটি। মুক্তি উপলক্ষ্যে লন্ডনের টেমস নদীর তীরে চলচ্চিত্রটির বিশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্রবাসী বাংলাদেশি ছাড়াও এ সময় উপস্থিত ছিলেন পরিচালক মুনসুর আলী, নায়িকা দিলরুবা ইয়াসমিন রুহি ও নায়ক আমান রেজা। উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি রূপা হক।

কী আছে ‘৭১ এর সংগ্রাম’ চলচ্চিত্রে?

চলচ্চিত্রটির কাহিনিটিতে একজন অসুস্থ ব্রিটিশ-বাংলাদেশি মুসলমান ব্যক্তি করিম উদ্দিনের (অনুপম খের) জীবনের গল্প তুলে ধরা হয়েছে, তার হাসপাতালের মৃত্যুর সময় স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ফুটে উঠেছে। যে কাহিনিটি বলতে সহায়ক হিসেবে কাজ করেছেন লন্ডনের সাহসী ব্রিটিশ সাংবাদিক সারা। গল্পটি দেখানো হয় যুদ্ধের ফ্ল্যাশব্যাকে। যেখানে তরুণ করিম (আমান রেজা) প্রেমে পড়েন আশা’র (দিলরুবা ইয়াসমিন রুহী)। যুদ্ধ সব এলোমেলো করে দেয়। তার শান্তিমাখা গ্রামটিতে যুদ্ধ শুরু হয়। অপহরণ হয়ে যায় করিমের প্রেমিকা। গণহত্যা ও অপহরণ শুরু হওয়ার পর করিম মুক্তিযোদ্ধাদের এক গোপন দলে যোগ দিতে বাধ্য হন। গণহত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, এবং অগ্নিসংযোগের এক ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিতে করিমকে নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে হয়। এভাবেই এগিয়ে যায় কাহিনি।

যাদের অভিনয়ে ‘৭১ এর সংগ্রাম’

এখানে বয়স্ক করিম চরিত্রে অভিনয় করেন বলিউডের নন্দিত অভিনেতা অনুপম খের। সারা চরিত্রে এশিয়া আর্জেন্টো, তরুণ করিম চরিত্রে এমা রেজ, আশা চরিত্রে দিলরুবা ইয়াসমিন রুহী, মেজর ইফতিখারের চরিত্রে আরমান পারভেজ মুরাদ, আলতাফ চরিত্রে অনন্ত হীরা, মাইক চরিত্রে স্টিভ হপ উইন, ডাক্তার চরিত্রে নাজ মোদক, সুরজ চরিত্রে শুভ্রোধো, কোলেম্যানের চরিত্রে রাফায়েল কোলম্যান ও দ্বিতীয় ডাক্তার হিসেবে ম্যাক্স মরিস অভিনয় করেছেন।

‘৭১ এর সংগ্রাম’ চলচ্চিত্রের গান

চলচ্চিত্রটিতে আছে মোট ৭টি গান। নাশিদ কামাল, কোনাল, আরমিন মুসা, নোলোক বাবু, রাজু এবং জনিটা আহমেদ গেয়েছেন গানগুলো। সবকটা গানের সুর করেছেন আরমিন মুসা এবং পটভূমি সংগীত রচনা করেছেন ইমন সাহা। ২০১৪ সালে লেজার ভিশন এ গানগুলোর অ্যালবাম প্রকাশ করে। অ্যালবামের একটি সম্পূর্ণ সংস্করণ এরপরে আন্তর্জাতিকভাবে ডিজিটাল ডাউনলোডের জন্য মুক্তি দেওয়া হয়।

কেন এই সিনেমা বানিয়েছেন মুনসুর?

এত বিষয় থাকতে হঠাৎ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সিনেমা করার আগ্রহ হলো কেন? বিভিন্ন সময় সাংবাদিকরা এমন প্রশ্ন করেছেন পরিচালক মুনসুর আলীকে। এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা যেখানেই থাকি, নিজের শেকড় সন্ধান করার চেষ্টা করি। আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি জানার চেষ্টা করি। যখন ফিল্ম নিয়ে পড়ছি, তখন মনে হলো, আমি কে? আমি ব্রিটিশ। তবে একই সঙ্গে এটাও সত্য, আমি বাঙালি। আমি তখন ভাবতে শুরু করি, ব্রিটিশ-বাংলাদেশি হিসেবে আমার যে ডাবল আইডেন্টিটি, সেটা কিভাবে কাজে লাগানো যায়। তখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সিনেমা করার সিদ্ধান্ত নেই। এটা নির্মাণ করতে গিয়ে আমি অনেক কিছু জানতে এবং শিখতে পারলাম।’ সিনেমাটি দেখে খ্যাতিমান নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘ছবিতে জড়িত প্রত্যেকে যুদ্ধের পরের প্রজন্ম, তবুও তারা দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন, এটি আসলেই একটি বড় বিষয়।’ ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল ‘সিনেমাটি কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দারুন প্রশংসা কুড়িয়েছিল।’

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

২০১২ সালে লাইমলাইট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডসের মাধ্যমে তরুণ শিল্পীদের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে, মুনসুর আলীকে টাওয়ার হ্যামলেটস নাগরিক পুরস্কার প্রদান করা হয়। দেশে বিদেশে প্রচুর দর্শকের ভালোবাসা কুড়িয়েছে সিনেমাটি। লন্ডনের লেস্টার স্কোয়ারে সিনেমাটি দেখানো শেষ হওয়ার পর পরিচালক মনসুর আলী দর্শকদের নানা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন। সেসময় সামনে এগিয়ে এসে এক পাকিস্তানি তরুণী বলেন, ‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, এই ছবিটা তৈরি করার জন্য। আর আমি খুবই দুঃখিত যে আমার দেশ তোমাদের সাথে এই কাজ করেছে। তোমার ছবিটা না দেখলে জানতাম না, কি ঘটেছে।’

এক নজরে মুনসুর আলী

মুনসুর আলীর জন্ম ২৫ মে ১৯৭৮। সিলেটে জন্ম হলেও বর্তমানে তিনি ব্রিটিশ নাগরিক। লন্ডন মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচলর অফ আর্টস ফিল্ম অ্যান্ড প্রডাকশন বিয়ে পড়েছেন তিনি। তিনি একই সঙ্গে চলচ্চিত্র পরিচালক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র প্রযোজক।

শৈশব ও পড়ালেখা

মুনসুর আলী ১৯৮০ সালে দু’বছর বয়সে ইংল্যান্ডে চলে যান এবং সেখানে অলডগেটে বড় হয়েছেন। তিনি বর্তমানে সেখানে থাকেন। তিনি চার্চ অফ ইংল্যান্ডের স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন, উইকএন্ডে আরবি পড়া শিখেছেন এবং স্কুলের পরে বাংলা ও উর্দুতে কথা বলতে শিখেছিলেন। শৈশবকাল থেকেই আলী চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি এপিং ফরেস্ট কলেজে ফিল্ম এবং ফটোগ্রাফি শিখেছিলেন। ২০০৪ সালে, তিনি লন্ডন মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ফিল্ম অ্যান্ড ব্রডকাস্ট প্রোডাকশনে নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। আলীর পিতা ব্রিটিশ ভারত (বর্তমানে বাংলাদেশ) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আলীর পিতা ১৯৫০-এর দশকের গোড়ার দিকে যুক্তরাজ্যে গিয়েছেন। তিনি তার বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ছেড়ে ব্রিটিশ নাগরিক হন ।

চলচ্চিত্র তৈরি ও কর্মজীবন

স্নাতক ডিগ্রি পাওয়ার পরে আলী পুলিশিং, অপরাধ এবং গ্যাং সহিংসতার মতো সামাজিক বিষয় নিয়ে ডকুমেন্টারি এবং শর্ট ফিল্ম তৈরি করেছিলেন। ২০০৩, ২০০৫ সালে তিনি একটি স্বতন্ত্র ভিডিও এবং চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা স্পটলাইট ইউকে স্থাপন করেছিলেন। তারপর থেকে তিনি আমেরিকা, যুক্তরাজ্য এবং বলিউডে কাজ করেছেন। ২০০৬ সালে তিনি উদীয়মান চলচ্চিত্র প্রতিভা শনাক্ত করতে লাইমলাইট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড চালু করেন। ২০০৭ সালে প্রথম ইভেন্টটি সংঘটিত হওয়ার সাথে সাথে এটি একটি বৃহত্তম স্বতন্ত্র শর্ট ফিল্ম পুরস্কার অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। ২০০৯ সালে তিনি এপিক মিডিয়া ওয়েডিং প্রোডাকশন প্রতিষ্ঠা করেন।

রাজনৈতিক জীবন

মনসুর আলী ২৩ মার্চ, ২০১৭ সালে লন্ডন শহরের নগরীর অলডগেটে পোর্টসোকেন ওয়ার্ডের জন্য লেবার পার্টির কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। আলীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত ‘সাম্প্রতিক মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড আবাসন উন্নয়ন পরিকল্পনায়’ অসন্তুষ্ট হয়ে নিয়েছিলেন। ১৯ জুন ২০১৭-এ লন্ডনের গিল্ডহলে লন্ডন সিটি পরিচালনা করে এমন আদালতের সাধারণ আদালতের সদস্য হিসেবে লন্ডনের গিল্ডহলে উদ্বোধন করা হয়েছিল।

ব্যক্তিগত জীবন

মনসুর আলী মুসলমান ধর্মের অনুসারী। তিনি লন্ডনের অলডগেটে থাকেন। ২০১১ সালে ‘৭১ এর সংগ্রাম’ সিনেমায় কাজ করার সময় আলী বাংলাদেশের অভিনেত্রী দিলরুবা ইয়াসমিন রুহির প্রেমে পড়েন। সিনেমাটি মুক্তির পরে ভালোবেসে বিয়ে করেন তারা। ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪-তে মুনসুর আলী ও রুহি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ছেলে রুহানকে নিয়ে এখন তাদের সুখি পরিবার।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

seventeen − 11 =