টেক বিলিয়নিয়ার ইলন মাস্ক

আশফাক আহমেদ

একজন ব্যক্তি প্রযুক্তির মাধ্যমে বদলে দিচ্ছেন বিশ্বকে। তার যেমন নিন্দুক রয়েছে, ভক্তও রয়েছে। একাই বদলে দিচ্ছেন ভবিষ্যৎপ্রযুক্তি, শক্তি ও মহাকাশ অভিযানের গতি-প্রকৃতি। তিনি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক। অনেকের মতে, তিনিই হতে পারেন মানব ইতিহাসের প্রথম ট্রিলিয়নিয়ার। প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আয় করা প্রধান নির্বাহী বা সিইও কে? এই প্রশ্নের জবাবে অনেকের মনে হতে পারে গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই, মাইক্রোসফট সিইও সত্য নাদেলা, অ্যাপলের সিইও টিম কুক অথবা অন্য কেউ। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে প্রযুক্তিখাতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বেতনভোগী প্রধান নির্বাহী হলেন ইলন মাস্ক।

মহাকাশযান নির্মাণ প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও, বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারক টেসলা ইনকরপোরেটেডের সিইও এবং টুইটারের মালিক ইলন মাস্ক বিশ্বের শীর্ষ ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। তার বেতন বিশ্বের যেকোনো কোম্পানির সিইওর চেয়ে বেশি। এরসাথে যোগ হতে যাচ্ছে ইলন মাস্কের নতুন প্রতিষ্ঠান ‘এক্স ডট এআই’। আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স নিয়ে কাজ করবে মাস্কের এই নতুন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটি। ২০২২ সালে বেতন হিসেবে ইলন মাস্ক ২ হাজার ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলার পেয়েছিলেন। তার বেতন সুন্দর পিচাই, সত্য নাদেলা, টিম কুক, এন চন্দ্রশেখরনসহ বিশ্বের অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের চেয়ে অনেক বেশি।

বিশ্বের শীর্ষ ধনী ও অন্যতম প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক গত দুই দশকে পেপ্যাল, স্পেসএক্স, টেসলা এবং টুইটারের মতো প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। সফল উদ্যোক্তা হওয়ার আগে তরণ বয়সেও মাস্কের জীবন ছিল নানা ঘটনায় পরিপূর্ণ। নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশা ছিল ছোটবেলা থেকেই। অল্প বয়সেই নিজে নিজে রকেট, কোডিং করে ভিডিও গেম তৈরি করেন মাস্ক। তবে ছোটবেলায় বাসায় ও স্কুলে নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে।

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায় বড় হয়েছেন মাস্ক। সে সময় তিনি, তার ভাই কিম্বাল ও অন্যান্য কাজিনরা দেশটির রাজধানীর ধনী এলাকায় মানুষের বাসায় গিয়ে চকলেট বিক্রি করতেন। প্রিটোরিয়ার একটি স্কুলে পড়ালেখা করেন মাস্ক। সহপাঠীদের মধ্যে মাস্ক সবচেয়ে স্মার্ট ছিলেন। সবসময় নতুন কিছু শেখার ঝোঁক ও বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতেন। এক সাক্ষাৎকারে মাস্ক জানান, ছেলেদের গ্যাং তাকে তাড়া করতো এবং একবার মেরে তাকে সিঁড়িতে ফেলে দিয়েছিল। এই ঘটনায় হাসপাতালেও যেতে হয় তাকে। ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত বুলিংয়ের শিকার হন মাস্ক। এরপর নিজেকে রক্ষায় জুডো, কারাতে ও রেসলিং শেখেন। ছোটবেলায় মাস্ক কোনো কিছু নিয়ে এতটাই গভীর মনযোগে ডুবে থাকতেন যে তার বাবা-মা চিন্তায় পড়ে যান। তারা ভাবতেন মাস্ক কানে শোনেন না। এ জন্য ডাক্তারের শরাণাপন্নও হন। পরে অবশ্য তারা বুঝতে পারেন এটি মাস্কের নতুন আবিষ্কার সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার উপায়।

মাত্র ৯ বছর বয়সে পুরো এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা পড়া শেষ করেছিলেন মাস্ক। সায়েন্স ফিকশন, কমিকস এবং নন-ফিকশন বইয়ের পেছনে দিনে ১০ ঘণ্টা সময় ব্যয় করতেন তিনি। কম্পিউটার কোডিংয়ের শুরুর দিনগুলোতে মাস্ক ‘ব্লাস্টার’ নামের একটি ভিডিও গেমের কোডিং করেন। এটা ছিল একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীভিত্তিক গেম। পৃথিবীকে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আসা এলিয়েন স্পেসক্রাফটকে ধ্বংস করাই ছিল ব্লাস্টের উদ্দেশ্য। গেমটির সোর্স কোড দক্ষিণ আফ্রিকার একটি প্রকাশনা সংস্থার কাছে ৫০০ ডলারে বিক্রি করেন তিনি।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে ভাই কিম্বাল ও কাজিনদের সঙ্গে বাসার পাশেই ভিডিও আর্কেড প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন মাস্ক। তারা জায়গা ভাড়া নেওয়ার জন্য শহর কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় ফর্ম পূরণ করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে শহর কর্তৃপক্ষ জানায়, জায়গা ভাড়া নেওয়ার মতো উপযুক্ত বয়স তাদের হয়নি। কৈশোরে পা দেওয়ার পর মাস্ক তার জন্মভূমি দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে উত্তর আমেরিকায় চলে যান। সেখানে তিনি কলেজে পড়াশোনা শুরু করেন। মাস্ক তখন দৈনিক ১ ডলার খরচ করে জীবনধারণের চেষ্টা করতেন। ইলন মাস্ক স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রপড আউট শিক্ষার্থীদের একজন। পদার্থবিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি করতে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু দুই দিন পরই ছেড়ে দেন স্ট্যানফোর্ড। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ইলন মাস্ক তার প্রথম কোম্পানি জিপ ২ শুরু করেন। চার বছর পর জিপ ২ বিক্রি করেন ৩০ কোটি ডলারে। মাস্ক অনলাইন ব্যাংক এক্স ডটকমের সহপ্রতিষ্ঠাতা। এটি পরে পে প্যালের সঙ্গে একীভূত হয়। ২০০২ সালে অনলাইন নিলামঘর ই-বে ১৫০ কোটি ডলারে পে প্যাল কিনে নেয়। পে প্যালের বেশির ভাগ শেয়ারের মালিক ইলন মাস্ক তখন এক চুক্তিতে সাড়ে ১৭ কোটি ডলার কামিয়ে নেন।

ইলন মাস্কের সবচেয়ে সফল উদ্যোগ বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান টেসলা। কিন্তু এই কোম্পানির ধারণা তার মাথা থেকে আসেনি। ২০০৩ সালে মার্টিন এবারহার্ড ও মার্ক টারপেনিং টেসলা প্রতিষ্ঠা করেন। এক বছর পর মাস্ক এতে বিনিয়োগ করেন। মাস্ক ২০০৪ সালে প্রথম দফায় সাড়ে ৬৩ লাখ ডলার টেসলায় বিনিয়োগ করেন। বর্তমানে তিনি টেসলার প্রধান নির্বাহী। টেসলার যখন বেশ খারাপ সময় চলছিল তখন ইলন মাস্ক তার বৈদ্যুতিক গাড়ির এই উদ্যোগ গুগলের কাছে প্রায় বিক্রিই করে দিয়েছিলেন। ইলন মাস্ক টেসলাকে ব্যর্থ উদ্যোগ মনে করেছিলেন। তাই গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ল্যারি পেজের কাছে টেসলা বিক্রির প্রস্তাব নিয়ে যান। ২০১৩ সালে এই দুজনে ৬০০ কোটি ডলারে টেসলা কেনা-বেচার সিদ্ধান্ত নেন। শেষ পর্যন্ত টেসলা বিক্রি হয়নি।

‘আয়রন ম্যান’ সিনেমার জন্য অভিনেতা রবার্ট ডাউনি জুনিয়র নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন, তখন অনুপ্রেরণা নিতে তিনি মাস্কের কাছে যান। দুজনে দেখা করেন। ‘আয়রন ম্যান’ ছবিতে টনি স্টার্ক চরিত্রের ম্যানারিজম ইলন মাস্কই শিখিয়ে দেন রবার্ট ডাউনি জুনিয়রকে। চলচ্চিত্র ও টিভিতে অভিনয়ও করেছেন ইলন মাস্ক। ২০১০ সালে ইলন মাস্ক ‘আয়রন ম্যান ২’ ছবিতে ছোট এক চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। একই বছর অভিনয় করেন ‘দ্য বিগ ব্যাং থিওরি’ টেলিভিশন শোতে। ২০১৩ সালে মাস্ক লোটাস এস্প্রিট গাড়ি কেনেন ১০ লাখ ডলারে। এটি ১৯৭৬ মডেলের এই গাড়িকে পানির নিচে চলাচলের উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছিল। যা জেমস বন্ড সিরিজের ‘দ্য স্পাই হু লাভড মি’ সিনেমায় ব্যবহার করা হয়। ইলন মাস্ক পরে স্বীকার করেন, এই গাড়ি টেসলা সাইবারট্রাক তৈরির অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।

ইলন মাস্কের সাত সন্তান। পাঁচজনের মা মাস্কের সাবেক স্ত্রী জাস্টন। বাকি দুই বাচ্চার মান মিউজিশিয়ান গ্রিমস। মাস্কের আরও এক সন্তান ছিল। যে ২০০২ সালে মারা যায়। তিনি সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়েছিল। ২০২১ সালে দ্য ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইলন মাস্ক বলেন, ‘সভ্যতা মানুষকে কম সন্তান নেওয়ার কথা শিখিয়েছে। আমি ভালো উদাহরণ তৈরি করতে চাই। যা আমি বিশ্বাস করি, তার চর্চা করতে চাই।’ টুইটার কেনা, কর্মী ছাঁটাই থেকে শুরু করে নিজের নানা কর্মকাণ্ডের কারণে আলোচিত-সমালোচিত ইলন মাস্ক। কিন্তু প্রযুক্তি ব্যবসায় জ্ঞান, জানা-শোনা এবং অভিজ্ঞতা অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক নাম ইলন মাস্ক। বিশ্বের ধনকুবেরদের তালিকায় যা তাকে শীর্ষ আসনে বসিয়েছে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন:  টেক ট্রেন্ড

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

2 + ten =