বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনে নারী নেতৃত্ব

ইরানী বিশ্বাস

সমাজে নারীরা এখন আর পিছিয়ে নেই। সকল শ্রেণি পেশায় যেমন তাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে, ঠিক তেমনি রাজনৈতিকভাবেও বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। একটা সময় ছিল কোনো সংগঠন বা অফিসে কোটা পূরণের জন্য নারীদের রাখা হতো। দেশের সংসদেরও শোভা বর্ধনের জন্য কিছু নারীদের রাখা হতো, যারা রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলেন না। অনেকেই স্বামীর ব্যবসার চেয়ারপারসন হিসেবে থাকতেন। শুধুমাত্র কাগজে-কলমে বাস্তবে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। সেই ধারনা ভেঙে দিয়েছে গত জুন থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনে পুরুষের পাশাপাশি নারী শিক্ষার্থীদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ।

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় জুনে। তবে এ আন্দোলন তীব্রতা পেতে থাকে জুলাইয়ের শুরুতে। এ সময় ঢাকায় আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ছিল শাহবাগ। শাহবাগকেন্দ্রিক মিছিল ও সভাগুলোর প্রতিটিতেই সামনের সারিতে ছিলেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী শিক্ষার্থী। এমনকি বিক্ষোভসভাগুলোতেও অধীকাংশ সময় স্লোগান দিতেও দেখা গিয়েছে তাদের। শুধু তাই নয় নারী কোটার বিরুদ্ধেও শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন নারী আন্দোলনকারীরা। ‘নারী যেখানে অগ্রসর, কোটা সেখানে হাস্যকর’ এমন স্লোগান ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে উপস্থিত হতে দেখা গিয়েছে তাদের। সভাগুলোতে নারীদের বক্তব্যে বারবার উঠে এসেছে তারা বিশেষ কোনো সুবিধা নয় বরং নিজেদের যোগ্যতায় সামনে এগিয়ে যেতে চান। শুধু শাহবাগেই নয়, দেশের প্রায় প্রতিটি বিশ^বিদ্যালয়েই এমন চিত্র দেখা গেছে।

বিশ^বিদ্যালয়গুলোর গত কয়েক বছরে ফলাফলের দিকে তাকালে দেখা যায়, নারী শিক্ষার্থীরা এগিয়ে রয়েছে। এই এগিয়ে থাকাই হয়তো তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করেছে যে তারা কোটা ছাড়াই এগিয়ে যেতে পারবে বলে মনে করেন। আন্দোলন পরবর্তীতে সমাজ বা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে নারীদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা ছিল, মতামত ছিল। কারণ এ আন্দোলনে আরো জোরালোভাবে নারীরা তাদের সাহস ও অগ্রসরতার জায়গাটি বুঝিয়ে দিয়েছে। পুলিশ, সমাজ বা রাষ্ট্র কারোরই আর নারীকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই।

বিশ^বিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের ৪৯তম বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী উচ্চশিক্ষায় ছাত্রীর সংখ্যা ৪৭ লাখ ৫৬ হাজার ৭৪৭। তাদের মধ্যে ছাত্র ২৫ লাখ ৪২ হাজার ৩৩১ জন এবং ছাত্রী ২২ লাখ ১৪ হাজার ৪০৯ জন। এদের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আছেন ২১ লাখ ১৩ হাজার ৮২৬ জন এবং বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ১ লাখ ৫৮৩ জন। এ নারী শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে দেখা গিয়েছে। কোনো কোনো সময় আগ্রাসী পুলিশের সাথে তর্কে-বিতর্কে দেখা গিয়েছে বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের। এমনকি বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়াতেও পিছপা হয়নি। নারী শিক্ষার্থীরা সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, তারা আর অবলা নেই। সমাজে সকল কাজে পুুরুষের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে চলতে জানে।

জুলাইয়ের ১৫ তারিখ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর যে হামলার ঘটনা ঘটে, সেখানে প্রতিরোধ গড়ে তোলায় নারী শিক্ষার্থী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। সেই সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারীদের একটি বড় ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। শিক্ষার্থীদের সাহস যোগাতে তাদের পাশে সর্বদা  শিক্ষিকা, পোশাজীবী নারী, গৃহিনী, মা-বোন বিভিন্ন পরিচয়ে এ আন্দোলনে নারীরা কোনো না কোনোভাবে যুক্ত হয়েছিলেন। এ ভূখণ্ডের ইতিহাসেও তাই লেখা আছে। ১৯৪৭, ৫২, ৫৯, ৭১, ৯০ সব আন্দোলনে নারীদের উপস্থিতি ছিল। তবে ২০২৪ সালে ছাত্র আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের ব্যাপক উপস্থিতি জানান দেয় অগ্রসর বাংলাদেশের রূপরেখা।

বিগত দিনে সমাজের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে সাধারণ নারীদের উপস্থিতি ছিল হতাশাজনক। সেই তুলনায় কোটা আন্দোলনে নারীর অগ্রণী ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। সহিংস আন্দোলনেও নারী শিক্ষার্থী পিছিয়ে যায়নি। এমনকি নুসরাত তাবাসুম নামের সমন্বয়ক অন্য ছয়জন সমন্বয়কের সাথে তাল মিলিয়ে অনশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। নারী শিক্ষার্থী থেকে সকল শ্রেণির নারীর অংশগ্রহণ ছিল স্বতস্ফুর্ত। নারী শিক্ষর্থীদের পাশে নারী শিক্ষিকারা ছিলেন। আন্দোলনকারীদের খাদ্য-পানীয় সরবরাহে তৎপর ছিলেন অনেক নারী। কোনো কোনো নারী নিজে গাড়িতে করে খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আন্দোলনে এসেছেন। শিশু থেকে বয়স্ক সকল বয়সের, সকল পেশার নারীর অংশগ্রহণ বিশেষ করে বোরকা পরা, হিজাব পরা নারীদের অংশগ্রহণ আধুনিক বাংলাদেশের প্রতিচিত্র। তাদের বাইরে বেরিয়ে আসা, এক ধরনের প্রতিবাদের শামিল। সমাজে এগুলোর সুদূর প্রসারি প্রভাব আছে। তাদের ব্যক্তিগত জীবনে এই আন্দোলনের অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করার সুফল সমাজে প্রভাব ফেলবে। এতে অবহেলিত নারীরাও ভবিষ্যতে নিজেদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হবেন।

সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মিছিল চলেছে। অল্প বয়সি যুবক-যুবতি পাশাপাশি থেকে সংহতি প্রকাশ করেছে। কোনো অনৈতিক সংবাদ গণমাধ্যমে আসেনি। অতীতে রাস্তায় চলাচল করতে পারেনি না মেয়েরা। একা তো দূরের কথা, পরিবারের সাথেও কেউ কেউ রেহাই পায় না। পাঁচ বছরের কন্যা শিশু থেকে আশি বছরের বৃদ্ধ যেখানে ধর্ষণের শিকার হয়, সেখানে এতগুলো শিশু-কিশোর-যুবতী-বয়স্ক নারীর অবস্থান ছিল একই সাথে হাজার ছাড়িয়ে লক্ষ মানুষ। অথচ এত মানুষের ভিড়ে কারো মনেই কোন যৌন উত্তেজনার মতো খারাপ চিন্তা ছিল না। সকলেরই যেন একটাই প্রার্থনা, একটাই চাওয়া আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা।

একটানা সতের দিনের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পর গত ৫ আগস্ট পূর্ণতা পায় ছাত্র আন্দোলন। দেশে হাল ধরেছে অন্তর্বর্তী সরকার। শুরু হয়েছে নতুন করে পথ চলা। শপথ নেওয়া নতুন মোট আঠারো জন উপদেষ্টাদের মধ্যে চারজন নারীর উপস্থিতি। বিষয়টি অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। মানুষ আশায় বুক বাঁধছে এই সরকারের হাত ধরে এ দেশের জনগণ এক নতুন বাংলাদেশ দেখবে। তবে স্বতস্ফুর্তভাবে নারীদের অংশগ্রহণ যেন এ দশের জনগণ ভুলে না যায়। এমন যেন না হয়, আন্দোলন শেষ হয়েছে এবার তোমরা ভুলে যাও এসব কথা। তারা কিন্তু পুরুষের পায়ে তাল মিলিয়ে সমান তালে হেঁটেছে। আগামী দিনের সকল সমস্যাতে যেমন নারী অগ্রণী ভূমিকা রাখবে, তেমনি সাফল্যের প্রথম সারিতে তাদের নাম লিখবে। নতুন স্বাধীনতায়, নতুন বাংলাদেশে নারী যেন বাধাহীন বিচরণ করতে পারে সেটাই প্রত্যাশা।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে হবে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

twenty + eleven =