ওজন নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই বিদ্যার

নীলাঞ্জনা নীলা: বিদ্যা বালান ১৯৯৫ সালে ‘হাম পাঁচ হিন্দি সিটকম’র মাধ্যমে অভিনয় জগতে নাম লেখান। হিন্দি ছাড়াও তিনি একাধারে বাংলা ও তামিল সিনেমাতে অভিনয় করেন। ২০০৩ সালে তিনি ‘ভালো থেকো’, ‘স্বাধীন বাংলা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র কাজ করেন। ২০০৫ সালে প্রণয়ধর্মী নাট্য চলচ্চিত্র ‘পরিণীতা’য় ললিতা চরিত্রে অভিনয় করার মাধ্যমে প্রথম হিন্দি সিনেমায় যুক্ত হন। ‘লাগে রাহো মুন্না ভাই’ তার অভিনীত প্রথম ব্যবসাসফল সিনেমা।

এখন তিনি অনেকের কাছে আইকন হলেও তার শুরুটা খুব সহজ ছিল না। ছোটবেলা মানুষের নানা রকম স্বপ্ন থাকে। সময়ের সাথে সাথে সেই স্বপ্ন বদলেও যায়। কিন্তু বিদ্যা বালান যখন তখন বুঝতে শিখেছেন তখন থেকেই সিনেমার নায়িকা হবার স্বপ্ন দেখতেন। খুব সাধারণ একটি ছোটবেলা কেটেছে তার। ছোটবেলায় বাড়িতে টিভি আসার পর থেকে প্রচণ্ড টিভি দেখার নেশায় পড়ে যান। অন্য বাচ্চাদের মতো খেলাধুলো তার ভালো লাগত না। টিভি দেখা ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ। মাধুরী দীক্ষিত ছিল তার সবচেয়ে পছন্দের নায়িকা। তিনি ঘরের দরজা বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাধুরী দীক্ষিতের মতো নাচতে চেষ্টা করতেন। কখনো কখনো সিনেমার সংলাপ একা একাই বলে যেতেন। তার এইসব কাণ্ড দেখে পরিবারের সবাই পাগলামি মনে করে উড়িয়ে দিত। কিন্তু যতদিন গিয়েছে তার অভিনেত্রী হওয়ার আকাক্সক্ষা আরো তীব্র হয়েছে। কলেজ জীবনে সব ধরনের কর্মকাণ্ডের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন। কলেজের সবাই তার চলচ্চিত্রে কাজ করার স্বপ্নের কথা জানতেন। একদিন তার কলেজে বিশাল বড় পোস্টার লাগানো হয়, একটা সিরিয়ালের জন্য নতুন কিছু মুখ খোঁজা হচ্ছে। অসুস্থতার কারণে সেইদিন কলেজে উপস্থিত ছিলেন না বিদ্যা। তার বন্ধুরা এই পোস্টার দেখে তাকে ফোন করে জানায়। পরে বিদ্যা বালান বোনের সাথে অডিশন দিতে যান। প্রায় এক হাজার আগ্রহীর মধ্যে মাত্র ৩০ জনকে নেওয়া হয়। বিদ্যা নির্বাচিত হন। এতে তার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। পুরোদমে চলে সিরিয়ালের শুটিং। খুব ভালোভাবে শেষ হয় শুটিং। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই সিরিয়াল আর কখনো রিলিজ হয়নি। এতে বিদ্যা বালানের মন ভীষণভাবে ভেঙে যায়। তিনি দমে না যেয়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। তামিল ভাষার কিছু সিনেমার জন্য প্রস্তাবও পান। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে তাকে সাইন করানোর পরেও সিনেমার পরিচালকেরা সিনেমা থেকে বের করে দিতে থাকেন। প্রায় সাতটি তামিল সিনেমার জন্য তিনি চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন এবং ৭টি থেকেই তাকে বাতিল করা হয়। একটা সময় সবাই সিনেমার জন্য তাকে অভিশাপ বলতেন। সেই সময়টা খুব খারাপ গিয়েছে তার। কিন্তু তিনি আশা ছাড়েননি। প্রতিদিন সকালে উঠে ভাবতেন আজ একটা নতুন দিন, আজ আবার নতুন করে চেষ্টা করবেন।

ছোটবেলা থেকেই তিনি সবচেয়ে বেশি নিজের ব্যাপারে যা শুনেছেন তা হলো ‘মোটা’। অবশ্য এতে তার নিজের খুব বেশি আপত্তি ছিল না। কিন্তু তাও আশেপাশের সবাই তাকে প্রতিদিন মনে করিয়ে দিতেন যে তিনি মোটা। তার মা তাকে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠিয়ে নিজে যেতেন হাঁটতে; যা তিনি খুব বেশি অপছন্দ করতেন। মোটা শরীরের জন্য অনেক সিনেমা থেকে তাকে না করা হয়। অনেকে এটাও বলেন, ‘নিজের শরীর আয়নায় দেখেছো?’ এইসব কিছু মিলিয়ে বিষণ্নতা থাকে ঘিরে ধরে। তখন তিনি নিজের উপর রাগ করে কঠিন ডায়েট ও জিম করা শুরু করেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি ব্যায়াম করতেন। না খেয়ে থাকতেন। এতে তার রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। এরপর তার শরীরে কিছু হরমোনাল ইমব্যালেন্স দেখা দেয় যা তার ওজন বেড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী ছিল। তিনি কোথাও গেলেই তিনি কেমন আছেন জিজ্ঞাসা না করেই বলা হতো ‘তোমার ওজন কি আরো বেড়েছে?’। যার জন্য তিনি বেশ হীনমন্যতার ভুগতেন। ওজন কমানোর জন্য তিনি নানারকম ভুল পন্থা অবলম্বন করতেন। সেইসব ভুলের মাশুলও গুনতে হতো। একবার তিনি কারো কাছে শুনেছিলেন যে অনেক বেশি পরিমাণ পানি পান করলে ওজন কমে। সেই কথা শুনে তিনি প্রতিদিন ১০ লিটার করে পানি খাওয়া শুরু করেন। প্রায় পাঁচ দিন এমন করার পর আচমকা তার বমি শুরু হয়। বমি বন্ধ করার জন্য তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।

দিনের পর দিন তিনি না খেয়ে থাকে অসুস্থ হয়ে যেতেন। অতিরিক্ত ব্যায়ামের ফলে তিনি একবার জিমে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। ভুল নিয়ম অনুসরন করে ডায়েট ও ব্যায়াম করার ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তেন। এরপরে হতাশায় ভুগে তিনি ব্যায়াম ডায়েট সব ছেড়ে দিতেন। এতে তার ওজন আবার দ্বিগুণ গতিতে বাড়তে শুরু করতো। তিনি ধীরে ধীরে নিজের ভুলগুলো বুঝতে পারেন। মানুষের কথা শুনে ওজন কমানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে যাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন। তিনি নিজেকে ভালোবাসা শুরু করেন, ঠিক করেন শুধু ওজন কমানোর জন্য ডায়েট আর ব্যায়াম করবেন না। সুস্থ জীবনযাপনের জন্য তিনি ডায়েট করবেন এবং স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে। তিনি যেমন তা নিয়েই তিনি কাজ করতে থাকেন।

২০১১ সালে বিদ্যা বালান ‘দ্যা ডার্টি পিকচার‘ সিনেমায় সিল্ক চরিত্রে অভিনয় করেন। সিনেমার স্বার্থে তার ওজন আরো বাড়াতে হয়। প্রায় ১০ কেজি ওজন বাড়ান তিনি। কিন্তু এই সিনেমায় তার বাড়তি ওজন সব মানুষ ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। হাজারো মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি সিনেমা রিলিজ হবার পরে। এই সিনেমায় মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখার পরই বিদ্যা বালান তার মোটা শরীরকে গ্রহণ করে ভালোবাসতে শুরু করেন। তিনি অনুভব করেছেন যে ভালো অভিনয় করলে দর্শকের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া যায়। শরীরের আকৃতি কেমন সেসব কোনো ভাবনার বিষয় না। তিনি মনে করেন ‘দ্য ডার্টি পিকচার’ সিনেমাটি তার চিন্তাভাবনায় আমূল এনেছে এবং সিনেমাটি তার সাফল্য সীমা ছুঁয়েছে।

বলিউডে তিনি ‘শাড়ি কুইন’ নামেও পরিচিত। তার সোশ্যাল মিডিয়াতে গেলে দেখা যায় এ যেন এক শাড়ির রাজ্য। তার ভক্তরা খুবই পছন্দ করে তার শাড়ি। অনেকেই তার ফ্যাশন ফলো করে থাকেন। কিন্তু এক সময় সবাই থাকে বলতো তার ফ্যাশন সেন্স ভালো না। শাড়ি ছাড়া কিছুতেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন না। ২০০৮ সালে ভারতের বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের সাথে দেখা হয় এবং তিনি তাকে বলেন যে যেহেতু বিদ্যা বালান শাড়ি পরতে ভালোবাসে তাহলে তার সবসময় শাড়িই পরা উচিত। বিদ্যা বালান তার কথা অনুযায়ী সব জায়গায় শাড়ি পরে যেতে থাকেন। একটা সময় এটা সবাই বেশ পছন্দ করা শুরু করে। বিদ্যা বালানকে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সিল্ক ও কাতান শাড়ি পরতে। তাছাড়া তিনি যেকোনো বড় ইভেন্টে নির্দ্বিধায় সাধারণ কটন শাড়ি পরে যান।

তিনি লক্ষ্য করেন যেদিন থেকে তিনি নিজেকে গ্রহণ করা শুরু করেছেন ঠিক সেদিন থেকেই পুরো দুনিয়া তাকে গ্রহণ করেছে। বিদ্যা বালান এখন তার ওজন নিয়ে মোটেও চিন্তিত নন। তিনি বিশ্বাস করেন প্রতিটি মানুষ তার নিজের মতো করে সুন্দর।

বিদ্যা চেষ্টা করেন স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করার, যাতে তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকেন। তিনি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ৩০ মিনিট মেডিটেশন করেন। যা তার মনকে শান্ত করে। সারাদিন আলাদা একটা সজীবতা দেয়। সকালে তিনি একটি স্বাস্থ্যসম্মত ব্রেকফাস্ট খান। তার নিজস্ব ট্রেইনার রয়েছে যে তাকে ব্যায়াম করিয়ে থাকেন। বিদ্যা বালান চেষ্টা করেন সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন ব্যায়াম করার। হরমোনাল ইমব্যালেন্স থাকার কারণে তিনি দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারেন না। তিনি জানান, তার পিসিওএস ওভারি সিনড্রোম রয়েছে যার কারণে অন্য দশজন মানুষের চাইতে তার ওজন কমাতে অনেক বেশি কষ্ট করতে হয়। তাই পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর কিছু খান, এতে তার মেটাবলিজম ঠিক থাকেন। তিনি প্রতিদিন রাতে ৮ ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করেন, এতে করে তিনি পরেরদিন এনার্জেটিক থাকেন। প্রতিদিন তিনি ১০ গ্লাস পানি পান করেন যা তাকে অনেক বেশি সতেজ রাখে। তিনি সব সময় পজিটিভ থাকার চেষ্টা করেন। মন ভালো রাখতে তিনি অবসর সময় গান শোনেন কিংবা বই পড়েন। বিদ্যা বালান খুব ভারী মেকআপ নিতে পছন্দ করেন না। তিনি কখনো চান না তার নিজস্বতা হারিয়ে যাক। তিনি বলিউডের একমাত্র অভিনেত্রী যিনি নির্দেশনা দিয়েছেন তার ছবি এডিট করা যাবে না। আজকাল বড় বড় শিল্পীরাও এডিট করে নিজের শরীরের আকৃতি ও রঙ বদলে ফেলে। তিনি পুরোপুরি এটার বিরোধী। বিদ্যা বালান নিজস্বতার মাঝে আনন্দ খুঁজে পান এবং সকলের মাঝে সেভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করতে চান।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আরশী

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two × 3 =