নিজেকে প্রমাণ করলেন মার্গট রবি

অপরাজিতা জামান

গত মাসে গোলাপি কাপড় পরে তোলা ছবিতে সামাজিকমাধ্যম সয়লাব হয়ে যায়। তবে গোলাপি রঙের এই আধিক্যটা ছিল সিনেমা হলে বেশি। গোলাপি রঙের প্রতি হঠাৎ সবার এমন ভালোবাসার কারণ, বার্বি সিনেমা। সিনেমা দেখতে গিয়ে নারী দর্শকই সেজেছিলেন বার্বি। এ ছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিশ্বব্যাপী আলোচিত অভিনেত্রী মার্গট রবি। চলুন জেনে নেই তার সম্পর্কে।

মার্গট রবি ১৯৯০ সালের ২ জুলাই কুইন্সল্যান্ডের ডালবিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন ফিজিও থেরাপিস্ট আর মায়ের ছিলেন খামার। চার ভাইবোনের মধ্যে রবি ছিলেন দ্বিতীয়। শৈশবটা বাবা-মায়ের স্নেহে ভাইবোনদের সাথে হেসে খেলে কাটলেও বিষাদের সুর বাজতে সময় লাগেনি। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে। রবি ও তার অন্য ভাইবোনদের আশ্রয় হয় মায়ের কাছে। বাবার সাথে কালেভদ্রে দেখা হতো তাদের। তবে তা নিয়ে অতটা আগ্রহী ছিলেন না ছোট্ট রবি। বেশিরভাগ সময় তিনি হেসে খেলে বেড়াতেন নানা-নানির খামারে। ছোটবেলা থেকে বেশ চটপটে ও উদ্যমী ছিলেন এ নায়িকা। মাঝে মাঝেই নিজের বাড়িতে শো করতেন তিনি। ছোটবেলায় একটি সার্কাস স্কুলে ভর্তি হন রবি। সেখান থেকে বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন তিনি। রবির কর্মঠ ও পরিশ্রমী গুণের প্রকাশ পেয়েছিল ছোটবেলায়।

এরপর ভর্তি হন সমরসেট কলেজের নাট্যবিভাগে। সমরসেট কলেজে পড়াকালীন একই সঙ্গে একাধিক চাকরি করতেন তিনি। একটি বার চালাতেন, পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ করতেন এবং পাশাপাশি অন্য কাজও করতেন। রবি অভিনয়ে মনযোগী হন স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর। এ সময় অভিনয়ে ক্যারিয়ার গড়তে তিনি মেলবোর্নে চলে যান। তবে অভিনয় শুরু করেছিলেন তার আগে থেকেই। স্কুলে পড়াকালীন প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। দুটি চলচ্চিত্রেই তার চরিত্র ছিল খুব ছোট। পরে ২০০৮ সালে টিভিপর্দায় নাম লেখান। এ সময় ‘সিটি হোমিসাইড’ নামের একটি সিরিজে অতিথি চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। পরে ‘দ্য এলিফ্যান্ট’ প্রিন্সেস নামের একটি সিরিজেও দেখা যায় তাকে।

রবি ২০০৮ সালে ‘নেইবরস’ নামের একটি টিভি সিরিজে যুক্ত হন। এখানে ডোনা ফ্রেডম্যান নামের একটি অতিথি চরিত্রে দেখা যায় তাকে। তিন বছর এই চরিত্রে কাজ করে দর্শক ও সমালোচকদের বেশ প্রশংসা কুড়ান তিনি। একইসঙ্গে পান লোজি অ্যাওয়ার্ড নামের একটি পুরস্কারের মনোনয়ন। ২০১১ সালে একটি সুযোগ আসে রবির। তিনি ‘পেন আম’ নামের একটি টিভি সিরিজে যুক্ত হন। এতে ‘লাওরা ক্যামেরন’ চরিত্রে অভিনয় করেন এ অভিনেত্রী। শুরুতে সিরিজটি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও এক মৌসুম শেষে বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৩ সালটি মার্গটের ক্যারিয়ারের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সে বছর তিনি ‘এবাউট টাইম’ নামের একটি কমেডি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

এতে সহশিল্পী হিসেবে মার্গট পান ডমনল গ্লেসন ও র‌্যাচেল অ্যাডামসকে। এই ছবিতে এক তরুণের গল্প বলা হয় যে নিজের অতীত ও ভবিষ্যৎ বদলে দিতে চায়। ছবিটি ব্যবসাসফল হওয়ায় রবি’র ক্যারিয়ারের পালে সুসময়ের হাওয়া লাগে। ফলে ব্যস্ততাও বেড়ে যায় এ অভিনেত্রীর। একই বছর ‘দ্য ওলফ অব ওয়াল স্ট্রিট’ নামের ছবিতে অভিনয় করেন। আত্মজীবনীমূলক এই ছবিটি অভিনেত্রী হিসেবে মার্গট রবি’র ক্যারিয়ারকে বেশ পোক্ত করতে সহায়তা করেছিল। ছবিটির পাশাপাশি মার্গটও বেশ প্রশংসিত হন। বিশ্বব্যপী আলোড়ন তোলা এ ছবিটি আয় করেছিল ৩৯২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফলে আন্তর্জাতিকভাবে মার্গটও বেশ পরিচিতি পান। ছবিটির জন্য এমটিভিসহ বেশকিছু অ্যাওয়ার্ডের জন্যও মনোনীত হয়েছিলেন তিনি।

সেইসঙ্গে বেস্ট নিউকামার ক্যাটাগরিতে পান ‘এমপায়ার অ্যাওয়ার্ড’। ধীরে ধীরে রবি হয়ে উঠতে থাকেন হলিউডের ব্যস্ততম অভিনেত্রী। ২০১৫ সালে তার অভিনীত চার চারটি ছবি মুক্তি পায়। এরমধ্যে একটি হলো ‘ফোকাস’। বিশ্বব্যপী ১৫৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছিল ছবিটি। সেইসঙ্গে পর্দায় মুগ্ধতা ছড়ানোর জন্য রবি হয়েছিলেন প্রশংসিত। একইবছর মুক্তি পাওয়া তার দ্বিতীয় ছবি ‘সুইট ফ্রান্সিস’ ছিল উপন্যাস আশ্রিত। ২০০৪ সালে প্রকাশিত আইরিন নেমিরোভস্কির একই নামে প্রকাশিত উপন্যাসের একটি অংশ নিয়ে নির্মিত হয়েছিল এ ছবিটি। ছবির গল্প দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের। এতে তিনি অভিনয় করেছিলেন ফ্রান্স দখলে ব্যস্ত এক জার্মান সৈন্যের জন্য অপেক্ষারত তরুণী হিসেবে। রবির ২০১৫ সালে মুক্তি পাওয়া তৃতীয় ও চতুর্থ ছবির নাম যথাক্রমে ‘জেড ফর জাচারিয়াহ’ ও ‘বিগ শর্ট’। দুটি ছবিই বাণিজ্যিকভাবে সাফল্য পায়। ফলে এক বছরে চারটি ব্যবসাসফল ছবি দিয়ে হলিউডে সফল নায়িকা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেন এ তারকা। সেইসঙ্গে সিনেমাপ্রেমীদের প্রিয় মুখ হয়ে ওঠেন তিনি। হলিউড জয় করা মার্গটের কাছে ২০১৬ ছিল বিশ্বজয়ের বছর। এ বছর বেশকিছু ছবি মুক্তি পায় তার। এগুলোর একটি হলো ‘হুইস্কি ট্যাঙ্গো ফক্সট্রোট’। আফগানিস্তানে তালেবানদের নিয়ে নির্মিত হয়েছিল এ ছবি। এরপর তিনি অভিনয় করে ‘দ্য লিজেন্ড অব টারজান’ সিনেমায়। ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে হোঁচট খেলেও অভিনয় দিয়ে উতরে যান রবি।

এ তারকার ২০১৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অন্যতম একটি কাজ ‘সুইসাইড স্কোয়াড’। এ ছবিটির চরিত্রের জন্য নিজেকে তৈরি করতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়ে মার্গটকে। ছবিটি বিশ্বব্যাপী ৭৪৬.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে। সিনেমা বোদ্ধারা মনে করেন, ওই সাফল্যের পেছনে মার্গটের অবদানই বেশি ছিল। ফলে ‘স্টেফেনি জাকারেক’ চরিত্রটির জন্য সংবাদমাধ্যমগুলো ভূয়সী প্রশংসা করে এ অভিনত্রীর। শুধু সৌন্দর্য ও অভিনয় দিয়েই মুগ্ধ করেননি মার্গট। প্রশংসা কুড়িয়েছেন কণ্ঠ দিয়েও। ২০১৮ সালে একটি অ্যানিমেশন সিনেমায় ভয়েস আর্টিস্ট হিসেবে যুক্ত হন তিনি। ‘পিটার র‌্যাবিট’ নামের এ চলচ্চিত্রে ‘ফ্লপসি র‌্যাবিট’ চরিত্রে কণ্ঠ দেন তিনি। এ ছবিটির বক্স অফিসের আয় ছিল দেখার মতো। ছবিটি বিশ্বব্যাপী আয় করেছিল ৩৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৮ সালে ‘সাওইর্স রোনান’ নামের একটি ছবিতে যুক্ত হন তিনি। এতে তাকে দেখা যায় রানি প্রথম এলিজাবেথের চরিত্রে। এলিজাবেথের চরিত্রটির জন্য বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে। রোজ তিন ঘণ্টা করে প্রস্থেটিক মেকাপ নিয়ে বসে থাকতে হতো চেয়ারে। চরিত্রটির জন্য সমালোচকদের প্রশংসার পাশাপাশি বাফটা অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন তিনি। এভাবে একের পর দর্শক ও বোদ্ধাদের তৃপ্ত করে মার্গট নিজের পথটি করে নিয়েছিলেন বেশ মসৃণ। তারই ধারাবাহিকতায় তাকে দেখা যায় ‘ড্রিমল্যান্ড’ চলচ্চিত্রে। ইতিহাসভিত্তিক ছবিটি আয়ের ঘরে তুলে নিয়েছিল তিন শতাধিক মার্কিন ডলার। এ সময় মার্গট হলিউডে আত্মপ্রকাশ করেন এক নতুন পরিচয়ে। প্রযোজনায় নাম লেখান তিনি। প্রযোজক হিসেবে কাজ করেন কমেডি সিরিজ ‘ডলফেস’-এ। সিরিজটি ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বেশ সাফল্যের সাথেই প্রচারিত হয়।

মার্গটের ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য একটি সিনেমা ‘ওয়ান্স আপন টাইম ইন হলিউড’। রোমান্টিক কমেডি ঘরানার এ ছবিতে তার বিপরীতে অভিনয় করেন হলিউডের দুই বাঘা অভিনেতা লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও ও ব্র্যাড পিট। পিট ও ক্যাপ্রিওর সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছিলেন তিনি। দর্শক নন্দিত হয়েছিল সিনেমাটি। বিশ্বব্যপী তুলে নিয়েছিল ৩৭৪.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ছবিটি বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ কান চলচ্চিত্র উৎসবেও প্রদর্শিত হয়েছিল। এসময় ‘বোম্বশেল’ নামে আরও একটি সিনেমায় অভিনয় করেন অভিনেত্রী। এখানে তাকে একজন সংবাদকর্মীর চরিত্রে দেখা যায়। যৌন হেনস্তার গল্প বলা হয়েছিল সিনেমাটিতে। ছবিটি তাকে ভূয়সী প্রশংসা এনে দেয়। সেসময় সংবাদমাধ্যমগুলো ওয়ান্স আপন টাইম ইন হলিউড ও বোম্বশেল ছবি দুটিকে রবির ক্যারিয়ারের অন্যতম সিনেমা বলে আখ্যায়িত করেছিল। ২০২০ সালে দুটি ছবি মুক্তি পায় রবির। এর একটি হলো ‘বার্ডস অব প্রে’। অন্যটি হলো ‘প্রমিজিং ইয়ং ওমেন’। দুটি ছবিই বেশ প্রশংসিত হয়েছিল সেসময়।

‘ইয়ং ওমেন’ ছবিতে মার্গটের চরিত্রটি ঘনিষ্ঠ বন্ধুর দ্বারা ধর্ষিত এক নারীর ধর্ষণ ও হত্যার বিচারের জন্য সোচ্চার হওয়া এক চরিত্র। এরপরই ‘সুইসাইড স্কোয়াড’ ছবিটি নিয়ে আসে তার সিকুয়েল। এ ছবিতেও আবার নিজের দ্যুতি ছড়ান রবি। এছাড়া এ তারকা অভিনীত আরও অনেক ছবি রয়েছে। এরমধ্যে কমেডি ঘরানার সিনেমা ‘ব্যবিলোন’ ও ‘অ্যাস্টেরয়েড সিটি’ উল্লেখযোগ্য। এদিকে চলতি বছরের জুলাইতে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছেন তিনি। তার অভিনীত ‘বার্বি’ সিনেমাটি দেখতে সবাই মৌমাছির মতো ভিড় জমিয়েছিল সিনেমা হলে। এতে বার্বি ডলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন রবি। চরিত্রটি বার্বি ইউনিভার্স থেকে পৃথিবীতে এসে বিভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। এরইমধ্যে ছবিটি বিশ্বব্যাপী পেয়েছে ব্যপক জনপ্রিয়তা। ফলে আবারও নিজেকে প্রমাণ করেছেন আতর্জাতিক অভিনেত্রী হিসেবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × 1 =