এশিয়া কাপ শেষে কি পেলো বাংলাদেশ?

সালেক সুফী

অনেক প্রশ্নের অবতারণা ঘটিয়ে শেষ হলো হাইব্রিড পদ্ধতিতে খেলা দক্ষিণ এশিয়ার ছয় দেশের এশিয়া কাপ ক্রিকেট। পাকিস্তানের আয়োজনে অনুষ্ঠিত এই টুর্নামেন্ট ভারত পাকিস্তান রাজনৈতিক বৈরিতার কারণে পাকিস্তান এবং শ্রীলংকা দুই দেশে হাইব্রিড পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়। টুর্নামেন্টের ৪টি ম্যাচ পাকিস্তানে এবং ফাইনাল সহ ৯টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় শ্রীলংকায়। অনেক নাটকীয়তার পর টুর্নামেন্টের হট ফেভরিট ভারত একেবারে একপেশে ফাইনালে শ্রীলংকাকে ১০ উইকেটে  ক্রিকেট ইতিহাসের  সংক্ষিপ্ত সময়ে (১৫.২+৬.১=২১.৩ ওভার) হারিয়ে অষ্টম শিরোপা জিতে নেয়।

আসন্ন বিশ্বকাপ সামনে রেখে এবারের বিশ্বকাপ দক্ষিণ এশিয়ার ৫টি দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা এবং বাংলাদেশের জন্য নিজেদের দলের চূড়ান্ত প্রস্তুতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টুর্নামেন্ট শেষে এখন চলছে পর্যালোচনা এবং মূল্যায়ন। অনেক ক্রিকেট প্রেমিকদের হতবাক করেই অন্যতম ফেভরিট দল পাকিস্তান ফাইনালে উঠতে বাড়তো হয়েছে।

উল্লেখ্য যে ১৬ বারের এশিয়া কাপ আয়োজনে এখন পর্যন্ত কোনো ফাইনালে বিশ্ব ক্রিকেটের দুই পরাশক্তি পাকিস্তান এবং ভারত মুখোমুখি হয়নি। এবার নিয়ে আট বার শিরোপা জিতেছে ভারত, শ্রীলংকা জিতেছে ছয় বার, পাকিস্তান দুই বার। বাংলাদেশ তিন বার ফাইনালে উঠেও শিরোপা জিততে পারেনি।

ছয় দলের এই টুর্নামেন্টে এবার প্রাথমিক রাউন্ডে দুই গ্রুপে তিনটি দল বিভক্ত হয়ে খেলেছিল। গ্রুপ এতে পাকিস্তান, ভারতের সঙ্গী ছিল একমাত্র আইসিসি সহযোগী দেশ নেপাল।  বি গ্রুপে ছিল বাংলাদেশ, শ্রীলংকা এবং আফগানিস্তান। সঙ্গত কারণে এ গ্রুপ থেকে ভারত পাকিস্তানের পরবর্তী গ্রুপ অফ ফোরে উত্তরণে অসুবিধা হয়নি।

গ্রুপ পর্যায়ে পাকিস্তান ভারতের হাই ভোল্টেজ খেলাটি বৃষ্টির কারণে ভারত ইনিংস শেষে পরিত্যক্ত হয়. ম্যাচটিতে পাকিস্তানের তুখোড় পেস বলার ত্রয় ভারতের শক্তিশালী বাটিংয়ে  কাঁপন ধরিয়েছিল। নেপাল পাকিস্তান, ভারত কোনো দলকেই পরীক্ষার মুখে ফেলতে পারেনি। গ্রুপ বির খেলায় শক্তিশালী বাংলাদেশকে প্রথম খেলায় পরাজিত করে শ্রীলংকা শুভ সূচনা করে।

নানা সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশের সূচনা ম্যাচটি ভালো হয়নি। বাংলাদেশ পরের ম্যাচে আফগানিস্তানকে বিশাল ব্যাবধানে সহজে পরাজিত করে গ্রুপ অফ ফোরে উত্তীর্ণ হয়। শ্রীলংকা-আফগানিস্তানের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে শ্রীলংকা জয়ী হয়ে  বি গ্রুপের শীর্ষ অবস্থান নিয়ে গ্রুপ অফ ফোরে আসে।

গ্রুপ অফ ফোরের প্রথম খেলায় পাকিস্তান বাংলাদেশকে বিপর্যস্ত করে। শ্রীলংকার বিরুদ্ধে খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করেও জয় বঞ্চিত হয় বাংলাদেশ। ভারত পাকিস্তানকে তুলোধুনো করে বিপর্যস্ত করলে পাকিস্তান-শ্রীলংকা খেলাটি অলিখিত সেমি ফাইনালে পরিণত হয়।

পাকিস্তানের মূল অস্ত্র নাসিম শাহ এবং হারিস রউফ আনফিট হয়ে পড়ায় দলের ভারসাম্য নষ্ট হয়। আক্রমণ দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও শ্রীলংকার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর হেরে যায় পাকিস্তান। টুর্নামেন্টে ধারাবাহিক ভাবে ভালো খেলেই ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি হয় শ্রীলংকা।

ভারত বাংলাদেশের শেষ খেলাটি টুর্নামেন্টের ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে দুটি দল মূল খেলোয়াড়দের বিশ্রাম দিয়ে বিকল্প খেলোয়াড়দের ম্যাচ খেলার সুযোগ দেয়।  বৃষ্টিবিঘ্নিত খেলায় ভালো খেলে বাংলাদেশ ভারতকে হারিয়ে প্রমাণ করে ভারত টুর্নামেন্টে অজেয় দল ছিল না। নিজেদের সামর্থের সঠিক ব্যবহার করে খেললে বাংলাদেশের ফাইনাল খেলা সামর্থের বাইরে ছিল না।

অবশেষে ফাইনালে দুর্বোধ্য কারণে শ্রীলংকা ভারতের বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কেন শ্রীলংকা টস জয়ী হয়ে ব্যাটিং সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেটি বোধগম্য নয়। ভারতের কৃতিত্বপূর্ণ বোলিংকে প্রশ্নবিদ্ধ না করেও বলা যায় শ্রীলংকা বোলিং করার সিদ্ধান্ত নিলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারতো। ১৫.২ ওভার খেলে শ্রীলংকা সিরাজের (৬/২১ ) এবং বুমরাহ (৩/৩) বিধ্বংসী বোলিংয়ের মুখে মাত্র ৫০ রানে গুটিয়ে যায়।

ভারত মাত্র ৬.১ ওভারে ৫১/০ করে ১০ উইকেটের বিশাল ব্যাবধানে লংকা জয় করে। খেলা শেষেই আকাশ ভেঙে নাম বৃষ্টি। এই টুর্নামেন্টে ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলংকার বিরুদ্ধে দাপুটে জয় দিয়ে বিশ্বকাপের প্রতিদ্বন্দ্বীদের জোরালো সতর্ক বাণী জারি করে। আইসিসি ওডিআই র‌্যাংকিংয়ে শীর্ষে থাকা দল নিজেদের দলের সীমিত বোলিং এবং কিছুটা ভারসাম্যহীনতার কারণে ব্যর্থ হয়।  ভারতের বিরুদ্ধে বিশাল ব্যাবধানে পরাজয় ওদের একপেশে বোলিং এবং ব্যাটিং গভীরতার অভাব উন্মুক্ত করে।

শ্রীলংকা দলের প্রথম সারির বোলাররা আনফিট থাকা তরুণ বোলিং আক্রমণ নিয়ে ধারাবাহিক ভালো খেলেও ফাইনাল খেলায় শোচনীয় ভাবে হেরে কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়। আফগানিস্তান প্রথম খেলায় বাংলাদেশের কাছে হেরে পিছিয়ে পড়েছিল। শ্রীলংকার বিরুদ্ধে ম্যাচে সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেও ভাগ্যের পরিহাসে চুলচেরা ব্যাবধানে পরাজিত হয়ে বিদায় নেয়।  ওদের দুটি খেলায় পাকিস্তানে ছিল। শ্রীলংকার স্পিন সহায়ক উইকেটে খেলা হলে ওদের স্পিনাররা বাড়তি সুবিধা পেতো।

বাংলাদেশের অর্জন:  বাংলাদেশের অধিনায়ক সঠিক বলেছে এশিয়া কাপ ছিল বাংলাদেশের রিয়ালিটি চেক। অভিজ্ঞদের উপেক্ষা করে তরুণদের দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার স্থান এশিয়া কাপের মত বৈষয়িক টুর্নামেন্ট নয় হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছে বাংলাদেশ। তামিম, লিটনের অবর্তমানে বাংলাদেশের টপ অর্ডার ছিল নড়বড়ে।  দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ভালো খেলতে থাকা নাজমুল হোসেন শান্ত আনফিট হয়ে পড়ে সংকট তরান্বিত হয়।

লেট্ মিডল অর্ডার ব্যাটিং একমাত্র ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচটি ছাড়া সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। প্রমাণ হয়েছে অভিজ্ঞ মাহমুদুল্লাহকে উপেক্ষা করা বিশাল ভুল হয়েছে। তবে টুর্নামেন্ট জুড়েই ভালো বোলিং করেছে বাংলাদেশের তরুণ উদীয়মান পেস বোলিং ইউনিট।  বাংলাদেশের বিশ্ব সেরা চৌকষ খেলোয়াড় অধিনায়ক ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচটি ছাড়া নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেনি।

যাহোক ভারতের বিরুদ্ধে স্বস্তির জয়, নাজমুল শান্ত, তৌহিদ হৃদয় এবং মেহেদী মিরাজের ব্যাটিং সাফল্য বাংলাদেশের বড় অর্জন। টপ অর্ডার এবং লেট্ মিডল অর্ডার ব্যাটিং সুসংহত করে বিশ্বকাপের বাংলাদেশ স্কোয়াড নির্বাচন করলে বাংলাদেশ ডার্ক হর্স পরিণত হবে। ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশ সেই ইঙ্গিত দিয়েছে।

সালেক সুফী: আন্তর্জাতিক ক্রীড়া বিশ্লেষক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

seven − one =