হাঁপানি রোগ

ময়ূরাক্ষী সেন

যেকোনো রোগের প্রকোপ শীতের সময় বেড়ে যায়। তবে আরেকটি কষ্টদায়ক রোগ এ সময় বেড়ে যায় তা হলো হাঁপানি। যাদের আগে থেকেই হাঁপানি সমস্যা রয়েছে তাদের শীতের সময় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয়, কিন্তু যাদের হাঁপানি নেই তারাও শীতের সময় এর শিকার হয়। হাঁপানি রোগিরা এই শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে অনেক বেশি কষ্টের মুখোমুখি হয়। হাঁপানি মূলত শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত একটি রোগ। যখন শ্বাসনালি ফুলে যায় তখনি প্রদাহের সৃষ্টি হয়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়াকেই হাঁপানি বলে। হাঁপানির পাশাপাশি কাশি, বুকে কফ জমে থাকাসহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশে ইদানীং হাঁপানি রোগীর সংখ্যা আতঙ্কজনকভাবে বাড়ছে। এর কারণ হতে পারে পরিবেশ। পরিবেশ নানা কারণে দূষিত হচ্ছে ও দিনদিন ধুলাবালি বাড়ছে। আশেপাশের পরিবেশ দূষণ হাঁপানি রোগ সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশ ছাড়াও পুরো পৃথিবীতেও হাঁপানি রোগি অনেক বেশি। হাঁপানি রোগে মারা যাওয়া মানুষের মধ্যে ৮০%ই তৃতীয় বিশ্বের। পৃথিবীতে ২৪ কোটিরও বেশি মানুষ হাঁপানিতে আক্রান্ত। অনেক শিশুরা জন্মের পর পরই হাঁপানি রোগ নিয়ে পৃথিবীতে আসে, ছেলে শিশুদের এটি বেশি হয়ে থাকে। মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক হলে হাঁপানির সমস্যা দেখা দেয়।

বিভিন্ন হাসপাতালে গেলে দেখা যায় হাঁপানি রোগিদের লম্বা লাইন। ছোট থেকে বৃদ্ধ কেউ বাদ নেই। ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে অনেক বাবা মা হাঁপানি রোগ শনাক্ত করতে দেরি করে ফেলে কারণ তারা সাধারণত রোগের কথা প্রকাশ করতে পারে না। অনেক শিশুর বারো মাসই ঠান্ডা কাশি লেগে থাকে। সেসব শিশুদের হাঁপানি রোগ হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। শিশুর হাঁপানি সমস্যা দেখা দিলে স্বাভাবিকভাবেই মা-বাবা খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। অনেকে শিশুকে ভয়ে ঘরবন্দি করেও রাখেন। তবে সঠিকভাবে চিকিৎসা নিলে শিশুর হাঁপানি নিয়ে আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। তবে এটা সত্য এমন কোনো চিকিৎসা নেই যার মাধ্যমে হাঁপানি রোগ পুরোপুরি ভালো করা যায়। তবে এটি নিয়ন্ত্রণ করে রাখা সম্ভব। অনেকেই মনে করে থাকেন, হাঁপানি হলে আর স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায় না। এটা ঠিক যে একজন হাঁপানি রোগিকে অন্য যে কারো থেকে সাবধানে থাকতে হবে। কিন্তু তাই বলে সবকিছু বন্ধ করে রাখার কোনো বিষয় নেই। হাঁপানি একটি দীর্ঘমেয়াদি অ্যালার্জিজনিত সমস্যা, বেশিরভাগ অ্যালার্জিতে আক্রান্ত রোগিদের হাঁপানি সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে। হাঁপানি রোগিরা খুব বেশি সংবেদনশীল হয়ে থাকে বলে তাদের কিছুটা বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।

হাঁপানি কেন হয় তার সঠিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি তবে বংশগত কারণে অনেকের এ রোগ হয়ে থাকে। বাবা, মা কিংবা বংশের কারো হাঁপানি সমস্যা থাকলে শিশুকে ছোটবেলা থেকে সতর্ক রাখতে হবে। এছাড়া অতিরিক্ত ধুলাবালির মধ্যে থাকলে, কলকারখানায় কাজ করলে, অ্যালার্জি, তামাকের ধোঁয়া ইত্যাদি কারণে হাঁপানি হতে পারে। তবে বেশিরভাগ হাঁপানির কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। একজন রোগির তার জীবনদশায় যেকোনো সময় হাঁপানির লক্ষণ দেখা দিতে পারে। ঋতুর উপর নির্ভর করে হাঁপানি অনেক সময় বেড়ে যায় যেমন শীত ও বর্ষা। এ দুই সময়ে হাঁপানি প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শীতে সাধারণত আবহাওয়া অনেক বেশি রুক্ষ হয়ে যায় ও বায়ু দূষণের পরিমাণ বেড়ে যায়। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ কমতে থাকলে শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। শীতে আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য অনেকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এ সময় কমবেশি সবারই ঠান্ডাজনিত সমস্যা লেগে থাকে, এর পাশাপাশি অনেকের দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট। হাঁপানির লক্ষণ হচ্ছে নাক বন্ধভাব, চোখে চুলকানি, কাশি, হাঁচি ইত্যাদি। হাঁপানির সমস্যা থাকলে রোগি সাধারণত জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে থাকে। শ্বাসপ্রশ্বাসের সময় বুকে বাঁশির মতো হঠাৎ সাঁ সাঁ শব্দ এবং ঘুমের সময় মুখ হাঁ করে রাখে। অনেকের ঘুমের মধ্যে হাঁপানির টান উঠে, তখন রোগির ঘুম ভেঙে যায় ও উঠে বসে। হাঁপানি রোগিদের হার্টবিট অন্যদের তুলনায় বেশি থাকে। হাঁপানির দুটি প্রকারভেদ রয়েছে। একটি হলো তীব্র ধরনের যা আচমকা হয় ও দ্রুত তীব্র হতে থাকে। অন্যটি দীর্ঘমেয়াদি হাঁপানি যার তীব্রতা প্রথমে কম থাকে ও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। আচমকা আসা হাঁপানি টানের দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

ফুসফুসের ভেতর এক প্রকার তরল নিঃসৃত হয়, যা ব্রঙ্কিয়াল নিঃসরণ বলা হয়। এই তরলের সাহায্যে শ্বাসতন্ত্রের অভ্যন্তরে থাকা সিলিয়ারি কোষ শ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে ঢুকে পড়া ধুলাবালি ও জীবাণুকে বের করে দেয়। কিন্তু বাতাসে আর্দ্রতা কমে যাওয়ার কারণে শ্বাসতন্ত্রেও শুষ্কভাব তৈরি হয়। আর শীতে ঘাম কম হয় বলে অনেকে কম পানি পান করে ফলে ব্রঙ্কিয়াল নিঃসরণ কমে যায়। এই জন্যই মূলত হাঁপানিসহ নানা ধরনের শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা দেখা দেয়। পুরো শীত জুড়ে অনেকের কাশি লেগে থাকার পেছনে দায়ী এটি। আগেই জেনেছি হাঁপানি রোগের কোনো জাদুকরি চিকিৎসা নেই যা পুরোপুরি এ রোগ নির্মূল করে দিবে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চললে ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। হাঁপানি রোগ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গেলে প্রথম ধাপে চিকিৎসক কিছু ঔষধ দিয়ে থাকেন, যা হাঁপানির টান উঠলে কিছুক্ষণের মধ্যে আরাম দেয়। কিন্তু হাঁপানি রোগ উপশমে পুরোপুরি ঔষধের উপর নির্ভরশীল হরে থাকলে চলবে না। ঔষধের পাশাপাশি লাইফস্টাইলের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে ঠিকমতো ঔষধ খাচ্ছে কিন্তু হাঁপানি রোগ নিয়ন্ত্রণে আসছে না, তাদের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় তারা সঠিক লাইফস্টাইলের মধ্যে নেই।

যেহেতু শীত চলে এসেছে তাই হাঁপানি রোগিদের বাড়তি প্রস্তুতি নিতে হবে। যারা প্রতিদিন বাইরে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করেন তাদের খুব ভোরে হাঁটতে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। কারণ এ সময়টায় খুব বেশি কুয়াশা থাকে। পর্যাপ্ত শীতের পোশাক পরতে হবে ও প্রতিদিন গরম পানি দিয়ে গোসল করতে হবে। ঠান্ডা খাওয়া থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। চেষ্টা করতে হবে একটু পর পর গরম পানি পান করার। শীতের সময় ধুলাবালি যেহেতু বেড়ে যায় তাই বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রথমে জানতে হবে হাঁপানি টান উঠার কারণগুলো কি। আসলে সবার কারণ এক হয় না। যেমন অনেকের ধুলাতে গেলে হাঁপানির টান উঠে, অনেকের ফুলের রেণুতে, অনেকের ঘরের কার্পেটের ধুলাতে শ্বাসকষ্ট হয়। আবার গরুর মাংস, চিংড়ি মাছ, ইলিশ মাছ, বেগুন ইত্যাদি খাবার খাওয়ার পর হাঁপানি দেখা দেয়। কারণগুলো শনাক্ত করে তা থেকে সাবধান থাকতে হবে।

অবহেলা না করে একজন হাঁপানি রোগির অবশ্যই সময়মতো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে ও চিকিৎসা নিতে হবে। স্পাইরোমেট্রি বা পিক ফ্লো মেট্রি পরীক্ষা, মেথাকলিন চ্যালেঞ্জ পরীক্ষা, স্কিন প্রিক টেস্ট ও রক্ত পরীক্ষার মতো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে হাঁপানি শনাক্ত করা হয়। হাঁপানি শনাক্ত হলে শ্বাসনালির ছিদ্রপথ প্রসারিত করার জন্য কিছু ঔষধ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। তীব্র শ্বাসকষ্টের জন্য ইনহেলার ও নেবুলাইজার নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। হাঁপানি রোগিদের কোনো অবস্থাতেই ঔষধ বাদ দেওয়া যাবে না, নিয়মিত ঔষধ খেতে হবে। চিকিৎসক ইনহেলারের পরামর্শ দিয়ে থাকলে তা সবসময় ব্যাগে রাখতে হবে।

হাঁপানি নিয়ে অনেকের কিছু ভুল ধারনা রয়েছে। অনেকে মনে করে থাকেন হাঁপানি ছোঁয়াচে, আসলে হাঁপানি ছোয়াচে নয়। আবার অনেকের ধারণা হাঁপানি থাকলে ব্যায়াম বা কোনো খেলাধুলা করা যাবে না। যা একদম ভুল, হাঁপানি রোগিরা অন্যদের মতো সব কাজেই অংশ নিতে পারবে। কিন্ত কোনোভাবে হাঁপানি রোগকে অবহেলা করা যাবে না, তা না হলে হাঁপানি মৃত্যুর কারণ হয়ে যেতে পারে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্বাস্থ্য কথা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

20 + nine =