বসন্তের সাজপোশাক

নাহিন আশরাফ

ফাগুনেরও মোহনায়

ফাগুনেরও মোহনায় মন মাতানো মহুয়ায়

রঙিন এ বিহুর নেশা কোন আকাশে নিয়ে যায়

ফাগুনেরও মোহনায়…

গানটি মনে করিয়ে দেয় ফাগুন দরজায় কড়া নাড়ছে। কনকনে শীতকে বিদায় জানিয়ে বসন্তে রঙের আগমন ঘটবে প্রকৃতি ও মানুষের জীবনে। কৃষ্ণচূড়ায় সেজে ওঠে পথঘাট, পাতা ঝরে যাওয়া মলিন গাছও ভরে উঠে সবুজ পাতায়। বাঙালির আবেগ বসন্তকে ঘিরে যেন চিরকালই। ফাগুনের ছোঁয়ায় নিজের ঘর সাজানো, মিষ্টি খাওয়া থেকে শুরু করে নানা রকম উৎসব নিয়ে আসে বসন্ত। কয়েক বছর ধরে বসন্ত উৎসব পালন করা হচ্ছে বেশ জোরেসোরেই। বসন্তকে ঘিরে হয় নতুন পোশাক কেনা ও বিশেষ সাজ। এবার রঙবেরঙের আয়োজন কিভাবে নিজেকে সাজাতে পারেন এই বসন্তে।

মেয়েদের বসন্ত

বসন্তের পোশাকে বাঙালিয়ানা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে বসন্তে এখন হলুদ পরতে হবে এই নিয়মের মধ্যে নিজেকে কেউ বেঁধে রাখে না। বসন্ত মানেই রঙ, তাই যেকোনো রঙে নিজেকে সাজিয়ে তোলা যেতে পারে। তবে সাজ যেমনই হোক চেষ্টা করতে হবে সাজের মধ্যে বাঙালিয়ানা ও ঐতিহ্য ধরে রাখবার। বসন্তের প্রধান পোশাক হচ্ছে শাড়ি। অনেক নারী শাড়ি ছাড়া বসন্ত কল্পনাই করতে পারে না। শাড়ি পরতে চাইলে বেছে নিতে পারেন ঐতিহ্যবাহী জামদানি কিংবা নকশী কাঁথার শাড়ি। যেকোনো বাঙালি উৎসবের সাথে জামদানি ও নকশীকাঁথা যেন একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে আছে। এছাড়া বেছে নেওয়া যেতে পারে গামছা প্রিন্টের শাড়ি। গামছা প্রিন্টের শাড়িগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের রঙ থাকায় আলাদা করে রঙ নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। বসন্তের দিন অনেকের অফিস কিংবা ক্লাস থাকতে পারে, সেক্ষেত্রে বেছে নেওয়া যেতে পারে সুতির শাড়ি। বসন্তের শাড়ি হিসেবে বেছে নিতে পারেন মনিপুরি শাড়ি।

একরঙা তাঁতের শাড়ির সঙ্গে গর্জিয়াস ব্লাউজ পরাটা এখন ট্রেন্ডে রয়েছে। অনেকে শাড়ি পরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। সেক্ষেত্রে পরা যেতে পারে কটন কুর্তি। ফ্যাশন হাউজগুলোতে পাওয়া যায় বিভিন্ন প্রিন্টের কুর্তি। বসন্তের জন্য বেছে নেওয়া যেতে পারে সুই সুতার কাজ করা বিভিন্ন কুর্তি। লুকে ফিউশন আনতে কুর্তির সাথে জিন্স পরা যেতে পারে, কুর্তিকে আরেকটু গর্জিয়াস করার জন্য উপরে একটি কটি পরা যেতে পারে। সাজে বৈচিত্র্য আনার জন্য স্কার্ট এবং টপস্ও পরা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে স্কার্ট আর টপসে যাতে দেশীয় ঐতিহ্যের কাজ থাকে। ফ্যাশন হাউজগুলো এখন দেশীয় ঐতিহ্য বজায় রেখে বিভিন্ন ওয়েস্টার্ন পোশাক বানাচ্ছে। ওয়েস্টার্ন পোশাকের মধ্যে এখন দেখা যাচ্ছে রিকশা প্রিন্ট, গামছা প্রিন্ট ও জামদানি মোটিফ। তবে বসন্তের পোশাকে একটু গাঢ় রঙকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। যেমন লাল, হলুদ, মেরুন, গাঢ় নীল, ফিরোজা ইত্যাদি। বসন্তের শুরুতেও বাতাসে ঠান্ডা ভাব থাকে। তাই পোশাক কিছুটা ভারী হলেও খুব বেশি সমস্যা হয় না। চাইলে পোশাকের সাথে মিলিয়ে পরা যেতে পারে পাতলা শাল কিংবা কটি।

বসন্তের গয়না

বসন্তের জন্য উপযোগী গয়না হতে পারে কাঠের গয়না। কাঠের গয়না দামে বেশ সাশ্রয়ী ও যেকোনো পোশাকের সাথে এটি খুব সহজে মানিয়ে যায়। কাঠের গয়নায় মধ্যে থাকে বিভিন্ন লতাপাতা ও ফুল। এছাড়া কুলা কিংবা বিভিন্ন পাখির আকৃতিও দেখা যায় কাঠের মালায়। কাঠের মালা কুর্তি ও ওয়েস্টার্ন পোশাকের সাথেও পরা যায়। যাদের বসন্তের দিন অফিসে যেতে হবে কিংবা হালকা সাজে থাকতে চান তাদের প্রথম পছন্দ হতে পারে কাঠের গয়না। দেশে বেশ জনপ্রিয় এন্টিক গহনা। এন্টিক গহনা যেকোনো রঙের পোশাকের সাথে ভালো লাগে। তাই বসন্তের সাজে বেছে নেওয়া যেতে পারে এন্টিক গয়না। সুতির শাড়ি সাথে বড় ঝুমকা পরা যেতে পারে। বাঙালি নারীর সাজ পূর্ণতা পায় না টিপ ও চুড়ি ছাড়া। বসন্তের সাজে হাত ভরে পরা যেতে পারে কাচের চুড়ি।

বসন্তের সাজ

পোশাকের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে সাজ বা মেকআপ। বসন্তের শুরুতে ত্বক থাকে শুষ্ক ও মলিন। তাই সাজ শুরু করার আগে নিজের ত্বক তৈরি করে নেওয়া খুব বেশি জরুরি। আগের দিন ত্বক খুব ভালো করে নারিকেল কিংবা অলিভ তেল দিয়ে মাসাজ করে নেওয়া যেতে পারে। এতে ত্বকের শুষ্কতা অনেকটা কমে আসবে, ত্বকের শুষ্কতা কমাতে না পারলে মেকআপ ঠিকমতো বসতে চাইবে না। ভালো মানের হাইড্রেটিং টোনার ব্যবহার করুন। চাইলে শসার রস কিংবা টমেটোর রস ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি খুব ভালো প্রাকৃতিক টোনার। ঠোঁট ফাটা কমিয়ে আনতে পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া মধু ও লেবুর মিশ্রণ ব্যবহার করা যেতে পারে। মধু যেকোনো ধরনের ত্বকের জন্য উপকারী ও ত্বকের যেকোনো সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে।

মেকআপের শুরুতে খুব ভালো করে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে। ময়েশ্চারাইজারের পর সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে। সানস্ক্রিন সূর্যের ক্ষতিকারক আলো থেকে সুরক্ষা দিবে। ফাগুনের দিনের সাজের জন্য হালকা মেকআপ করা যেতে পারে। বেইজ মেকআপের জন্য স্কিন টোনের সাথে মিলিয়ে ফাউন্ডেশন ব্যবহার করতে হবে। ফাউন্ডেশন এড়িয়ে যেতে চাইলে বিবি ক্রিম ও স্কিনের দাগের জন্য কনসিলার অ্যাপ্লাই করে নিতে হবে। এরপর মেকআপ সেট করতে লুজ পাউডার ব্যবহার করতে হবে। নাক ও গালে ব্লাশন ব্যবহার করে নিতে হবে। দিনের মেকআপে নুড শেইডের লিপস্টিক ব্যবহার করুন। আইলুকের জন্য পোশাকের সাথে মিলিয়ে শ্যাডো ব্যবহার করা যেতে পারে অথবা ব্রাউন শেডের শ্যাডো বেছে নেওয়া যেতে পারে। সাধারণত ব্রাউন শেড সব রঙের পোশাকের সাথে মানিয়ে যায়।

রাতের ক্ষেত্রে ভারী বেইজ মেকআপ করা যেতে পারে। রাতে লাল কিংবা নিজের পছন্দের যেকোনো লিপস্টিক ব্যবহার করুন। গ্লোলিয় লুকের জন্য হাইলাইটার ব্যবহার করুন। বসন্তে চোখের সাজে কাজল ব্যবহার এড়িয়ে যাওয়া যাবে না, কাজল ব্যবহারের ফলে বাঙালির সাজ আরও বেশি পরিপূর্ণতা পায়। সবশেষে মেকআপ সেটিং স্প্রে দিয়ে লক করে দিন, এতে সহজে মেকআপ উঠে যাওয়ার চিন্তা থাকবে না।

বসন্তে ছেলেদের পোশাক

সাজপোশাকের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে নারীদের জন্য আয়োজন থাকলেও ছেলেরা পিছিয়ে নেই বসন্ত উদ্্যাপনে। দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলোতে ছেলেদের জন্য আনা হয় বাহারি বসন্ত কালেকশন। ছেলেদের প্রথম পছন্দ থাকে পাঞ্জাবি। তাই তো বসন্ত আসতেই ধুম পড়ে যায় পাঞ্জাবি কেনার। সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় সুতির পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির মধ্যে করা হয় ব্লক প্রিন্টের কাজ ও নানা ধরনের নকশা। এছাড়া আরো লক্ষ্য করা যায় কলার কিংবা বুকে কাজের বৈচিত্র্য। পাঞ্জাবির হাতার মধ্যেও করা হয় বিভিন্ন নকশা। পাঞ্জাবি ছাড়াও ছেলেরা এখন পরছে বিভিন্ন রঙের টি-শার্ট। ফ্যাশন হাউজগুলো টি-শার্টের মধ্যে বিভিন্ন ঐতিহ্যের ছোঁয়া রাখার জন্য নকশা করছে। বসন্তকে কেন্দ্র করে ছেলেদের পোশাকে ফুল লতাপাতার বিভিন্ন মোটিফে কাজ করা হয়। ছেলেদের কালেকশনে আরো লক্ষ্য করা যায় ফতুয়া, অনেকে একে শর্ট পাঞ্জাবিও বলে থাকেন। ফাগুনের দিন পরা যেতে পারে শর্ট হাতার ফতুয়া। বসন্তে অনেক সময় ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যায় সেক্ষেত্রে পাঞ্জাবির উপর কটি পরা যেতে পারে।

কোথায় পাওয়া যাবে

বসন্তের কালেকশন পাওয়া যাবে ঘরের কাছের যেকোনো ফ্যাশন হাউজ গুলোতে। দেশীয় ফ্যাশন হাউজ যেমন আড়ং, দেশাল, বিবিয়ানা, অঞ্জনস ইত্যাদিতে প্রতি বছর আনা হয় বসন্তের বিশেষ কালেকশন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ফ্যাশন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

7 − one =