দখিন দুয়ার খোলা…

শবনম শিউলি

বসন্ত মানেই রঙ। আবার বসন্ত মানে বিষণ্ন বাতাস। পাতা গজানোর সময়, নতুনের আগমনের সময় বসন্ত। বসন্ত এলে মানুষের মনে সুখ, প্রেম আর বিষাদ একসঙ্গে দানা বাঁধে। বসন্ত একই সঙ্গে আনন্দ আর বিষাদকে ছায়া দিয়ে রাখে। বসন্ত মানেই রঙ্গ আবার সেই বসন্ত মানেই ধূসরতা। বসন্ত এলে মানুষের মনে জাগে প্রেম আবার কারো প্রাণে জেগে ওঠে বিচ্ছেদের কষ্ট। বসন্ত কারোও কাছে রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গান আবার বসন্ত কারো কাছে কামিনি রায়ের কবিতা। বসন্ত চুপিসারে এলেও মানুষের মনে খুব বড় রকমের নাড়া দিয়ে যায়। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের বসন্তই সুন্দর। তবে বাংলাদেশের বসন্তের এক অনন্য রূপ রয়েছে। ষড়ঋতুর এই দেশটিতে বসন্ত যে আসলেই ঋতুরাজ তার প্রমাণ মেলে এর প্রকৃতির রূপে।

বসন্তের আয়োজন গ্রাম আর শহর ভেদে ভিন্ন। সময়ভেদে বসন্ত আয়োজনেও এসেছে পরিবর্তন। এর ব্যাপকতা ও গুরুত্ব মানুষের কাছে ভিন্ন ভিন্ন। শহুরে বসন্ত অনেকটা ছকে বাধা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে চলে গেছে। গ্রামাঞ্চলে সেগুলো মেলাতে বিকশিত। ঋতুরাজ বসন্তের শুরুতেই প্রকৃতিতে আসে গাঢ় সবুজের ছড়াছড়ি। প্রকৃতির চারদিক পুরাতন পোশাক ফেলে নতুন পোশাকে হয়ে ওঠে অপরূপা। হাড় কাঁপানো শীত আর হিমেল হাওয়ার পাশাপাশি বিদায় নেয় প্রকৃতিতে বিরাজ করা রুক্ষতা। শীতে ঝরা পাতা যে শূন্যতার জন্ম দেয়, বসন্তের আগমনে তা অনেকটাই দূর করে দেয়। ভালোবাসা আর সৌন্দর্যের মায়ায় প্রকৃতিকে সতেজ করে তোলে গাছের নতুন পাতা। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে লাল, নীল, হলুদ, গোলাপিসহ বাহারি রঙের সব ফুল।

বাংলার এই অঞ্চলে, প্রাচীন আমল থেকেই বসন্ত উৎসব পালিত হচ্ছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালনের রীতি চলে আসছে। বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে বাংলাদেশে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদ্্যাপন করার রীতি চালু হয়। সেই থেকে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ বসন্ত উৎসব নিয়মিত আয়োজন করে আসছে। পহেলা বসন্ত উদ্্যাপনে পুরো শহর যেন বসন্তের রঙ বাসন্তী আর ভালোবাসার রঙ লালে ছেয়ে যায়। ফুলেল শোভা থাকে চারদিকে। ফাগুনের প্রথম প্রহরে ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করে নিতে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের। ভালোবাসার আবেশেই রাঙিয়ে ওঠে পহেলা ফাল্গুন। শীতের ঝরাপাতার সাথে বসন্ত আসে প্রকৃতিতে। এদেশের মানুষ গাছের ডালে নতুন পাতায় দেখতে পায় বসন্তের আগমনী বার্তা। শীতের ঝরাপাতা মাড়িয়ে আর কোকিলের ডাকের সাথে মিলেমিশে বাংলার বুকে আসে বসন্ত। পহেলা ফাল্গুনে এই বসন্তউৎসব পালন করা হয়। এদিন লাল, হলুদ রঙের পোশাক পরে খোপায় ফুল গুজে নারীরা ও তরুণীরা উৎসবে মেতে উঠেন। বসন্ত বরণের ঐতিহ্য বাঙালির চিরন্তন। তাই তো ফাগুনের প্রথম প্রহরেই নগরে বসন্ত উৎসব হয়। আয়োজনের উদ্যোগ নেয় জাতীয় বসন্ত উদ্্যাপন পরিষদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় সকাল থেকেই শুরু হয় নানা আয়োজন। বকুলতলা সাজে বাসন্তী রাঙা ভালোবাসার সাজে।

বাঙালি বেশ ভাগ্যবান কারণ এখানে ঋতুর আগমনী বার্তা নিয়ে আসে। ছয় ঋতুর এ দেশে প্রতিটি ঋতুতেই ফোটে স্বতন্ত্র কিছু ফুল। গোটা ঋতু জুড়ে আবেশ ছড়িয়ে ঋতুবদলের মধ্য দিয়ে ছুটি নেয়। শুরু হয় নতুন কোনো ফুলের দিন। শীতের শেষ ও বসন্ত শুরুর মাঝামাঝি সময়ই প্রকৃতি নিজেকে পাল্টে নেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। এসময় থেকেই গাছে ফুলের মুকুল দেখা দেয়। ধূসর কুয়াশা সরে গিয়ে বাগানজুড়ে খেলা করে সোনারোদ। আর ঋতুরাজের রাজসভায় আগমন ঘটে রঙিন সব ফুলের। যেমন শিমুল বসন্তের ফুল হলেও প্রকৃতিতে এর আগমন ঘটে শীতের শেষ থেকেই। বসন্ত মানেই রঙ কারণ বসন্ত মানেই ফুল। হাজার রঙের, হাজার জাতের ফুলেরা বসন্তকে করে তোলে আরও রঙিন। বসন্তে ফোটা ফুল হচ্ছে অশোক, আকআড়কাঁটা, হিমঝুরি, ইউক্যালিপটাস, রক্তকাঞ্চন, কুরচি, কুসুম, গাব, গামারি, গ্লিরিসিডিয়া, ঘোড়ানিম, জংলিবাদাম, জ্যাকারান্ডা, দেবদারু, নাগেশ্বর, পলকজুঁই, পলাশ, পাখিফুল, পালাম, বুদ্ধনারিকেল, মণিমালা, মহুয়া, মাদার, মুচকুন্দ, রুদ্রপলাশ, শাল, শিমুল, স্বর্ণশিমূল, ক্যামেলিয়া ইত্যাদি। আমাদের দেশে চেরি ফুল নেই। শীত শেষে ইউরোপের দেশগুলোতে চেরি ফুলের স্ফুরণ এক অপার্থিব আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। তেমনি আমাদের দেশে শিমুল, পলাশ আর দেবকাঞ্চন ফুলের শোভা দেখে মনটা পাগলামিতে পেয়ে বসে।

ফাল্গুন মাস এসেছে কি না, তা বোঝার জন্য এ দেশের প্রকৃতিরাজ্যে একটু দৃষ্টি ফেলতেই হবে। শীতের শীর্ণ পাতাঝরা গাছের ডালে ডালে ফুলের এক অপূর্ব উন্মাদনা। আবহাওয়াবিদরা সাধারণত অনেক জলবায়ু অঞ্চলে চারটি ঋতু সংজ্ঞায়িত করেন: বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ (পতন) এবং শীতকাল। এগুলি মাসিক ভিত্তিতে তাদের গড় তাপমাত্রার মান দ্বারা নির্ধারিত হয়, প্রতিটি ঋতু তিন মাস স্থায়ী হয়। সংজ্ঞা অনুসারে তিনটি উষ্ণতম মাস হল গ্রীষ্ম, তিনটি শীতলতম মাস হলো শীত, এবং মধ্যবর্তী অংশ হলো বসন্ত এবং শরৎ। আবহাওয়া সংক্রান্ত বসন্ত তাই, বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন তারিখে শুরু হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে, বসন্ত মাস হলো মার্চ, এপ্রিল এবং মে। অস্ট্রেলিয়ায়, বসন্ত মাস সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এবং নভেম্বর।

বসন্ত আর ফাল্গুন নিয়ে গান কবিতার শেষ নেই। কেউ বলেছেন ‘দিয়ে গেনু বসন্তের এই গান খানি’, কেউ লিখেছেন ‘বসন্ত মুখর আজি, দক্ষিণ সমীরণে মর্মর গুঞ্জনে, বনে বনে বিহ্বল বাণী ওঠে বাজি’। সর্বপরি বসন্ত মানেই দক্ষিণ হাওয়া। তাই বসন্ত এলেই মন বলে ওঠে ‘আজি দখিন দুয়ার খোলা…।’

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

10 − five =