ঊনিশে মামুনুর রশীদ

রোজ অ্যাডেনিয়াম

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের নাটককে যারা সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন মামুনুর রশীদ তাদের মধ্যে অন্যতম। একাধারে মঞ্চ নাটক চর্চার পথ তার হাত ধরে যেমন আলোকিত হয়েছে, তেমনই আলোকিত হয়েছে রঙিন পর্দার জগৎ। তিনি একইসঙ্গে নির্দেশক, নাট্যকার, অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক, কলামিস্ট ও সংগঠক। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি। দেশের প্রধান নাটকের দলগুলোর অন্যতম একটি আরণ্যক নাট্যদল। এই নাটকের দলের প্রতিষ্ঠাতা মামুনুর রশিদ। অর্ধশত বছর পার করেছে ‘আরণ্যক’। অনেক দর্শকনন্দিত নাটক উপহার দিয়েছে তারা। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সেসব নাটক প্রশংসিত হয়েছে নানা দেশে। এমন একজন গুণী মানুষ মামুনুর রশিদের অনেক গল্পই হয়তো জানেন না তরুণ প্রজন্ম।

ঊনিশে মামুনুর রশীদ

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেতা, নাট্যকার ও নির্দেশক মামুনুর রশীদের জন্মদিন ২৯ ফেব্রুয়ারি। ১৯৪৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতির পাইকড়া গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন মামুনুর রশিদ। এবারে ৭৬ বছরে পা দিলেন তিনি। তবে মজার ব্যাপার হলো দীর্ঘ জীবনে এই অভিনেতা নিজের জন্মদিন উদ্্যাপন করার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ১৮ বার! কারণ তার জন্মদিন ২৯ ফেব্রুয়ারি, আসে প্রতি চার বছর পরপর। ২০২৪ এর ২৯ ফেব্রুয়ারি পালিত হবে মামুনুর রশিদের ঊনিশতম জন্মদিন। মামুনুর রশিদের বাবার নাম হারুনুর রশীদ ও মায়ের নাম রোকেয়া খানম। পাঁচ ভাই চার বোনের মধ্যে মামুনুর রশিদ সবার বড়। কামরুল হাসান খান ও তারা খান, মামুনুর রশিদের ভাই। বাবা হারুনুর রশীদ ডাক বিভাগে সরকারি চাকরি করতেন। সেই সুবাদে দেশের বিভিন্ন জেলার স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করেছেন মামুনুর রশিদ। বিভিন্ন জেলায় ঘুরে কেটেছে তার বর্ণিল ছেলেবেলা।

মামুনুর রশিদের শিক্ষাজীবন

মামুনুর রশিদের শিক্ষাজীবনে রয়েছে চমক। এমন বিষয়ে তিনি পড়ালেখা করেছেন যার সঙ্গে নাটকের সম্পৃক্ততা নেই বললেই চলে। কিন্তু মনেপ্রাণে যিনি শিল্প-সংস্কৃতিকে লালন করেন তার কাছে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই শিল্প হয়ে ধরা দেয়। ঢাকা পলিটেকনিক থেকে পুরকৌশল বিভাগে ডিপ্লোমা করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএ ও এমএ ডিগ্রি লাভ করেন এই নাট্যব্যক্তিত্ব। এখন তিনি নিজেই যেন এক নাট্য বিশ্ববিদ্যালয়।

মামুনুর রশিদের নাট্যজীবন

১৯৬৭ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখতে শুরু করেন মামুনুর রশিদ। বিষয়বস্তু ছিল পারিবারিক। সেসময় কমেডি নাটকও তিনি লিখতেন। নাট্যশিল্পের প্রতি তার প্রকৃত ভালবাসা শুরু হয় টাঙ্গাইলে তার নিজ গ্রামে যাত্রা ও লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে তার নিবিড় পরিচয়ের সূত্র ধরে। তার যাত্রায় অভিনয় অভিজ্ঞতা নাট্যভাবনাকে প্রভাবিত করেছিল। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং জড়িত হন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধকালীন রচিত তার প্রথম নাটক ‘পশ্চিমের সিঁড়ি’ কলকাতার রবীন্দ্রসদনে মঞ্চায়নের চেষ্টা করেন। কিন্তু তার আগেই ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনতা অর্জন করায় নাটকটি আর তখন অভিনীত হয়নি। পরে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে অভিনীত হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর শুরু হয় তার আরেক নাট্যসংগ্রাম ‘মুক্ত নাটক আন্দোলন’। ১৯৭২ সালে কলকাতা থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে তিনি তৈরি করেন ‘আরণ্যক নাট্যদল’। তিনি টিভির জন্যে অনেক নাটক লিখেছেন এবং অভিনয় করেছেন। মঞ্চে মামুনুর রশীদ প্রথম নিদের্শনা দেন ‘মহাবিপ্লব’ (১৯৬৫) নাটকটি। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত বিশটিরও অধিক মঞ্চ নাটক নির্দেশনা দিয়েছেন।

টেলিভিশনে ও সিনেমায় মামুনুর রশীদ

মামুনুর রশীদ অভিনীত প্রথম টিভি নাটক মুনীর চৌধুরী রচিত ও আবদুল্লাহ আল মামুন প্রযোজিত ‘কবর’। তারপর অনেক নাটকে তাকে দেখা গেছে অভিনয় ও পরিচালনায়। তার নির্দেশিত সর্বশেষ ধারাবাহিক নাটক ‘আলতুর সাইকেল’। অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্রেও। ‘মনপুরা’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে দারুণ প্রশংসিত হন। গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘শঙ্খচিল’ চলচ্চিত্রে হেড মাস্টার চরিত্রে অভিনয় করেছেন মামুনুর রশীদ।

‘সংশপ্তক’ নাটক নিয়ে কিছু কথা

মামুনুর রশিদ অভিনীত তুমুল আলোচিত ও প্রশংসিত নাটকের নাম ‘সংশপ্তক’। একসময় এই ধারাবাহিক নাটকটি দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকতেন দর্শকরা। বিটিভিই ছিল তখন বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। এক সাক্ষাৎকারে এই নাটকটির পেছনের গল্প শুনিয়েছিলেন মামুনুর রশিদ। তিনি বলেন, “স্বাধীনতার আগে আমিই প্রথম ‘সংশপ্তক’-এর নাট্যরূপ দিয়েছিলাম। আবদুল্লাহ আল মামুন আমাকে নাট্যরূপ দিতে বলেন। তখন আমার বয়স ছিল ২২ বছর। বহুদিন আমি শহীদুল্লাহ কায়সারের পুরান ঢাকার বাড়িতে গিয়েছি। তার সঙ্গে কথা বলেছি। বেশিরভাগ সময় আমাকে গাড়িতে করে সংবাদ অফিসে নিয়ে আসতেন। অসম্ভব ব্যস্ত মানুষ ছিলেন তিনি। তার মধ্যে যতটা পারতাম তাকে নাটকের পাণ্ডুলিপি শোনাতাম। আবার বহু বছর পর এটি নতুন করে নাট্যরূপ দেওয়া হলে আবদুল্লাহ আল মামুন আমাকে অভিনয় করার প্রস্তাব দেন। আমি নিজে থেকে বলি সেকান্দার মাস্টার চরিত্রটি করতে চাই। এই রকম কাজ টেলিভিশনে সহজে আর হবে না।”

তরুণ প্রজন্মের কাজ নিয়ে মন্তব্য

নিয়মিত তরুণ প্রজন্মের কাজ দেখেন মামুনুর রশিদ। টিভি, থিয়েটার ও ওয়েব সিরিজ অনেক ধরনের কাজ হচ্ছে এখন। মামুনুর রশীদ বলেন, ‘কম-বেশি সবার কাজই দেখি। কারো নাম বলতে চাই না। কারো কারো কাজ দেখে প্রচণ্ড হতাশ হই। কারো কাজ দেখে আশান্বিত হই। কেউ কেউ আছেন টেকনিক্যাল বিষয়টি বোঝেন না। কেউ কেউ আছেন অভিনয়ও বোঝেন না। তারপরও কাজ করছেন। আবার কেউ কেউ খুবই ভালো করছেন। এতে করে যারা ভালো অভিনয় করেন তারাও গড়পড়তা অভিনয় করে যাচ্ছেন। তাদের বিষয় একটাই টাকা। কাজ করবেন টাকা পাবেন।’

মামুনুর রশিদের পরিবার

মামুনুর রশিদের দাম্পত্য জীবনের সঙ্গী গওহর আরা চৌধুরী। তাদের ঘর আলোকিত করেছে কন্যা শাহনাজ মামুন ও ছেলে আদিব রশীদ মামুন।

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

অনেক মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন মামুনুর রশিদ। তার হাত ধরে তৈরি হয়েছে অনেক স্বনামধন্য অভিনেতা ও অভিনেত্রী। গুরু হিসেবে সবসময় তাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পান। অভিনেতা হিসেবেও নন্দিত তিনি। এছাড়া ‘মনপুরা’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি। নাট্যকলায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১২ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলেও স্বৈরশাসনের প্রতিবাদ স্বরূপ তিনি পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যান করেন।

আরণ্যকের ৫০ বছর

মুক্তিযুদ্ধের পর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে নব-উদ্যমে শুরু হয়েছিল নবধারার নাট্যচর্চা। গড়ে উঠেছিল গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন। গ্রুপ থিয়েটার চর্চার ৫০ বছর পেরিয়েছে কিছুদিন আগেই। বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনে যে কয়েকটি নাট্যদল সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে ‘আরণ্যক নাট্যদল’ তাদের অন্যতম। ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে নাট্যচর্চা শুরু করে আরণ্যক নাট্যদল। ওই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি শহীদ মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকটি দিয়ে প্রথম মঞ্চে আসে তারা। নাটকটির প্রথম মঞ্চায়নে অভিনয় করেছিলেন প্রয়াত সুভাষ দত্ত, আলী যাকের, ইনামুল হক। নির্দেশনা দিয়েছিলেন মামুনুর রশীদ। ‘নাটক শুধু বিনোদন নয়, শ্রেণিসংগ্রামের সুতীক্ষ্ণ হাতিয়ার’ সেøাগান নিয়ে আশির দশকে সারা দেশে মুক্তনাটক আন্দোলন গড়ে তোলে আরণ্যক। ৫০ বছরের যাত্রায় মুক্তনাটক আন্দোলন আরণ্যকের একটি বড় সফলতা বলে মনে করেন নাট্য বিশ্লেষকরা। এছাড়া ১৯৮২ সালে স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাংলা একাডেমির বটমূলে ‘মে দিবস’ নাটক মঞ্চস্থ করে আরণ্যক। এরপর থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রতিবছর মে দিবস উদযাপনের মধ্য দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের কথা বলে চলেছে আরণ্যক। আরণ্যকের মে দিবস উদযাপন এখন জাতীয় উদযাপনের অংশ হয়ে উঠেছে। উৎসব আয়োজনে আরণ্যক বলছে, স্বাধীনতার সমবয়সী বাংলাদেশের নব নাট্যচর্চায় আরণ্যক নাট্যদল প্রতিনিয়ত শিল্পের সৃজনে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে সামাজিক ক্রিয়ায় যুক্ত করার মাধ্যমে। আরণ্যকের নাট্যকার, নির্দেশক, ডিজাইনার, অভিনেতা-অভিনেত্রী, নেপথ্যকর্মীরা নতুন নতুন উপস্থাপনার ভাষায় তুলে ধরেছে নিজেদের। আরণ্যকের আলোচিত নাটকগুলোর মধ্যে আছে ‘কবর’ ‘ওরা কদম আলী’, ‘নানকার পালা’, ‘ইবলিশ’, ‘সংক্রান্তি’, ‘ময়ূর সিংহাসন’, ‘রাজনেত্র’, ‘কবর’, ‘রাঢ়াঙ’, ‘কহে ফেসবুক’।

শেষ কথা

মামুনুর রশিদের সংস্কৃতি আন্দোলনের সহযোদ্ধা ও বন্ধুবর নাট্যজন নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু দারুণ একটি মন্তব্য করেন মাঝে মধ্যেই। তিনি বলেন, “ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলা নাট্যচর্চায় কিংবদন্তি হয়ে আছেন পশ্চিমবঙ্গের উৎপল দত্ত। তেমনি আমাদের কাছে মামুনুর রশীদই উৎপল দত্ত। নিঃস্বার্থভাবে নাটক, মঞ্চ ও অভিনয় নিয়ে তার যে সংগ্রাম এবং ভালোবাসা সেটা দারুণভাবে অনুপ্রেরণা যোগায় নতুনদের। মামুন ভাইকে আমি বলি ‘নিঃসঙ্গ পথিক’। শুরু থেকে যে আদর্শ নিয়ে কাজ শুরু করেছেন, এখনো সেই আদর্শে অবিচল আছেন। তার শুরুর দিকের নাটক থেকে এই সময়ের ‘রাঢ়াং’ কিংবা ‘ভঙ্গবঙ্গ’ নাটকগুলো সেই সাক্ষ্য বহন করে। এই দীর্ঘযাত্রায় তিনি কখনো আপোষ করেননি। স্বৈরশাসক এরশাদের দেওয়া বাংলা একাডেমি পুরস্কার তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।’

ভালো থাকুন সবার প্রিয় নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ। রঙবেরঙের পক্ষ থেকে রইলো জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ব্যক্তিত্ব

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

five × 3 =