সখী ভালোবাসা কারে কয়?

মাসুম আওয়াল

‘আমার হৃদয় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছো তুমি রোজ, তোমার হৃদয় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছি আমি রোজ, আমিও কিছুই বলছি না, তুমিও কিছুই বলছো না, ভেতর ভেতর পুড়ে পুড়ে হচ্ছি দু’জন ছাই, জানি না হয় তো ভালোবাসার সংজ্ঞা এটাই।’ ভালোবাসা এমনই। মাত্র চারটি বর্ণ দিয়ে গঠিত একটি শব্দ ভালোবাসা। ‘ভালোবাসা দিবস’ নামে একটি দিনকে বিশেষভাবে উদ্্যাপন করা হয় সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশেও বেশ আড়ম্ভর করে পালিত হয় ভালোবাসা দিবস।

সখী ভালোবাসা কারে কয়?

প্রশ্নটা যতো সহজে করা যায়, উত্তরটা ঠিক তত সহজে দেওয়া সম্ভব নয়। অরফিয়াস ও ইরিডাইস, প্যারিস ও হেলেন, এন্টোনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্টা, রোমিও-জুলিয়েট, লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদের ভালোবাসার গল্প মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে গেছে। যুগে যুগে লেখা হয়েছে অসংখ্য প্রেম ভালোবাসার কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস, গান। এতটুকুও কমে যায়নি ভালোবাসার আবেদন। এখনো লেখকরা লিখে চলেছেন ভালোবাসাকে বিষয় করে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও খুঁজেছেন ভালোবাসার মানে। গানটি অনেক শুনেছি আমরা: ‘সখী, ভাবনা কাহারে বলে। সখী, যাতনা কাহারে বলে। তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’; সখী, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময়?’

ভালোবাসা দিবসের ইতিহাস

১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভালোবাসা দিবস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এর পেছনে কতগুলো ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে। ইতিহাস থেকে যে ক’টি কারণ জানা যায়, এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে ঘিরে কয়েকটি ঘটনা। ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ছিলেন শিশুপ্রেমিক, সামাজিক ও সদালাপি। তিনি ছিলেন খিষ্টধর্মের অনুসারী। তৎকালীন রোম সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস ছিলেন দেব-দেবী পূজারী। সম্রাট তাকে দেব-দেবী পূজা করতে বললে তিনি তা অস্বীকার করেন। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে সম্রাট ভ্যালেন্টাইনকে বন্দি করেন। পরবর্তীতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এ দিনটি ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। এ থেকেই প্রেমিক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এ দিনটি ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।

সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে ঘিরে আরেকটি মত পাওয়া যায়। তরুণ-তরুণীদের অনেকেই ফুল উপহার নিয়ে কারারুদ্ধ সেন্ট ভ্যালেন্টানইকে দেখতে আসতেন। কারারক্ষীর এক অন্ধ মেয়েও ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে আসতেন। একসময় ভ্যালেন্টাইন তার প্রেমে পড়ে যান। তার আধ্যাত্মিক চিকিৎসায় দৃষ্টি ফিরে পায় মেয়েটি। ভ্যালেন্টাইনের প্রতি তাদের ভালোবাসার কথা জানতে পেরে সম্রাট ক্ষিপ্ত হয়ে ২৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে ঘিরে আরো একটি মত পাওয়া যায়। রোম সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াওসের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে দরকার হয় বিশাল সেনাবাহিনীর। এজন্য সেনাবাহিনীতে যুবকদের যোগদানে বাধ্য করতে বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন সম্রাট। এ ঘোষণায় দেশের যুবক-যুবতীরা ক্ষেপে যান। ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনও এ নিষেধাজ্ঞা মেনে নিতে পারেননি। তিনি গোপনে তার গির্জায় বিয়ে পড়ানোর কাজও করতে থাকেন। তিনি পরিচিতি পেলেন ‘ভালোবাসার বন্ধু’ নামে। বিষয়টি সম্রাট ক্লডিয়াসের কানে গেলে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি সৈন্যরা ভ্যালেন্টাইনকে হাত-পা বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে সম্রাটের সামনে হাজির করলে তিনি তাকে হত্যার আদেশ দেন।

এর বাইরে অন্য একটি মত প্রচলিত আছে, প্রাচীন রোমে দেবতাদের রানি জুনোর সম্মানে ১৪ ফেব্রুয়ারি ছুটি পালিত হতো। রোমানরা বিশ্বাস করতেন জুনোর ইচ্ছা ছাড়া কোনও বিয়ে সফল হয় না। পরদিন তারা লুপারকালিয়া ভোজ উৎসবে তরুণ-তরুণীদের মেলায় র‌্যাফেল ড্রর মাধ্যমে সঙ্গী বাছাই করতেন। এমন অনেক প্রচলিত ঘটনা, তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় ভালোবাসা দিবসের ইতিহাস নিয়ে। একেকজন একেকভাবে এর যুক্তি ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। তবে এ কথা ঠিক মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা চিরন্তন।

বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবস এলো যেভাবে

১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসের আবির্ভাব ঘটে বিশিষ্ট সাংবাদিক শফিক রেহমানের হাত ধরে। লন্ডনে পড়াশোনার সুবাদে পাশ্চাত্যের রীতিনীতিতে তিনি ছিলেন অভ্যস্ত। দেশে ফিরে তিনিই ভালোবাসা দিবসের গোড়াপত্তন করেন। তার চিন্তা নতুন প্রজন্মকে বেশি আকর্ষণ করে। ১৪ ফেব্রুয়ারি শফিক রেহমানের হাত ধরে ভ্যালেন্টাইন দিবসের প্রবর্তনের আগ পর্যন্ত এই দিনটি ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবেই পালিত হতো। ১৯৮২ সালের এই দিনে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের প্রণীত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে এক মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল ১০ জন মানুষ। এরপর থেকেই এ দিনটি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবেই পালন করা হতো। কিন্তু ১৯৯৩ সাল থেকে এই দিনটি দখল করে নেয় শফিক রেহমানের হাত ধরে শুরু হওয়া ভ্যালেন্টাইন দিবস। এ কারণে অনেকেই বলে থাকেন ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’কে ভুলিয়ে রাখতেই এই দিবসের প্রচলন।

এ বছরের ভালোবাসা দিবস

২০২৪ সালের ভালোবাসা দিবসের দিনটি আরও বিশেষ হয়ে উঠেছে। কারণ ১৪ ফেব্রুয়ারি পহেলা ফাল্গুন। বসন্তের প্রথম দিন। ‘ফাগুনের আগুন লাগে তোমার হৃদয়ে, বলি হে সখা সেজেছো কেমন নতুনের আগমনে।’ ঋতুরাজ বসন্তে গাছে গাছে নতুন পাতা হাসে। হেসে ওঠে শিমুল, পলাশ আর কৃষ্ণচূড়া। নারীরা সাজে বাসন্তি শাড়িতে। পুরুষ সাদা পাঞ্জাবিতে আর শিশুরাও পরে রঙিন পোশাক। শীতের হিমেল হাওয়া বিদায় নেয় আসে বসন্ত। আসে ভালোবাসা দিবস। যদিও ভালোবাসার জন্য কোনো দিবস লাগে না! তবুও ভ্যালেন্টাইনের প্রেমকাহিনিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি দিনকে বিশেষ করে তুললে কোনো ক্ষতি নেই। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সবাই ভালোবাসার অংশ।

ভালোবাসার দেয়াল

ভালোবাসার দেয়াল আছে একটা। শুনেছেন সেই দেয়ালের কথা কখনো। প্যারিসের মন্টমার্টারে অবস্থিত এই দেয়াল। ক্যালিগ্রাফিস্ট ফেডেরিক ব্যারন এবং শিল্পী ক্লেয়ার কিটোর তৈরি করেছেন এটি। সারা বিশ্ব থেকে মানুষ এই দেয়াল দেখতে আসে। যেখানে ২৫০ ভাষায় লেখা আছে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ বাক্যটি।

যেসব দেশে ভালোবাসা দিবস নিষিদ্ধ

সর্বশেষ পাকিস্তানে ভালোবাসা দিবস উদযাপনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে দেশটির সরকার। ৬০ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত মালয়েশিয়ায় ভালোবাসা দিবস উদযাপনে সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ২০১২ সালে ভালোবাসা দিবসে দেশটির কয়েকটি হোটেলে অভিযান চালিয়ে বেশকিছু তরুণ-তরুণীকে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগে আটক করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশ ইরান ২০১১ সালে ভালোবাসা দিবসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। রাশিয়ার বেলগ্রাডে ২০১১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসের অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করা হয়। আধ্যাত্মিক নিরাপত্তা বজায় রাখতে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ জানায়। সুন্নিপন্থি সৌদি আরবেও ভালোবাসা দিবস উদযাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফুল, লাল রঙের পণ্য, ভালোবাসা দিবসের কার্ড বিক্রি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে দেশটির সরকার। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যেও ভালোবাসা দিবস উদযাপনে সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

সিঙ্গেলদের জন্য কয়েকটি পরামর্শ

ভ্যালেন্টাইনস ডে দম্পতিদের জন্য বিশেষ একটি দিন। তবে যারা সিঙ্গেল তারা কী করবেন এই দিনে! যে বন্ধুরা আপনার মতো সিঙ্গেল, তাদেরকে নিয়ে পার্টি হতেই পারে। মন ভালো হয়ে যাবে। চাইলে এই দিনে বাবা-মায়ের জন্য রান্না করতে পারেন। আপনার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ তো তারাই। যদি পরিবারের কাছ থেকে দূরে থাকেন, তাহলে একা বোধ না করে বরং নিজের পছন্দমতো কিছু করতে পারেন। ডেটে যাওয়ার জন্য শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা না হলেও চলে; প্রিয় বন্ধু বা বান্ধবির সঙ্গেও আড্ডা হতে পারে এই দিনে। ভালোবাসা দিবসে প্রাক্তনের কথা মনে করে কষ্ট পাবেন না। নিজেকে সর্বোচ্চ ভালোবাসুন। ভালোসুন তাদের যারা আপনার গুরুত্ব বোঝেন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিবস

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

five × 2 =