আগামীর সিনেমা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

এই একুশ শতকে জীবন বাস্তব আর ভার্চুয়ালিটির সীমা ভেঙে পরস্পরের মধ্যে দোল খাচ্ছে এবং অগমেন্টেড বাস্তবতায় ঢুকবো ঢুকবো করছে।

প্রযুক্তি প্রতিদিন পাল্টাচ্ছে। প্রযুক্তির সাথে পাল্টে যাচ্ছে আমাদের জীবন যাপনের উপায়। একই সাথে পাল্টাচ্ছে জীবনকে দেখার চোখও। এই পাল্টে যাওয়াটা এতই দ্রুত গতিতে ঘটছে যে আমেরিকার সিয়াটলে বসে কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা যা আবিষ্কার করছেন মুহূর্তে তার হাওয়া এসে লাগছে থই থই পানির সমুদ্রে ভাসা বাংলাদেশের নিঝুমদ্বীপে ঘরের চার দেয়ালে বন্দী ঘোমটাপরা নিরক্ষর গৃহবধূর জীবনেও।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সারা পৃথিবীকে নিয়ে এসেছে হাতের মুঠোয়। আমি, আপনি এইখানে বসেও মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে যেতে পারি এই গ্রহের দূরতম প্রান্তে- এমনকি ভিন কোনো গ্রহেও। পয়সাও তেমন খরচ হবে না। এই রকম আশ্চর্য এক ভেলকিবাজির সময়ে বসে ভাবতে কি পারি, কেমন হবে আমাদের আগামির সিনেমা?

সে এক সময় ছিল- সিনেমা বানানো ছিলো দূর কোনো নক্ষত্রের কাছে পৌঁছুনোর মতোন। বলছি, প্রযুক্তি যখন ছিলো ফিল্ম ফরম্যাটে আবদ্ধ তখনকার কথা। ক্যামেরাগুলো ছিলো ভয়ানক ওজনদার, শুটিংয়ের সময় তোলা ছবি দেখার কোনো কায়দা ছিলো না। অনেকগুলো ধাপ পার হয়ে সিনেমা নিয়ে হলে পৌঁছুনো যেত- মিলত দর্শকের নাগাল। এই নাগাল পাওয়াটা ছিল অর্থ-নির্ভর। মোটা অংকের টাকা ছাড়া কিচ্ছু করা সম্ভব ছিলো না তখন। কিন্তু এখন? এতকিছু দরকার নেই। সেইসব ভারভারিক্কি যন্ত্রগুলো জাদুঘরে জায়গা করে নিচ্ছে, আর দর্শকের কাছে র্পৌঁছুনোর জন্য সিনেমার হলে যাওয়ার দরকার পড়ছে না। সব ওই প্রযুক্তির খেলা। সবকিছু এখন এসে পড়েছে হাতের মুঠোয়- মোবাইল ফোন কিংবা ট্যাবে। আমাদের আছে ইন্টারনেট। আজ নিঝুমদ্বীপে বসে একটা ছবি বানিয়ে আমি পৌঁছে দিতে পারব পৃথিবীর অন্য প্রান্তে- কারোর কোনো কিছুর দ্বারস্থ না হয়ে। এমন মুক্তি, এমন সম্ভাবনা আর কি কোনোকালে ছিলো সিনেমা-পাগল মানুষের হাতে? ছিল না।

এক সময় ভাবা হতো, কলমের মতোন ক্যামেরা যখন সহজলভ্য হবে- যথার্থ সিনেমা সেদিন নির্মিত হবে; সিনেমা তখন সকলের হয়ে উঠবে। এখন এই একুশ শতকে সত্যিই ক্যামেরা কলমের মতোই সহজলভ্য হয়ে গেছে। বহু মানুষের হাতের মুঠোয় থাকা একেকটি মোবাইল ফোনে এমন সব ক্যামেরা আছে যে ভাবতেও অবাক লাগে। মোবাইলগুলোতে আছে সম্পাদনার নানান অ্যাপ, শব্দের নানান অ্যাপও আছে নিশ্চয়, আছে ইন্টারনেট। আর ইন্টারনেট মানে ডিস্ট্রিবিউশনের সুযোগ। এর প্রায় সবকিছুই নামমাত্র টাকায় কিনে ফেলা সম্ভব। তার মানে ছবি বানাবার জন্য বিগ বাজেটের আশায় বসে থাকার কিচ্ছু নেই, বড় পুঁজির কাছে বন্দী হবারও আশঙ্কা নেই।

আগামি দিনের সিনেমার রূপটা আমি এইখানে দেখি। যেখানে নির্মাতা সম্পূর্ণ নিজের নিয়ন্ত্রণে নিজের ইচ্ছায় ছবি বানিয়ে পৃথিবীময় দর্শকের কাছে পৌঁছে দিতে পারবেন। এটা ইউরোপ আমেরিকার একজন মানুষ যেমন পারবেন তেমনি পারবেন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত কোনো গ্রামে থাকা মানুষও। এখন কথা হলো, হাতের তালুতে নিজের অধিকারে থাকা একটা মোবাইল থাকলেই কি যে কেউ চলচ্চিত্র বানিয়ে ফেলতে পারবেন? বানাতে চাইবেন? উত্তর এক কথায়, না। কিন্তু কেউ যদি চান, যদি নিজেকে প্রস্তুত করেন তবে তিনি চলচ্চিত্র বানাতে পারবেন। সবাই হয়তো ভাবছেন, সিনেমা বলতে আমি কোন সিনেমার কথা বলছি।

বহুবার বলা কথাটাই আবারও রিপিট করি এইখানে। মুভি ক্যামেরা আবিষ্কার হলো যখন তখন কিন্তু বাস্তব দৃশ্য ধারণ করেই সিনেমা নামের শিল্প মাধ্যমটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৮৯৬ সালে জীবনের অবিকল বাস্তবতা ধারণ ও তা প্রদর্শনের ভিতর দিয়ে সিনেমাশিল্প বাণিজ্য করতেও শুরু করেছিল। সোয়া শ বছরের যাত্রায় ক্রমে ‘কাহিনীচিত্র’ হয়ে উঠেছে সিনেমার অন্য নাম। পুঁজির দেন-দরবারও আবর্তিত হয়েছে কাহিনীচিত্রকে ঘিরেই। এটা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেমন বাংলাদেশেও তেমনই ঘটেছে। প্রযুক্তি যখন পুরোপুরি ফিল্ম ফরম্যাট-নির্ভর ছিল তখন সিনেমা বন্দী ছিলো ব্যবসায়ীদের হাতে। তবুও আশ্চর্য যে বিশ্ব চলচ্চিত্রে আমরা পেয়েছি তারকোভস্কি, বার্গম্যান, কুরোসাওয়া, বুনুয়েল, আন্তোনিওনি, গদার, ফেলিনি, ওজু, আগাসে ভার্দা, ঋত্ত্বিক ঘটক, সত্যজিত রায়ের মতোন চলচ্চিত্রকারদের। জানি, এমন আরো অনেক নাম বলা হলো না এখানে। কিন্তু বলবার কথা হলো এই যে, আর্ট ফর্ম হিসেবে সিনেমা জীবনকে কত গভীর অতলান্ত থেকে দেখতে ও অনুভব করতে পারে- এই সব মহান চলচ্চিত্রকার তাঁদের কাজের মাধ্যমে দেখিয়ে গেছেন আমাদের। জীবন ও জগতের গভীর, জটিল, বর্ণিল ভাঁজগুলো খুলে খুলে সিনেমার পর্দায় তুলে এনেছেন তাঁরা তখন- যখন প্রযুক্তি আজকের মতোন এমন সহজলভ্য হয়ে উঠেনি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

nine − 8 =