নাহিন আশরাফ
বিমানবালা হয়ে প্লেনে প্লেনে আকাশে উড়ে বেড়ানো, দেশ থেকে দেশান্তর ঘোরা অনেকেরই স্বপ্ন। এই স্বপ্নের চাকরি ছেড়ে কেউ যখন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে তৈরি করে তখন ব্যাপারটা কেমন হয়? ঠিক এমন গল্প আফসা রশিদের।
পরিবারে সবচেয়ে ছোট আফসা
খুলনাতেই কেটেছে ছোটবেলা। সেখানেই কাটিয়েছেন জীবনের বেশিভাগ সময়। বাবা আমেরিকায় থাকতেন তাই মায়ের কাছে মানুষ হয়েছেন সব ভাই বোন। বাবা প্রবাসে থাকলেও পরবর্তীতে বাবাই হয়ে যান আফসার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। বাবা দেশে ফিরে আসার পর বাবার কাছে মনের সব ইচ্ছা তুলে ধরতেন। ভালোলাগা মন্দলাগা সবকিছুই বাবার সাথে ভাগ করে নিতেন। ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা চলাকালীনই তিনি বিমানবালা হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। অনেকেই দেশ থেকে দেশান্তর ঘুরে বেড়ানোর জন্য বিমানবালায় চাকরি চান, কিন্তু তার চাকরি নেওয়ার কারণ ছিল অন্য। বিমানবালা হিসেবে যারা চাকরি করতেন তারা এত সুন্দর গুছিয়ে শাড়ি পরতেন যা আফসাকে ভীষণ আকর্ষণ করতো।
ছোটবেলা থেকেই ছিল শাড়ির প্রতি ঝোঁক। শাড়ি পরতে ভীষণ ভালোবাসতেন। পড়াশুনা এবং চাকরি একাধারে চলছিল। কিন্তু বিয়ের পর সংসারের দায়িত্ব নিতে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। চেয়েছিলেন শুধু মন দিয়ে গুছিয়ে সংসার করবেন। চাকরি ছাড়ার ব্যাপারটিতে তার বাবা কিছুটা দুঃখ পেয়েছিলেন। কারণ তার মেয়ের নামের পাশ থেকে একটি পরিচয় মুছে যাবে, আবার অন্যদিকে তার মেয়ে সংসারের দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে তাতে তিনি খুশিও ছিলেন। তবে তিনি সবসময় মেয়েকে বলতেন কিছু একটা করতে। আফসার বাবার বিশ্বাস ছিল তার মেয়ে খুব ভালো ব্যবসা করতে পারবে। তাই সবসময় মেয়েকে বলতেন, ‘তুমি ব্যবসা কর। আমি তোমার পাশে আছি। আমার বিশ্বাস তুমি এখানে খুব ভালো করবে’। বাবার এ কথা ধারণ করে তিনি সবসময় ভাবতেন কি করা যায়।
২০২০ সালে আফসার বাবা মারা যান। বাবার সাথে তার সম্পর্ক ছিল সবচেয়ে মধুর, বাবার মৃত্যুর তিনি মেনে নিতে পারেননি এবং এতে তিনি ভীষণ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে নতুন কিছু করার উদ্যোগ নেওয়ার মানসিক অবস্থা তখন তার ছিল না। এরপর ধীরে ধীরে শোক কাটিয়ে উঠে তিনি ঠিক করলেন এমন কোনো কাজ করবেন যেখানে বাবাকে ধারণ করা যাবে। শাড়ির প্রতি ভালোবাসা ছিল অনেক আগে থেকেই। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন শাড়ি নিয়েই কাজ শুরু করবেন। শাড়ি যেহেতু তার কাছে নেশার মতো, এই নেশাকেই তিনি পেশাতে পরিণত করবেন।
একদিন সকালে হুট করে শাড়ির একটি পেজ খুলে ফেললেন। নাম দিলেন ‘রশিদ’স’। এই নামকরণের কারণ হলো বাবা এবং তার নামের শেষে রয়েছে রশিদ। বাবার ছোঁয়া রাখার জন্য এই নাম নির্ধারণ করেন, যাতে করে সব সময় মনে হয় বাবা তার সাথেই আছেন। পেইজে তার শাশুড়ির জন্য ডিজাইন করা একটি শাড়ি পোস্ট করেন। আশা প্রত্যাশা কিছুই ছিল না, শুধু দেখতে চেয়েছিলেন এই শাড়িগুলোর চাহিদা কেমন। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে একজন এই শাড়িটি অর্ডার করলেন। শুরু হয় যায় ‘রশিদ’স’ এর যাত্রা। পেইজের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল মসলিন ও কাঁথা স্টিচ শাড়ি। দেশীয় পণ্যের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি এই শাড়ি নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন।
শূন্য থেকে শুরু করে ‘রশিদ’স’ একটি ব্র্যান্ডে পরিণত হতে থাকে। তার উদ্দেশ্য ছিল মসলিন শাড়ির সাথে মানুষকে আরো বেশি পরিচয় করানো। দেশের মানুষ এখনো আসল মসলিন ঠিক মতো চিনতে পারে না, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বিভিন্ন কাপড়কে মসলিন বলে বিক্রি করে। সেসব নকল কাপড় অনেক সময় ফুলে থাকে কিংবা কোয়ালিটি খারাপ হয় তখন মানুষের মসলিন সম্পর্কে ধারণা হয় যে মসলিন হয়তো খুব বেশি আরামদায়ক হয় না। ক্রেতাদের কাছ থেকে অনেক সময় প্রশ্ন পান ‘আপু শাড়ি ফুলে থাকবে না তো?’ তখন তিনি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেন, আসল মসলিন কখনোই ফুলে থাকবে না। আসল মসলিন কাপড়ের মজা যে একবার বুঝবে সে অন্য কোনো শাড়ি পরে আরাম পাবে না। আফসা বলেন, আমাদের শাড়ি কিন্তু বাজেট ফ্রেন্ডলি হয় না। যখন তিনি প্রথম ব্যবসা শুরু করেন তখনও তিনি খুব কম দামে শাড়ি আনতে পারেননি। কেন তার শাড়ির দাম বেশি তা শুধু বুঝবেন যারা মসলিন শাড়ি সম্পর্কে জানেন।
‘রশিদ’স’ এর আরেকটি বিশেষ শাড়ি হচ্ছে কাঁথা স্টিচ শাড়ি। ব্যাক্তিগতভাবে আফসার কাছে কাঁথা স্টিচ শাড়ি মানে আবেগ। কারণ গ্রাম অঞ্চলে সেসব নারীরা এসব শাড়ি তৈরি করেন তারা সবাই দুপুরের খাবার শেষ করে একসাথে বিকেলে উঠানে বসে এ শাড়ি সেলাই করেন। সেলাইয়ের মধ্যে ফুটে উঠে তাদের পাওয়া, না পাওয়া, আবেগ-অনুভূতি, রাগ দুঃখ কষ্ট সবকিছু। তাই এটি শুধু একটি শাড়ি নয়, এটি অনেকের কাছে আবেগের নাম। আফসার ইচ্ছা ‘রশিদ’স’ এর মধ্যে দিয়ে তিনি বিশ্বের বুকে দেশের ঐতিহ্য তুলে ধরবেন। মসলিন এবং কাঁথা স্টিচ এর শাড়ি ব্যয়বহুল হবার পরেও তিনি চেষ্টা করেন দাম কিছুটা সাধ্যের মধ্যে রাখার। তার ক্রেতারা সবসময় বলেন যে এমন ইউনিক ডিজাইনের শাড়ি এই দামে আর কোনো ব্র্যান্ড দেয় না। এতেই আফসার সার্থকতা কারণ তার কাস্টমাররা বারবার তার কাছে ফিরে আসেন।
বাবার অনুপ্রেরণায় শুরু করেছিলেন যাত্রা। কিন্তু চলার পথে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছেন স্বামী ও সন্তানের। আফসা বাড়িতে বসেই প্রায় ১৮ ঘণ্টা কাজ করেন, সব সময় ডিজাইন ও তার ব্যবসা নিয়ে পরিকল্পনা করতে হয়, নানা বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়। কাজের সময় কখনোই বিরক্ত করে না তার সন্তান। বয়স মাত্র ৯ বছর হলেও তার ছেলে খুব ভালো মতোই বুঝে তার মায়ের উপর কত বড় দায়িত্ব। স্বামী অফিস থেকে ফিরে যতই ক্লান্ত থাকুক তাকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে যান যাতে আফসা রিফ্রেশ হন এবং ডিজাইন নিয়ে নতুন করে ভাবতে পারেন। স্বামী ও পরিবার থেকে এমন সহযোগিতা পেয়ে তিনি নিজেকে অনেক বেশি ভাগ্যবান মনে করেন। কারণ সমাজে অনেক নারীরা পরিবার থেকে কোনো রকম সহযোগিতা পায় না।
যারা উদ্যোক্তা হতে চান
প্রথমেই যে পণ্য নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা তার প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। অন্য একজন করছে বলে আমিও করবো, এই মনোভাব নিয়ে কখনোই ব্যবসায় নামা উচিত নয়। যে পণ্য নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা সে সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও চাহিদা সম্পর্কে জেনে ব্যবসা শুরু করতে হবে। দরকার অনেক বেশি ধৈর্যশক্তি। তিনি আরো বলেন, আমি যখন আমার পেজ খুলি তখন প্রথম ছয় মাস তেমন লাইক বা ফলোয়ারস ছিল না। যখন লাইভ করতাম তখন ভিউ থাকতো মাত্র ৩/৪ জন। কিন্তু আমি কখনোই মন খারাপ করিনি বা থেমে যাওয়ার কথা চিন্তা করিনি। বরং ধৈর্য ধরে নিজের কাজ চালিয়ে গেছি। তাছাড়া ব্যবসা শুরু করলে আত্মীয়-স্বজন কিংবা বন্ধু মহল থেকে অনেকেই কটূ কথা বলতে পারে, সব কথা কখনোই কানে নেওয়া যাবে না। যারা কাজে উৎসাহ দেয় না তাদের সঙ্গ এড়িয়ে যারা অনুপ্রেরণা দেয় তাদের সাথে থাকতে হবে। তাহলেই একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়া যাবে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ইন্টারপ্রিনিয়র