মাসুম আওয়াল
রাজধানীর একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র জারিফ। ওর সঙ্গে কথা হচ্ছিল নানা বিষয় নিয়ে। জানতে চাওয়া হলো হালখাতা কী। হাসতে হাসতে জারিফ বললো অংক খাতা, বাংলা খাতা, ইংরেজি খাতা, ছবি আঁকার খাতা এমন খাতা হয় কিন্তু হালখাতার নাম তো শুনিনি কখনো। তরুণ প্রজন্মের আরও কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলাম তারা হালখাতা সম্পর্কে জানে কি না! কমবেশি প্রায় সকলেরই একই অবস্থা। বাংলা বারো মাসের নাম মুখস্ত থাকলেও হালখাতার কথা জানা নেই তাদের। সম্প্রতি এক গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আত্মীয় এক মুদি দোকানিকে বলছিলাম সামনেই তো পয়লা বৈশাখ; তোমার দোকানের হালখাতা করবে নিশ্চয়ই। সে বললো না মামা, আমরা তো হালখাতা করি ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে। ওই সময় কৃষকদের হাতে টাকা থাকে। হালখাতা উৎসব কী বাঙালির জীবন থেকে বিদায় নিতে চলেছে। তরুণ প্রজন্ম জানেই না বৈশাখের প্রথম দিনে কী দারুণ হালখাতা আয়োজন হতো এককালে। সময় বদলেছে। প্রযুক্তি আমাদের এগিয়ে নিয়েছে। কিন্তু পুরানো দিনের কথা ভুলে গেলে কী চলে! নতুন আঙ্গিকে বাঙালি নববর্ষ পালন করছে, করবে। কিন্তু শেকড় ভুলে গেলে তো চলবে না। জেনে নেওয়া যাক বাঙালি জীবনের হালখাতার গল্প।
হালখাতা কী
হালখাতা হলো বছরের প্রথম দিনে দোকান-পাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। বছরের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা তাদের দেনা-পাওনার হিসাব সমন্বয় করে এদিন হিসাবের নতুন খাতা খোলেন। এজন্য খদ্দেরদের বিনীতভাবে পাওনা শোধ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। ‘শুভ হালখাতা’ জানিয়ে নিমন্ত্রণপত্র দেওয়া হয় দোকানে আসার জন্য। এই উপলক্ষ্যে ব্যবসায়ীরা তাদের খদ্দেরদের মিষ্টিমুখ করান। খদ্দেররাও তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী পুরানো দেনা শোধ করেন। আগেকার দিনে ব্যবসায়ীরা একটি মোটা খাতায় তাদের যাবতীয় হিসাব লিখে রাখতেন। এই খাতাটি বৈশাখের প্রথম দিনে নতুন করে হালনাগাদ করা হতো। হিসাবের খাতা হাল নাগাদ করা থেকে ‘হালখাতা’র উদ্ভব। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছোট-বড়-মাঝারি যেকোনো দোকানেই এটি পালন করা হয়ে থাকে।
হালখাতার উৎস
হালখাতার প্রচলন বাঙালি মুসলমান শুরু করেছিল। হালখাতার প্রথম পাতায় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ ও ‘এলাহি ভরসা’ লেখা হতো। ‘হাল’ শব্দটি ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। ‘হাল’ এর অর্থ হচ্ছে ‘নতুন’। হালখাতা অর্থাৎ নতুন খাতা। একসময় বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ নতুন রীতি প্রচলন করেন, যেটি একসময় ‘পুণ্যাহ’ হিসেবে পরিচিত ছিল। কালের পরিক্রমায় ‘পুণ্যাহ’ উৎসব হারিয়ে গেলেও হালখাতা এখনও স্বমহিমায় টিকে আছে। ইতিহাস বলছে মোঘল সম্রাট আকবরের আমল থেকে পয়লা বৈশাখ উদ্্যাপন প্রথা শুরু হয়। সেই সময় থেকেই দোকানে দোকানে ব্যবসার হিসাব করার জন্য শুরু হয় হালখাতার প্রথা। মোঘল আমলে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে প্রজারা খাজনা পরিশোধ করতেন এবং বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন জমিদাররা।
হালখাতা ও লক্ষ্মী-গণেশের পূজা
বাংলার ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রথম দিনটি হালখাতা হিসেবেও পালন করে থাকেন। তার সঙ্গে দোকানে লক্ষ্মী-গণেশের পূজা ও ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করানো হয়। বাংলা নববর্ষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হালখাতা। বাঙালির ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এই হালখাতা। তবে এখনকার দিনে হালখাতা উদ্্যাপন অনেকটাই কমে এসেছে। আগে অনেক দোকানি হালখাতা উপলক্ষ্যে রীতিমত নিমন্ত্রণপত্র ছাপিয়ে উৎসবের আয়োজন করতেন। এখন বিভিন্ন অ্যাপ ও অনলাইন শপিংয়ের কারণে হালখাতার সেই আগেকার দিনের জৌলুস কমে এসেছে। কম্পিউটারেই ব্যবসার হিসাব রাখেন বেশিরভাগ দোকানিরা। খাতার ব্যবহারও কমে গেছে অনেকটাই। তবু নববর্ষের প্রথম দিনে দোকান পরিষ্কার করে, ফুল দিয়ে সাজিয়ে, লক্ষ্মী গণেশের পূজা করা হয়ে থাকে। সঙ্গে থাকে ক্রেতাদের জন্য মিষ্টিমুখের আয়োজন ও একটা অন্তত বাংলা ক্যালেন্ডার। নতুন যে খাতায় ব্যবসার হিসাব রাখা হবে, সেই খাতাটি কোনও মন্দিরে নিয়ে গিয়ে পূজা করিয়ে আনার প্রথা আছে। খাতার প্রথম পাতায় সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিকা চিহ্ন এঁকে দেন পুরোহিতরা। কালীঘাট মন্দিরে এদিন উপচে পড় ভিড় হয় ব্যবসায়ীদের।
যেমন ছিল গ্রাম বাংলার হালখাতা
বৈশাখের প্রথম দিন গ্রামবাংলা, শহরে, ছোট-মাঝারি-বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হালখাতার আয়োজন করা হতো। এ উপলক্ষ্যে ছাপানো হতো নিমন্ত্রণপত্র, চলতো নানা আয়োজন। উৎসব উদ্দীপনার মধ্যে অনুষ্ঠিত হতো হালখাতা উৎসব। গ্রামের হালখাতাতে ব্যবসায়ীরা বৈশাখের প্রথম দিনে সকালে এসে দোকান পরিস্কার করে কাগজের ফুল দিয়ে বর্ণিল সাজে সাজাতো। ক্রেতাকে আপ্যায়ন করতো জিলাপি, খাজা, দই, চিড়া ও মুড়ি দিয়ে। শহরের ব্যবসায়ীরা হালখাতার দিনে নানা রঙের আলোকসজ্জার মাধ্যমে দোকান বর্ণিল সাজে সাজাতো। আর খরিদ্দার আপ্যায়ন করার জন্য মিষ্টান্ন, পোলাও মাংসের ব্যবস্থা রাখতো। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যর এই প্রাণের হালখাতা উৎসব অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, ক্রেডিট কার্ড আর ডেবিট কার্ডের যুগে এখন বিলীন হওয়ার পথে।
পুরান ঢাকার হালখাতা
হালখাতা খোলার আগে পুরান ঢাকার মুসলমানরা দাওয়াতের আয়োজন করেন। শুভ হালখাতার দাওয়াতপত্র বিতরণ করা হয়। এই দাওয়াত ঘিরে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের মতো ধর্মীয় আচার পালন করা হয়। নতুন বছরের শুরুতে ব্যবসার মঙ্গল কামনা করা হয়। মাহফিল শেষে মিষ্টান্ন বিতরণ করা হয়। অনেক ব্যবসায়ীরা পহেলা বৈশাখের আগের ও পরের দিনের মাঝে যেকোনো একটি দিন বেছে নেন হালখাতার দাওয়াত, দোয়া ও মিলাদ পড়ানোর জন্য। নববর্ষের দিন ক্রেতাদের মিষ্টি ও ঠান্ডা পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করেন বাঙালি মুসলমান ব্যবসায়ীরা। হালখাতার মাধ্যমে ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের সেতুবন্ধন তৈরি হয়। পরে হিন্দুরা এই প্রথা গ্রহণ করে। পহেলা বৈশাখের সকালে সনাতন ধর্মাবলম্বী দোকানি ও ব্যবসায়ীরা সিদ্ধিদাতা গণেশ ও বিত্তের দেবী লক্ষ্মীর পূজা করে থাকেন এই কামনায় যে, তাদের সারা বছর যেন ব্যবসা ভালো যায়। এদিন ক্রেতাদের মিষ্টান্ন, ঠান্ডা পানীয় প্রভৃতি দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকেন ব্যবসায়ীরা। অনেক ব্যবসায়ী অক্ষয় তৃতীয়ার দিনেও হালখাতা বা শুভ মহরৎ পূজা করে থাকেন। যদিও বর্তমানে হালখাতা উদ্্যাপন আগের চেয়ে অনেকটাই কমে এসেছে। তবু হালখাতা ছাড়া এখনও বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনটি ভাবাই যায় না।
কৃষকদের হালখাতা
কৃষি-অর্থনীতিতে নগদ অর্থের প্রবাহ না থাকায় বাকিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনাবেচা ছিল অপরিহার্য। ফলে ‘হালখাতা’র গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তখন বাংলার কৃষকদের হাতে নগদ টাকা থাকত না। পাট বিক্রির নগদ অর্থ কেবল পরিবারের সদস্যের পোশাক ক্রয়, দেনাশোধ এবং বিয়ের খরচ মেটানোর কাজে ব্যবহার করা হতো। নববর্ষে শখ করে দু’একটি ইলিশ মাছ কেনার জন্যও তারা এই টাকা খরচ করতো। পাটের মৌসুম পার হলেই পুনরায় বাকিতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে বাধ্য হতো। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন হালখাতা অনুষ্ঠানে এই দেনার আংশিক বা পুরোটাই পরিশোধের রীতি প্রচলিত ছিল। ফলে হালখাতা ছিল পুরানো বছরের হিসাব মিটিয়ে নতুন বছরে নতুন জীবন শুরুর সংস্কৃতি।
শেষকথা
বাঙালি জীবনে সর্বজনীন উৎসব হিসেবে ‘হালখাতা’ ছিল বাংলা নববর্ষের প্রাণ। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ‘হালখাতা’র সামাজিক গুরুত্বও ছিল অন্যরকম। ভোক্তারা ‘হালখাতা’র জন্য বছরব্যাপী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো। দোকানি বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে মিষ্টিমুখ করে আত্মতৃপ্তির বিষয়টি ছিল তাদের কাছে আনন্দের। হালখাতা নিয়ে দারুণ একটি ছড়া লিখেছেন শাহ আলম বাদশা। তিনি লিখেছেন, ‘হালখাতা মানে কি রে/ কেউ জানে, জানে কিরে/ কার্ড পাই খেতে যাই/ চমচম-মিষ্টি;/ খাওয়া শেষে হেসে-হেসে/ হাতে দেয় লিষ্টি।/ ধারদেনা রাখবে না/ চুকেবুকে দেয় যে;/ বৈশাখে ঋণপাকে/ ভালোবেসে নেয় যে!/ ‘খাতা’ মানে তারা জানে/ বছরের পাওনা/ বই খুলে নেয় তুলে/ শোধ করে দাও না।/ কার্ডগুলো মনভুলো/ কত আহা ভালো যে/ ‘হালখাতা’ নয় যা-তা/ হৃদয়ের আলো যে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ