রোবট আবিষ্কার হলো কিভাবে

গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত

আমরা সকলেই রোবট শব্দটির সাথে কমবেশি পরিচিত। মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি, সৃজনশীলতা ও প্রযুক্তিগত ঐক্যতানের কাঠামোগত রুপ হচ্ছে এই রোবট। জড়নড়ঃ শব্দটি এসেছে মূলত সøাভিক শব্দ রোবোটা জড়নড়ঃধ মতান্তরে ৎড়নড়ঃর শব্দ থেকে। যার অর্থ হলো দাস বা কর্মী অথবা শ্রমিক। জড়নড়ঃ শব্দটির প্রবক্তা ছিলেন সাইন্স ফিকশন লেখক ও নাট্যকার ক্যারেল ক্যাপেক। খুব সাধারণভাবে বললে যে ইলেট্রো-মেকানিক্যাল স্ট্রাকচার কোনো কাজ করতে সক্ষম তাই রোবট। আজ আমরা রোবটের ইতিহাস নিয়ে জানবো।

রোবটের উৎপত্তি প্রাচীন বিশ্বেই। এটা নিয়ে আধুনিক ধারনা বিকাশ শুরু হয় শুরু হয় শিল্পবিপ্লবের সূত্রপাত ধরে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ফলে কালের পরিক্রমায় পৌরাণিক কল্পগাথা, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির পাতা থেকে বাস্তব কাঠামোগত রুপ লাভ করে রোবট। সারা বিশ্বজুড়ে অনেক সংস্কৃতির পৌরাণিক কাহিনিতে স্বয়ংক্রিয় বস্তু সম্পর্কে ধারণা দেওয়া আছে। প্রাচীন চীন, গ্রিস এবং টলেমিক মিশরের প্রকৌশলীরা স্বয়ংক্রিয় মেশিন নির্মাণের চেষ্টা করেছিলেন; তারা অনেকটা ছিল প্রাণী ও মানুষের অনুরূপ। শুরুর দিকে স্বয়ংক্রিয় বস্তু সম্পর্কে প্রথম যে বিবরণটি পাওয়া যায় তাদের মধ্যে আর্কাইসের কৃত্রিম ঘুঘু, কৃত্রিম মোজি এবং খঁ ইধহ পাখি, স্বয়ংক্রিয়ভাবে কথা বলতে সক্ষম আলেকজান্দ্রিয়ার হিরো, ধিংযংঃধহফ নামে বাইজেন্টিয়ামের ফিলো এবং মানব লি জি অন্যতম।

প্রাচীন গ্রিসে ভাষায় গ্রিক প্রকৌশলী ঈঃবংরনরঁং (২৭০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) নিউম্যাটিক্স এবং হাইড্রোলিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে প্রথম চলমান অঙ্গ এবং জল ঘড়ি তৈরি করেছিলেন। চতুর্থ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গ্রিক গণিতবিদ ত্যান্টুমের আর্কিটাসের একটি যান্ত্রিক বাষ্পচালিত পাখি তৈরি করেছিলেন যাকে তিনি ঞযব চরমবড়হ নামে অভিহিত করেছিলেন। আলেকজান্দ্রিয়ার হিরো (১০-৭০ খ্রিষ্টাব্দ) একজন গ্রিক গণিতবিদ ও উদ্ভাবক ছিলেন যিনি বহু ব্যবহারযোগ্য স্বয়ংক্রিয় ডিভাইস তৈরি করেছিলেন যা বায়ুর চাপ, বাষ্প এবং জল দ্বারা চালিত হতো। প্রাচীন চীনে, লি জি এর ৩য় শতাব্দীর পাঠে হিউম্যানোয়েড অটোম্যাট’র একটি বিবরণ পাওয়া যায়। আল জাজারি (১১৩৬-১২০৬), আর্টুকাড রাজবংশের সময়কার একজন মুসলিম আবিষ্কারক, কয়েকটি স্বয়ংক্রিয় মেশিন ডিজাইন এবং নির্মাণ করেছিলেন, যা রান্নাঘরের যন্ত্রপাতি এবং বাদ্যযন্ত্রের অটোমাটা জল দ্বারা চালিত। রেনেসাঁকালীন ইতালিতে, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ১৪৯৫ সালের কাছাকাছি একটি হিউম্যনোয়েড রোবটের পরিকল্পনা করেছিলেন। ৫০-এর দশকে আবিষ্কৃত দ্য ভিঞ্চির নোটবুকগুলি ছিল একটি যান্ত্রিক নাইটের বিস্তারিত অঙ্কন যা এখন লিওনার্দোর রোবট হিসেবে পরিচিত, সেগুলো বসতে সক্ষম, তাদের মাথা এবং চোয়াল নাড়াতে পাড়ে। নকশাটি শারীরিক গবেষণার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা ছিল তার ঠরঃৎাঁরধহ ম্যান রেকর্ড নামে পরিচিত, তিনি এটি নির্মাণ করতে চেষ্টা করেছিলেন কিনা তা জানা যায় না।

জাপানে সপ্তম শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতকের দিকে কারাকুরি জুই (ইলাস্ট্রেটেড যন্ত্রপাতি, ১৭৯৬) একটি জটিল প্রাণী এবং মানব অটোমাটা তৈরি করেছিলেন। ঐটি ছিল অটোম্যাটন কারাকুরি নিংগ্যু নামে একটি যান্ত্রিক পুতুল। কারাকুরি’র বিভিন্ন বৈচিত্র্য বিদ্যমান ছিল। যেমন থিয়েটারে ব্যবহার করা হয় বুতাই কারাকুরি, ছোট জাশিকি কারাকুরি ঘরে ব্যবহৃত হয় এবং দাশি কারাকুরি ধর্মীয় উৎসবে ব্যবহৃত হয়।

ফ্রান্সে, ১৭৩৮ থেকে ১৭৩৯ সালের দিকে জ্যাকস দে ভকানসন বেশকিছু জীবন-মাপের অটোম্যাটন প্রদর্শন করেছিলেন। উদারণস্বরূপ, বাঁশি বাদক, পাইপ বাদক এবং হাঁসের কথা বলা যায়। যান্ত্রিক হাঁসটি তার ডানা ঝাঁপটাতে পারে, তার ঘাড় নাড়াতে পারে, প্রদর্শনকারীর হাত থেকে খাবার গ্রহণ করতে পারে এবং এটি দেহের একটি গোপন স্থানে সংরক্ষিত বস্তু বহন করতে পারে। ১৯২০ সালে চেকোসøাভিয়ান লেখক ক্যারেল চ্যাপেক আর.ইউ.আর নামে একটি নাটক লেখেন। পরের বছর নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। নাটকে রোসাম নামের এক লোক চাবি দেওয়া স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বানাতেন, যেগুলো দেখতে মানুষের মতোই। মানবজাতিকে শ্রমের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতেই এদের বানানো হয়েছিল। এ নাটকের কল্যাণে কালক্রমে রোবট শব্দের অর্থ দাঁড়ায় ‘কৃত্রিম মানুষ’।

এখন স্বচালিত যন্ত্র বোঝাতে প্রায় সব ভাষাতেই ‘রোবট’ শব্দটি ব্যবহার হয়। ১৯৪১-৪২ সালে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি লেখক আইজাক আসিমভ রোবোটিকসের তিনটি আইন প্রণয়ন করেন এবং রোবোটিক্স শব্দটির উদ্ভব হয়। জটিল আচরণের প্রথম ইলেকট্রনিক স্বায়ত্তশাসিত রোবট ১৯৪৮-৪৯ সালে ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল ব্রিডল নিউরোলজিকাল ইনস্টিটিউটের উইলিয়াম গ্রে ওয়াল্টার তৈরি করেছিলেন। এলমের এবং এলসি নামে তার প্রথম রোবট ১৯৪৮-৪৯ সালের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। তাদের আকৃতি এবং ধীর গতির কারণে প্রায়ই ‘কচ্ছপ’ হিসেবে বর্ণনা করা হতো। তিন চাকার কচ্ছপ রোবট ব্যাটারি রিচার্জ করার সময় তাদের রিচার্জিং স্টেশনে পৌঁছাতে পারতো।

১৯৫৪ সালে পৃথিবীর প্রথম ডিজিটাল ও প্রোগ্রামেবল রোবট আবিষ্কার করেন জর্জ ডেভল। তিনি এর নাম দেন ইউনিমেট (টহরসধঃব)। ১৯৬১ সালে এটি জেনারেল মোটরস-এর কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। ইউনিমেটের কাজ ছিল লোহা লক্কড় ওঠানামা করানো এবং ভারী বস্তু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া। স্বয়ংক্রিয় রোবট আবিষ্কারের মাধ্যমে আধুনিক রোবটের যাত্রা শুরু হয় ইউনিমেটের হাত ধরেই।

এরপর ১৯৬৬ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় আবিষ্কার করে শেকি রোবট। যেটি ছিল সর্বপ্রথম স্বয়ংক্রিয়, স্বায়ত্তশাসিত, কৃত্রিম বুদ্ধিভিত্তিক রোবট। কোনো টেবিলে বাধা পেলে কিভাবে সেই বাধাকে অতিক্রম করা যায় এবং রুমের চারপাশ দেখার মাধ্যমে বাধা বিপত্তিগুলো দেখে চলার মতো সক্ষম করে গড়ে তোলা হয় এই রোবটকে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলেজিন্স কাজে লাগিয়ে গবেষকরা বুদ্ধিভিত্তিক মেশিন তৈরি করে সাফল্য অর্জন করতে শুরু করেছেন এই শতাব্দির শেষের দিকে। কাজের প্রয়োজনীয়তার উপর নির্ভর করে তৈরি করা হয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করার যোগ্য রোবট। যে রোবটগুলো গাড়ি চালোনো থেকে শুরু করে উড়তেও সক্ষম।

রোবট জগতের সবচেয়ে অভাবনীয় সাফল্য হলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলেজিন্স কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হুবহু মানুষের মতো কাজ করতে সক্ষম রোবট বা হিউম্যানয়েড। মানুষের অবয়বে তৈরি করা এই রোবট তৈরি করা হয়েছে নিউরোসাইন্সের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। ফলে এই রোবট তাদের নিজস্ব আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলেজিন্স কাজে লাগিয়ে মানুষের পালস বুঝতে সক্ষম হয়। মানুষের অবয়বের মতো করে মানুষকে সাহায্য করার জন্য আসিমো (অ্যাডভান্সড স্টেপ ইন ইনোভেটিভ মবিলিটি) ছিল বিশ্বের প্রথম হিউম্যানয়েড রোবট। ২০০০ সালে প্রথম আসিমো বাজারে নিয়ে আসে জাপানি কোম্পানি হোন্ডা। মানুষের মতো দেখতে এই রোবটটির উচ্চতা ৪ ফিট ৩ ইঞ্চি এবং ওজন ১১৯ পাউন্ড। প্রতি ঘণ্টায় ৯ কিলোমিটার গতিতে দৌড়াতেও পারতো এই মানুষ সদৃশ্য রোবটটি। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের প্রথম অতি মানবীয় নারী রোবট ‘জিয়া জিয়া’ নির্মাণ করা হয়। রোবটিক্স বিশ্বে এখন পর্যন্ত বানানো মানুষের আকৃতির রোবটের মধ্যে এটিই সবচেয়ে নিঁখুত বলে দাবি এর নির্মাতাদের। এই রোবট দেখে বিশ্বাস হয় না যে, জিয়া জিয়া একটি রোবট। শুধু বাহ্যিক গঠনের কারণেই নয়, কথাবার্তা ও আচরণেও জিয়া জিয়াকে বাস্তবের সুন্দরী কোনো নারী বলেই মনে হবে।

বিশ্বে প্রথম নাগরিকত্ব প্রাপ্ত রোবট ‘সোফিয়া দ্য হিউম্যানয়েড’। এই রোবটকে নাগরিকত্ব দেয় সৌদি সরকার। মার্কিন অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্নের মতো দেখতে ওই রোবট তার নাগরিকত্বের বিষয়ে লাইভ শো’তে সাক্ষাতকার দিয়েছে। সে বলেছিল, পৃথিবীর প্রথম রোবট হিসেবে নাগরিকত্ব পেয়ে সে অত্যন্ত গর্বিত। সৌদি সরকারকে ধন্যবাদও জানিয়েছিল সে। সোফিয়া নামের এই রোবটটির নির্মাতা হংকংয়ের সংস্থা হ্যানসন রোবোটিক্স। মানুষের মতেই যাবতীয় হাবভাব তার। এমনকি রেগে তাকাতে পারে, চাইতে পারে হাসিমুখেও। ২০১৫ সালের ১৯ এপ্রিল সোফিয়াকে প্রথম সক্রিয় করা হয়। এতে ফেসিয়াল রিকগনিশন ব্যবহার করা হয়েছে। আছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ভিজুয়াল ডেটা প্রসেস করার ক্ষমতা। এটি মানুষের অঙ্গভঙ্গি নকল করতে ও মুখভঙ্গি দেখাতে পারে। নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সাধারণ কথোপকথন, বিশেষ করে কোনো বিশেষ বিষয়ের ওপর আলোচনা চালাতে পারে। এখন গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেটের ভয়েস রিকগনিশন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এই আলোচনা-সমালোচনার রেশ থাকতে থাকতেই দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি আসর ‘ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড’ এর উদ্বোধনীতে যোগ দিতে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে এসেছিল সোফিয়া। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের তরুণরা রোবট তৈরি করছে। পাশাপাশি দেশ-বিদেশের নানা প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের তরুণরা সুনাম বয়ে আনছে রোবট তৈরি করে।

রোবট ইতিমধ্যে বিভিন্ন শিল্পে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এই যান্ত্রিক বিস্ময় আমাদের জীবনযাপন, কাজ এবং অন্বেষণের পদ্ধতিকে পরিবর্তন করেছে। ওষুধ শিল্পে বিপ্লব আনা থেকে শুরু করে সৃজনশীলতার প্রকাশ আমাদের জীবনের প্রভৃতি ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করছে। সুতরাং, এমন একটি বিশ্বের সাক্ষী হতে প্রস্তুত হোন যেখানে রোবট বিস্ময়কর সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত করতে যাচ্ছে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আবিষ্কার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

twelve − 1 =