প্যারিস অলিম্পিক যাদের আলোয় আরও উজ্জ্বল

নিবিড় চৌধুরী

বিতর্ক আর সমালোচনার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল প্যারিস অলিম্পিক। খেলা চলার মাঝেও কম বিতর্ক হয়নি। ফ্রান্স জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ট্রেনে আগুন, সন্ত্রাসী হামলার হুমকি, সীন নদীর দূষিত পানি, অলিম্পিক ভিলেজে খাবার ও থাকা নিয়ে অভিযোগ; কী ছিল না! তবে ঠিক ১০০ বছর পরে তৃতীয়বারের মতো নিজেদের দেশে অলিম্পিক আয়োজন সফলভাবেই শেষ করেছে ফ্রান্স। দেশটির জাতীয় স্টেডিয়াম স্তাদে দে ফ্রান্সে সমাপনী দিনও ছিল ঝলমলে আর তারায় ভরপুর। গত ২৬ জুলাই প্যারিসের সীন নদীর দুই পাড়ের জমকালো উদ্বোধনীর পর ১৭ দিনের প্যারিস অলিম্পিকে এবার যেসব তারকা ও ইভেন্ট নিয়ে আলোচনা ছিল সেটি নিয়ে এই আয়োজন:

লেডেকি বসলেন লাতিনিনার পাশে

অস্ট্রেলিয়ার মেয়ে আরিয়ার্না টিটমাস থেকে ৪০০ মিটার সাঁতারে সিংহাসন পুনরুদ্ধার করতে পারেননি কেটি লেডেকি। শুরুতে ‘রেস অব দ্য সেঞ্চুরি’তে ব্রোঞ্জ জিতলেও প্যারিস অলিম্পিকে দুই সোনাসহ ৪ পদক নিয়ে এখন তিনিই যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে সফল অ্যাথলেট। সাঁতারের রানি মোট ১৪ পদক নিয়ে ছাড়িয়ে গেছেন স্বদেশি সাঁতারু জেনি থম্পসনকে। অলিম্পিকে নারী অ্যাথলেটদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯ সোনা জিতে লেডেকি পাশে বসেছেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের লারিসা লাতিনিনার পাশেও। অভিষেক অলিম্পিকেই মেয়েদের সাঁতারে আলো ছড়িয়েছেন কানাডার ১৭ বছর বয়সী মেয়ে সামার ম্যাকিন্টোশ।

ফটো ফিনিশিংয়ের লাইলসের স্বর্ণ

করোনা আক্রান্ত হওয়ায় অলিম্পিকের সমাপনীতে মাস্ক পরে এসেছিলেন নোয়াহ লাইলস। অসুস্থ শরীর নিয়েও ২০০ মিটারে ব্রোঞ্জ জেতেন তিনি। তার আগে ১০০ মিটারে জেতেন সোনা। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের অন্যতম আকর্ষণ এই ইভেন্টে যুক্তরাষ্ট্রের দৌড়বিদের টাইমিং ছিল ৯.৭৯ সেকেন্ড। রুপা জেতা জ্যামাইকার কিশানে থম্পসনেরও টাইমিং ছিল সমান। তবে লাইলস সোনা জেতেন ফটো ফিনিশিংয়ে এগিয়ে থাকায়। ১০০ মিটারে যে আট প্রতিযোগি অংশ নেন সবার টাইমিং ছিল ১০ সেকেন্ডের নিচে। এমনটা আগে দেখা যায়নি অলিম্পিক ইতিহাসে।

নতুন ‘জলদেবতা’ মারশাঁর চার কীর্তি

অলিম্পিক শুরুর আগে থেকে ঘরের ছেলে লিওঁ মারশাঁকে নিয়ে প্যারিসবাসীর আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। ‘নতুন ফেলপস’ ৪ সোনা ও ১ ব্রোঞ্জ জিতে এবারের অলিম্পিকে সবচেয়ে সফল অ্যাথলেটও। এক অলিম্পিকে প্রথম ফরাসি ও যুক্তরাষ্ট্রের মাইকেল ফেলপসের পরে ৪ পদক জেতা একমাত্র সাঁতারুও এখন তিনি। সোনা জেতা চারটি ইভেন্টেই অলিম্পিক রেকর্ড গড়েছেন নতুন ‘জলদেবতা’ মারশাঁ। তার মধ্যে ভেঙেছেন ফেলপসের দুটি রেকর্ড।

জোকোভিচের ক্যারিয়ার গোল্ডেন স্লাম

এ বছরের উইম্বলডনের ফাইনালে স্পেনের কার্লোস আলকারাসের কাছে হেরেছিলেন নোভাক জোকোভিচ। সার্বিয়ান তারকা সেটির প্রতিশোধ নিয়েছেন রোলাঁ গারোতে, এবারের অলিম্পিকে। ৭-৬ (৭-৩),৭-৬ (৭-২) গেমে জিতে প্রথমবার অলিম্পিক সোনা জেতার আনন্দে কাঁদেন রেকর্ড ২৪ গ্র্যান্ড স্লামের মালিক। স্তেফি গ্রাফ, সেরেনা উইলিয়ামস, আন্দ্রে আগাসি ও রাফায়েল নাদালের পরে পঞ্চম টেনিস তারকা হিসেবে ক্যারিয়ার গোল্ডেন স্লাম জয়ের কীর্তি গড়লেন জোকোভিচ। টেনিসে বেশি বয়সে (৩৭ বছর ৭৪ দিন) সোনা জয়েরও রেকর্ড গড়লেন। জোকোর অলিম্পিক অভিষেক হয়েছিল ২০০৮ সালে।

রিংয়ে খেলিফের লৈঙ্গিক বিতর্ক

ইমান খেলিফের শক্তিশালী ঘুষিতে মাত্র ৪৬ সেকেন্ডেই কাঁদতে কাঁদতে রিং ছেড়েছিলেন ইতালির অ্যাঞ্জেলো কারিনি। এরপর থেকে শুরু হয় খেলিফকে নিয়ে লৈঙ্গিক বিতর্ক। ছেলে না মেয়ে, এই বিতর্ক ও সমালোচনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মেয়েদের ৬৬ কেজিতে দাপটের সঙ্গে সোনা জেতেন এই আলজেরিয়ান বক্সার। প্রথম অলিম্পিক সোনা জেতা খেলিফ ক্যারিয়ারের শুরু থেকে পেরিয়েছেন অনেক বাধা। সোনা জয়ের পর যারা সামাজিকমাধ্যমে তাকে হয়রানি করেছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলাও টুকে দেন খেলিফ।

বাইলসের বিশেষ ছাগলের লকেট

মানসিক স্বাস্থ্যের কারণে টোকিও অলিম্পিকে একাধিক ইভেন্ট থেকে নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন সিমোনে বাইলস। সেই হতাশা কাটিয়ে প্যারিস অলিম্পিকে দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তনের গল্প লেখেন তিনি। ইতিহাসের সেরা এই জিমন্যাস্ট দলীয় ও ব্যক্তিগত ইভেন্ট মিলিয়ে এবার ৩ সোনা ও ১ রুপা জিতেছেন। পরে মেয়েদের অল অ্যারাউন্ডের ফাইনালে সোনা জেতার পর গলায় পরে আসেন ৫৪৬ হিরে দিয়ে তৈরি ছাগলের মতো দেখতে বিশেষ লকেট। জিমন্যাস্টিকসে সর্বকালের সেরা ‘গোট’ বোঝাতেই বাইলসের এই ছাগলের হার পরিধান।

তারকাদের নিয়ে বিতর্ক ছাড়াও প্যারিস অলিম্পিকে আরও বেশ কিছু ঘটনা আলোচিত হয়েছে। সীন নদীর পানি দূষিত হওয়ায় বেশ কয়েকবার স্থগিত হয়ে যায় ট্রায়াথলনের লড়াই। সোনার পদক নিয়ে দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে হয়েছে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। পদক সংখ্যায় দুইয়ে থেকে অলিম্পিক শেষ করলেও্ এশিয়ার বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের সমান ৪০ সোনা জিতে অবাক করে দিয়েছে চীন। তবে এবারও বাংলাদেশের অংশগ্রহণকারীদের কেউ পদক জেতা দূরে থাক, নিজেদের ইভেন্টে বাছাইপর্বও পেরোতে পারেননি।

এবার টেস্টেও দেখিয়ে দেওয়ার পালা

রাওয়ালপিন্ডির কথা উঠলেই শোয়েব আকতারের কথা না বলে কী থাকা যাবে! বিশ্বের সবচেয় দ্রুতগতির বোলারকে ক্রিকেটপ্রেমীরা মনে রাখবেন সবসময়। আর বাংলাদেশিরা মনে রাখবেন নাহিদ রানাকেও। মাত্র চতুর্থ টেস্ট খেলতে নেমে যা করলেন এই পেসার, সেটি অবাক করে দিয়েছে ‘রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস’ শোয়েব আকতারকেও। রাওয়ালপিন্ডিতে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে নাহিদ গতির ঝড় তুলেছেন ঘণ্টায় গড়ে ১৪০+ কিলোমিটার মিটার বেগে বল করে! ভাবা যায়!

একজন বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে এ যে অকল্পনীয়! পাকিস্তানি ব্যাটাররা নাহিদের বল খেলতে সময় পেয়েছেন মাত্র ০.৪৯ সেকেন্ড। একেকটা বাউন্সারে বাবর আজমদের হার্টবিট বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। উইকেটরক্ষক মোহাম্মদ রিজওয়ানের তো রীতিমতো মাথা বাঁচাতে পারলে বাঁচেন অবস্থা হয়েছিল। যেভাবে নাহিদের একটি বাউন্সার তার মাথায় লেগেছে, ভাগ্যিস হেলমেট ছিল। নয়তো রক্তারক্তি অবস্থা হয়ে যেত। বল মাথায় লাগার পর রিজওয়ান দ্রুত হেলমেট খুলে দেখেন কোনো আঘাত লেগেছে কিনা।

নাহিদ কেমন ভয়ংকর বল করেছেন তার আরও একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। তার একটি বল ছিল ঘণ্টায় প্রায় ১৫২ কিলোমিটার! ১৫০ কিমি এর আশেপাশে বল করতে দেখা গেছে নিয়মিত। সেটিও টেস্টে। টানা এমন বল করা যে কত কঠিন, সেটা পেসারদের চেয়ে আর কে ভালো জানবেন। বাংলাদেশি পেসারদের মধ্যে এমন দ্রুত গতিতে আর কেউ বল করতে পারেননি আজ পর্যন্ত। দেশের দ্রুতগতির বোলারদের মধ্যে তাসকিন আহমেদে একবার ১৫০ কিমি গতিতে বল করেছিলেন। নাহিদ পেসারদের জন্য স্বর্গভূমি পাকিস্তানে ভাঙলেন সেই রেকর্ড। বাংলাদেশের ক্রিকেটে কম পেসার আসেননি। নতুন দশকের শুরুর দিকে খুব কম গতি নিয়ে খালেদ মাহমুদ সুজন হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশ দলের অন্যতম পেসার। তবে মাশরাফি বিন মর্তুজা আসার পর একজন খাঁটি পেসারের দুঃখ অনেকখানি কমে যায়। এরপর তো রুবেল হোসেন, মোস্তাফিজুর রহমান, তাসকিন, শরীফুল ইসলাম, তানজিম সাকিবদের মতোন পেসাররা এসেছেন। তারা সফলও। তবে গতিতে নাহিদ যেন সবাইকে ছাড়িয়ে গেলেন ক্যারিয়ারের শুরুতেই।

পেসারদের জন্য শারীরিক উচ্চতা বড় এক আশীর্বাদ। ‘ক্রিকেট ঈশ্বরের’ সেই আশীর্বাদ আছে প্রায় ৬ ফুট ২ ইঞ্চির নাহিদের ওপর। গত ডিপিএলে গতির ঝড় তোলার পর জাতীয় দলে জায়গা পেতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি তাকে। এবার তো চতুর্থ টেস্ট খেলতে নেমেই পেলেন ক্যারিয়ার সেরা ফিগার ৪/৪।

বাংলাদেশও পাকিস্তানে পেয়েছে ঐতিহাসিক জয়। পাকিস্তানকে তাদের মাটিতে হারানো এ তো সহজ বিষয় নয়। রাওয়ালপিন্ডিতে মুশফিকুর রহিমের মহাকাব্যিক ১৯১ রান আর সাদমান ইসলাম, মুমিনুল হক, লিটন দাস ও মেহেদী হাসান মিরাজের ফিফটিতে প্রথম ইনিংসে রানের পাহাড় গড়ে বাংলাদেশ। পরে সিরিজের সেই প্রথম টেস্ট ১০ উইকেটে জেতে সফরকারী দল। টেস্টে যে এবারই প্রথম দ্বিতীয় ইনিংসে কোনো উইকেট না হারিয়ে লক্ষ্য তাড়া করে জিতেছে বাংলাদেশ।

সেই কীর্তি যেন আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠল রাওয়ালপিন্ডিতে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে। কী করেনি বাংলাদেশ! প্রথম ইনিংসে ২৬ রানে ৬ উইকেট হারানোর পর যেভাবে মিরাজ ও লিটন প্রতিরোধ গড়লেন সেটাকে বাংলাদেশের তো বটে বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা ২০ জুটির মধ্যেও রাখা যাবে। এই জুটিই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে জিতেয়েছে। এই টেস্টে বৃষ্টির কারণে প্রথম দিনে টসই হয়নি। দ্বিতীয় দিনে মিরাজ ৫ উইকেট নিয়ে পাকিস্তানের প্রথম ইনিংস বড় করতে দেননি। তবে সেই উচ্ছ্বাসটা বেশিক্ষণ থাকেনি বাংলাদেশের। তৃতীয় দিনে স্বাগতিকদের পেসারের সামনে সাকিব-মুশফিকরা যেভাবে উইকেট বিলিয়ে এসেছিলেন, মনে হচ্ছিল কী লজ্জায় না পড়ে বাংলাদেশ। তবে এরপরই সপ্তম উইকেটে মিরাজ-লিটনের অবিশ্বাস্য জুটি। বাংলাদেশ পেয়ে যায় ২৬ থেকে ২৬২ রান। মিরাজ সেঞ্চুরি বঞ্চিত হলেও লিটন ধ্রুপদী ব্যাটিংয়ে পেয়েছেন তিন অঙ্কের দেখা। এরপর শেষদিনে বৃষ্টি চোখ রাঙালেও ৬ উইকেটের জয় নিয়ে পাকিস্তানকে বাংলাওয়াশ করে নাজমুল হোসেন শান্তরা। এর আগের দিন হাসান মাহমুদের ৫ উইকেট ও নাহিদের ৫ উইকেট নিয়ে পাকিস্তানের লক্ষ্য বড় হতে দেননি।

এই সফরে কত কীর্তি যে গড়েছে বাংলাদেশ! প্রথমবারের মতো পাকিস্তানকে টেস্টে হারানো, প্রথমবার সিরিজ জয়, প্রথমবার ধবলধোলাই, প্রথমবার ১০ উইকেটের জয়, প্রথমবার টেস্টে এক ইনিংসে পেসারদের ১০ উইকেট। এমন অনেক প্রথমের স্বাক্ষী হলো বাংলাদেশ। হাসিমুখে সিরিজ জিতেও ফিরেছে দেশে। এবার শান্তদের পালা ভারত সফর সফরের জন্য প্রস্তুতি। সেপ্টেম্বরে দুই দল দুটি টেস্ট ও তিনটি টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলবে। পাকিস্তানে জয়ের ধারাবাহিকতা কি বাংলাদেশ ধরে রাখতে পারবে ভারতেও? তেমনটা করতে পারলে প্রথমবার আইসিসি বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে খেলার সম্ভাবনাও আছে শান্তদের। এখন যে চ্যাম্পিয়নশিপের তালিকার নিজেদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ চতুর্থ স্থানে আছে বাংলাদেশ। ওয়ানডেতে বাংলাদেশ অনেক দিন ধরে সমীহ জাগানিয়া দল। এবার বুঝি টেস্টেও সেই অধ্যায় শুরু হলো।

লেখাটির পিডেএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খেলার মাঠ

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

fifteen − 1 =