সালেক সুফী
বাংলাদেশ ২০০০ থেকে বিশ্ব ক্রিকেটের কুলিন টেস্ট পরিবারের সদস্য। সাফল্য এসেছে কালে ভদ্রে। রঙিন পোশাকের সংক্ষিপ্ততর ভার্সন ওডিআই এবং টি ২০ খেলছে বহুদিন থেকে। সেখানেও কিন্তু সাফল্যের থেকে ব্যার্থতার পাল্লা ভারী। তবুও অন্যান্য খেলাগুলোর সঙ্গিন অবস্থার কারণে এবং ব্যাপক মিডিয়া প্রচারের কল্যাণে ক্রিকেট বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা বললে ভুল হবে না। বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্রিকেট নিয়ে হয় ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা, বিশ্লেষণ, ব্যাবচ্ছেদ। সাফল্য ব্যার্থতার পরিমণ্ডলে ঘুরপাক খেতে থাকা ক্রিকেট নিয়ে বিতর্ক সমালোচনা অন্তহীন। এমনি এক অবস্থায় বিশ্ব ক্রিকেট পরিবারে নিচের সারির (আন্ডার ডগ) বাংলাদেশ দলের অধিনায়কের চ্যালেঞ্জগুলো সহজেই অনুমেয়। কালে ভদ্রে যখন জয় আসে কৃতিত্ব ভাগিদার হতে মানুষের অভাব হয় না। কিন্তু ব্যর্থ হলেই দায়ভার অধিকাংশ ক্ষেত্রে অধিনায়ককে বহন করতে হয়। দলের নির্বাচন বা একাদশ নির্বাচনে মুখ্য ভূমিকা রাখার পরিবেশ না থাকলেও অধিনায়ক করতে হয় জবাবদিহি। বিরূপ সমালোচনা হয় সোশ্যাল মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং প্রিন্ট মিডিয়ায়। কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা হয় অহরহ। এমতাবস্তায় মাঠের এবং মাঠের বাইরের চাপ সামাল দিয়ে নিজের খেলার প্রতি নজর দেয়ায় সৃষ্টি হয় মারাত্মক চাপ।
নানা কারণেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের কোনো সংস্কৃতি গড়ে উঠে নি। ঘরোয়া ক্রিকেটের ছন্নছাড়া অবস্থা। না আছে উন্নত অবকাঠামো, না আছে ভালো মানের প্রতিযোগিতা। আইসিসি পূর্ণ সদস্য দেশতো দূরের কথা অনেক সহযোগী সদস্য দেশের অবকাঠামো বাংলাদেশ থেকে অনেক উন্নত। এমতাবস্থায় টেস্ট বলুন বা সংক্ষিপ্ত পরিসর বলুন কোনো খেলায় বাংলাদেশের পাইপ লাইন আদৌ সমৃদ্ধ না। এমতাবস্থায় প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশ দলের সঙ্গিন অবস্থা নিয়ে অধিনায়কের উপর দায় চাপানো দুঃখজনক। দলের ব্যর্থতার দায় দায়িত্ব এককভাবে অধিনায়কের উপর চাপানোর কোনো কারণ নেই। এমন অবস্থায়ও হাবিবুল বাসার সুমন, মাশরাফি বিন মুর্তজা, মুশফিকুর রহিম, সাকিব উল হাসান, তামিম ইকবাল, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ অধিনায়কত্ব করেছে নানা প্রতিকূলতা মাথায় নিয়ে। কারোর চলে যাওয়া শুভকর হয় নি। আর অধিনায়কের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে টিমের থিঙ্ক ট্যাঙ্কার সম্পর্ক মধুর ছিল না। সাম্প্রতিক সময়ে কোন বিবেচনায় নাজমুল হাসান শান্তকে তিন ফরম্যাটে অধিনায়ক করা হয়েছিল তার জবাব দেয়া উচিত যারা তাকে দায়িত্ত দিয়েছে। স্থানীয় ক্রিকেটে সফল শান্ত ছাড়া তিন ফরম্যাটে বিকল্প ছিল না বলা যাবে না। দলে নানা বিষয়ে টান পরন, সাকিব -তামিম দ্বন্দ্ব, হেড কোচ হাতুরাসিংহকে নিয়ে বিতর্ক, পঞ্চপান্ডবদের ক্রিকেট অপরাহ্ন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ক্রমাবনতি। এই অবস্থায় দলকে তিন ফরম্যাটে নেতৃত্ব দিতে নাজমুল শান্ত চেষ্টার ত্রুটি করেছে বলবো না। সাফল্য এসেছে সামান্য, ব্যর্থতা বেশি। অধিনায়কত্বের চাপে নিজের পারফরমেন্স ধরে রাখতে পারে নি। আর সোশ্যাল মিডিয়ায় অনাকাঙ্খিত কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য হয়তো ওকে মানসিকভাবে আহত করেছে। তাই হয়ত শান্ত অধিনায়কত্ব করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। শান্তর বদলে মেহেদী মিরাজ, তাওহীদ হৃদয়, লিটন কুমার দাস যাকেই অধিনায়ক করা হোক পরিস্থিতির কিন্তু ব্যত্যয় ঘটবে না। বাংলাদেশ ক্রিকেট বর্তমান পর্যায়ে তিন ফরম্যাটে একজন অধিনায়কের জন্য উপযোগী না। বিশেষত টেস্ট ক্রিকেটে একজন অপেক্ষাকৃত পরিণত খেলোয়াড়কে অন্তত দুই বছর মেয়াদে দায়িত্ব দিয়ে তাকে সকল অংশীজনদের সমর্থন দিতে হবে, স্বাধীনতা দিতে হবে। মিডিয়া বা কনটেন্ট ক্রিয়েটারদের অযাচিত সমালোচনা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নাহলে কিন্তু কোন আত্মসচেতন ক্রিকেটার বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক হতে স্বস্তি বোধ করবে বলে মনে হয় না।
জানিনা কি করবে বিসিবি। বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। নাজমুল শান্তর মাঝে নেতৃত্বের গুণাবলী অবশ্যই আছে। ব্যাটসম্যান হিসাবে অনেক ভালো ইনিংস খেলেছে। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় নিঃসন্দেহে অনেক মানসিক চাপে আছে। দেখুন ভারতের রোহিত শর্মা তার মান অনুযায়ী খেলতে পারছে না। ভারত দল হেরে যাচ্ছে। তাই বলে কি রোহিতকে নিয়ে তেমন কিছু ভাবছে ভারত? পাকিস্তানের না হয় বিকল্প ছিল। বিকল্প পথে হেটে সাফল্য পেয়েছে। কিন্তু সেই বাবর আজম আবারো ফিরে আসছে।
আসলে বাংলাদেশ ক্রিকেটে কৌশলগত পরিবর্তন প্রয়োজন। দীর্ঘস্থায়ী সাফল্যের বা সাফল্যের ধারাবাহিকতার জন্য প্রয়োজন অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে খেলোয়াড় নির্বাচন, অধিনায়ক নির্বাচনের একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ পদ্ধতি এবং সর্বস্তরে জবাবদিহিতা। তাহলেই একটি সিরিজের মাঝপথে তামিমের মত নাটক আর শান্তর মত অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেয়ার পরিস্থিতি হবে না। মাশরাফি, সাকিব রিয়াদ, মুশফিকের মত হুট্ করে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিতে হবে না। সবাইকেই বাংলাদেশের মত আন্ডারডগ দলের অধিনায়কের চ্যালেঞ্জ বুঝতে হবে।