ট্রমার শিকার হতে পারেন যে কেউ

ময়ূরাক্ষী সেন

মানুষের জীবনে কখনো না কখনো কিছু অনাকাক্সিক্ষত মুহূর্ত আসে। মানুষের জীবনের পুরোটা তার নিয়ন্ত্রণে থাকে না কখনো কখনো ঘটে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে কোনো ঘটনা। কারো মানসিক শক্তি থাকে অনেক বেশি। যত বড় অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় ঘটুক না কেন সেটা খুব সহজে মেনে নিয়ে জীবনের পথে এগিয়ে যেতে পারে। আবার কেউ কেউ মনের দিক থেকে এত দুর্বল থাকে যেকোনো ঘটনাতে সে হয়ে পড়ে ট্রমাটিক।

মানুষের পক্ষে অনেক সময় ট্রমা কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা হয়ে ওঠে কষ্টসাধ্য। বিশেষজ্ঞদের মতে কোনো বিশেষ ঘটনার উপর ইমোশনাল প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ট্রমা। বিভিন্ন কারণে মানুষ ট্রমাটিক হয়ে উঠতে পারে। এমন অনেক ঘটনা আছে যা হয়তো অনেকের কাছে মনে হতে পারে এটা ট্রমাটিক কিছু না। কিন্তু এটি আবার আরেকজনের উপর বিশেষভাবে প্রভাব ফেলে। কারো সহ্য ক্ষমতা বেশি থাকায় অনেক বড় ট্রমাটিক ঘটনাকেও তার কাছে তুচ্ছ মনে হতে পারে। আবার একই ঘটনা আরেকজনকে বিধ্বস্ত করে দিতে পারে। জীবনে ট্রমার শিকার হতে পারেন যে কেউ। জেনে নেওয়া যাক কিভাবে ট্রমা থেকে ফিরে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায়।

ট্রমার বিভিন্ন ধরন রয়েছে। বিভিন্ন ঘটনা মানুষের মন বিচলিত করে দেয় এবং এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে মানুষ ট্রমাটিক হতে পারে। বিভিন্ন কারণে মানুষ ট্রমার শিকার হলেও কিছু সাধারণ কারণ হলো:

শারীরিক অসুস্থতা

মানুষ যেকোনো সময় বড় কোনো দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এমন অনেক রোগে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে যা নিরাময় করা কঠিন। ক্যান্সার, ব্রেন টিউমার, এইচআইভিতে মানুষ আক্রান্ত হয়। কিন্তু অনেকে প্রথম ধাক্কায় এই রোগ মেনে নিতে পারে না। প্রতিনিয়ত তাদের অনিশ্চিত জীবনের কথা চিন্তা করে ট্রমার শিকার হয়ে যায়। শারীরিকভাবে তারা অসুস্থ থাকে, এর উপর যখন তাদের মানসিক চাপ পড়ে তখন তাদের অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। শুধু যে বড় রোগে আক্রান্ত হলেই মানুষ ট্রমাটিক হয় তা নয়, অনেক মানসিক অবস্থা এমন থাকে যেকোনো ছোটখাটো রোগেও তারা বিচলিত হয়ে ট্রমাটিক হয়ে পড়ে। জ্বর ঠান্ডা কাশির মতো সামান্য রোগ নিয়েও তারা অনেক বেশি চিন্তা করে। সামান্য রোগকে তারা অনেক বড় রোগের লক্ষণ মনে করে এবং ট্রমার শিকার হয়।

প্রিয়জনের মৃত্যু

প্রিয়জনের মৃত্যু সবার কাছেই বেদনাদায়ক। বাবা, মা, স্বামী স্ত্রী, ভাই বোন কাছের কোনো বন্ধু; যে কারো মৃত্যুতেই মানুষের ভীষণ কষ্ট হয়। প্রিয়জনের মৃত্যুতে কিছুদিন ট্রমাটিক থাকা বেশ স্বাভাবিক। কিন্তু মাসের পর মাস, বছরের পর বছর মানুষ যখন এই ট্রমা থেকে বের হতে পারবে না এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে না তখনই তা চিন্তার বিষয়। প্রিয়জনের মৃত্যু ছাড়াও প্রিয়জনের দীর্ঘমেয়াদি বড় রোগেও মানুষ অনিশ্চয়তার জন্য ট্রমাটিক হতে পারে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ

বন্যা, নদী ভাঙ্গন, ঝড়, ভূমিকম্প, খরা ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো মানুষ দীর্ঘমেয়াদি ট্রমার শিকার হতে পারে। কারণ এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণ হারানোর পাশাপাশি সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সম্পর্ক বিচ্ছেদ

দীর্ঘদিনের সম্পর্ক বিচ্ছেদ, বিবাহ বিচ্ছেদ ইত্যাদি যেকোনো ধরনের বিচ্ছেদের ফলেও মানুষ ট্রমার শিকার হতে পারে। সম্পর্ক বিচ্ছেদের পর কিছুদিন খারাপ লাগা স্বাভাবিক। কিন্তু এতে জীবনের প্রয়োজনীয় কাজে বাধা আসলে তাকে ট্রমাটিক অবস্থা বলে ধরে নিতে হবে।

অন্যান্য কারণ

দুর্ঘটনা, পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করা ও আরও অনেক কারণেই মানুষ ট্রমার শিকার হতে পারে। সাধারণ কারণ ছাড়াও অনেকে ছোটখাটো বিষয়েও মানুষ ট্রমাটিক পরিস্থিতিতে পড়ে যায়।

যেকোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় কিংবা খারাপ পরিস্থিতিতে বেশকিছু দিন মানসিকভাবে বিধ্বস্ত থাকা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এটি স্বাভাবিক জীবন বাধাগ্রস্ত হলেই আমাদের বুঝতে হবে এটি ট্রমা। ট্রমার শিকার হয়ে আত্মহত্যার ঘটনা বিরল নয়, অনেক মানুষ তাদের ট্রমাটিক জীবন থেকে বের হতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। যেকোনো ট্রমা থেকে বের হয়ে একটি সুন্দর স্বাভাবিক জীবন সকলের কাম্য। জীবন যেহেতু মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই তাই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাগুলো আটকানোর সুযোগ নেই। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতে ট্রমা থেকে বের হয়ে কিভাবে সুন্দর জীবনযাপন করা যায় তা জেনে নেওয়া প্রয়োজন।

যেকোনো ট্রমা থেকে বের হওয়ার প্রথম পদ্ধতি হচ্ছে পরিস্থিতি মেনে নেওয়া। যেকোনো পরিস্থিতিকে মেনে নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে পারলে ট্রমা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। অনেকের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক বেশি অনিশ্চয়তা রয়েছে, তারা প্রতিনিয়ত ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে কিংবা অতীত নিয়ে আফসোস করে। প্রতিনিয়ত ভবিষ্যৎ কিংবা অতীত নিয়ে চিন্তা মানুষকে বিধ্বস্ত করে দেয়। মানুষের প্রথম শিক্ষা নেওয়া উচিত কিভাবে বর্তমান নিয়ে বাঁচা যায়।

বর্তমান নিয়ে বাঁচতে শিখলে ট্রমা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এবং জীবনের যে অংশগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই তা মেনে নিতে হবে। জীবন কখনো একই নিয়মে চলবে না। চলার পথে আসবে নানা রকম বাধা ও দুর্ঘটনা। এগুলো থেকে বের হওয়ার সফল পদ্ধতি আমাদের জেনে নিতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে যেকোনো খারাপ পরিস্থিতি প্রথম দিকে খারাপ লাগার অনুভূতিকে মেনে নিতে হবে। কিছুদিন নিজেকে সময় দিতে হবে। আমরা যদি সঙ্গে সঙ্গে যেকোনো পরিস্থিতিতে আশা করি ভালো অনুভব করব তাহলে তা আমাদেরকে আরো খারাপ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিবে। মনে রাখতে হবে কোনো অনুভূতি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ভালো এবং খারাপ মিলেই মানুষের পরিপূর্ণ জীবন। ভালো সময়গুলো যেমন আমরা উপভোগ করি তেমনই ট্রমাটিক সময়গুলো মেনে নিয়ে এখান থেকে ধীরে ধীরে বের হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তবে যেকোনো ট্রমাটিক পরিস্থিতি থেকে দ্রুত বের হওয়ার আশা করা উচিত নয়। নিজেকে সময় দিয়ে এবং পরিস্থিতি মোকাবেলা করে সেখান থেকে বের হতে হবে।

ট্রমাটিক পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার জন্য অবশ্যই কাছের মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। দীর্ঘদিন মনের মধ্যে কথা চেপে রাখার ফলে এর ফলাফল আরো ভয়ানক হতে পারে। তাই কাছের মানুষের সাথে আপনার পরিস্থিতি ও মনের অবস্থা নিয়ে কথা বলুন। ধীরে ধীরে চেষ্টা করতে হবে নিয়মিত জীবনে ফিরে আসার। পছন্দের যেকোনো কাজ, গান শোনা, বই পড়া, সিনেমা দেখা ইত্যাদি ধীরে ধীরে শুরু করতে পারেন। খারাপ পরিস্থিতিতে নিজেকে ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করুন। উত্তেজিত না হয়ে পরিস্থিতিকে বোঝার চেষ্টা করুন। মন শান্ত রাখার জন্য মেডিটেশন কিংবা ইয়োগার করতে পারেন। এছাড়া চেষ্টা করতে পারেন নতুন কোনো বন্ধু তৈরি করার কিংবা নতুন করে কোনো কাজ কিংবা শখের কাজ শেখার। রান্না করতে না জানলে রান্না করা শুরু করতে পারেন, নতুন সিনেমা দেখার চেষ্টা করতে পারেন। এছাড়া দিনে কিছুটা সময় শারীরিক পরিশ্রম ডোপামিন হরমোন বাড়তে সাহায্য করে। এ জন্য ব্যায়াম করতে পারেন।

মন অনেক সময় আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। তখন অনেক চেষ্টা করেও যেকোনো পরিস্থিতি থেকে আমরা বের হতে পারি না। সেক্ষেত্রে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ কিংবা মনোবিদদের সাহায্য নিতে হবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্বাস্থ্যকথা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

fourteen − 9 =