‘আলো আসবেই’ গ্রুপ নিয়ে সমালোচনা

মৌ সন্ধ্যা

সবাই চায় আঁধার ফুরিয়ে আলো আসুক। রাত শেষে নতুন ভোরকে সকলেই শুভকামনা জানাতে চায়। এই সুন্দর বাক্য শুনে কী কারো মন খারাপ হতে পারে? ব্যাবহার ভেদে শব্দের অর্থ পাল্টে যায়! শোনা যাচ্ছে এই সুন্দর শব্দটি বলেই নাকি তারকাদের ক্ষেপাচ্ছে সাধারণ মানুষ। পথে কোনো তারকার দেখা পেলে ‘আলো আসবেই’ বলে টিটকারি করছে নেটিজেনরা।

বাক্যটির অপরাধ কী?

বাংলাদেশের রাজনীতি এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক নিলো সম্প্রতি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন এবং দেশ ত্যাগ করেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অন্তত ৬৩১ জন ছাত্র-জনতা প্রাণ হারিয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ১৯ হাজার ২০০ জনের বেশি। আন্দোলন সফল হয়েছে। তবে ‘আলো আসবেই’ নামে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আওয়ামীপন্থী শিল্পীরা শুরু থেকেই আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন।  আন্দোলনকারী ও আন্দোলনের পক্ষে থাকা নির্মাতা ও শিল্পীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিলেন তারা। নেটিজেনদের অভিযোগ ‘আলো আসবেই’ শিরোনামে গ্রুপ করে মানুষ হত্যার ইন্ধন জুগিয়েছেন তারকারা। সুন্দর এই বাক্যটির  অপব্যাবহার করেছেন তারা।

কারা ছিলেন গ্রুপে

এই গ্রুপের অ্যাডমিন ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদ, চিত্রনায়ক রিয়াজ, অভিনেতা সাজু খাদেম ও অভিনেত্রী শামীমা তুষ্টি। এই গ্রুপে সক্রিয় ছিলেন সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে অরুণা বিশ্বাস ছাত্রদের গায়ে গরম পানি ঢেলে দিতে বলেছিলেন। অভিনয় শিল্পীদের ফাঁস হওয়া চ্যাটের ১৬০টি স্ক্রিনশট ও তালিকা প্রকাশিত হয়েছে।

গ্রুপ নিয়ে সমালোচনা

হোয়াটসঅ্যাপে ‘আলো আসবেই’ গ্রুপের শতাধিক স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত ও চিত্রনায়ক ফেরদৌসের নেতৃত্বে গড়ে তোলা এই গ্রুপের স্ক্রিনশট নিয়ে এখন বইছে সমালোচনার ঝড়। গ্রুপটিতে যাদের নিয়ে নানা রকম মন্তব্য করা হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম অভিনেত্রী সাদিয়া আয়মান। অভিনেতা মিলন ভট্টাচার্য সাদিয়ার স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট ‘আলো আসবেই’ গ্রুপে দিয়েছিলেন। ফাঁস হওয়া চ্যাটে সাদিয়াকে ‘তথাকথিত জনপ্রিয় অভিনেত্রী’ হিসেবেও উল্লেখ করেছিলেন মিলন। এরপরই নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন সাদিয়া আয়মান। মিলন ভট্টাচার্যকে ট্যাগ করে তিনি লিখেছেন, ‘আপনাকে ধন্যবাদ দাদা, মানুষের মতো দেখতে, শিল্পী নামের শয়তান বেশধারীদের কাছে আমার মতো “এই সময়ের তথাকথিত জনপ্রিয় অভিনেত্রী”কে চিনিয়েছেন, যে ভুলকে ভুল বলতে জানে, সত্যকে সত্য বলতে জানে। গ্রুপের নাম দিয়েছেন “আলো আসবেই” তা বেশ ভালো, তবে আপনারা জানেন আপনাদের নিজেদের জীবনে, মস্তিষ্কে সত্যিকারের আলোর যে ভীষণ প্রয়োজন?’ আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে অভিনেত্রী অরুণা বিশ্বাসের ‘গরম জল দিলেই হবে’ কথায় ঘৃণা উগরে দিয়েছেন চিত্রনায়িকা পরীমণি। অরুণাকে নিয়ে প্রকাশিত একটি সংবাদের ফটোকার্ড শেয়ার করে নিজের ফেসবুক পেইজে পরী লিখেছেন, ‘অমানুষ! হিংস্র! লোভী! এত হিংসা নিয়ে কখনই শিল্পী পরিচয় বহন করতে পারেন না আপনি। ধিক আপনাকে।’ এই গ্রুপে নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে নিয়েও কথা হয়। ফলে ফারুকী বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নেননি। এটিকে মানবতাবিরোধী আখ্যা দিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেসবুকে বিচার চেয়েছেন তিনি। ফারুকী লিখেছেন, ‘এটা নিশ্চয়ই বেদনার যে আমাদের দেশে শিল্পীর সাইন বোর্ড নিয়ে এমন লোকজন ঘুরে বেড়াতো যারা গণহত্যায় প্রত্যক্ষ উস্কানিদাতা অথবা কেউ কেউ নিরব সমর্থক ছিল। এরা শুধু শিল্পী হিসাবে না, মানুষ হিসাবেও নিচু প্রকৃতির। একাত্তরে জন্ম নিলে এরা রাজাকারের দায়িত্ব পালন করতো। ফলে এদের এযুগের রাজাকার বলতে পারেন। নিশ্চয়ই এদের বিচার হবে গণহত্যায় সমর্থন এবং উস্কানী দেয়ার অপরাধে। কিন্তু আশার দিকটা আপনাদের বলি। দেখবেন এই গ্রুপের বেশিরভাগই আসলে কোনো শিল্পচর্চার সঙ্গে সেই অর্থে জড়িত না। আমাদের মেইনস্ট্রিম (মানে টেলিভিশন, ওটিটি, এবং ফিল্মে যারা প্রধান শিল্পী; তথাকথিত এফডিসি বোঝানো হয়নি মেইনস্ট্রিম শব্দটা দিয়ে) অভিনয় শিল্পী বা ফিল্মমেকারদের কেউই এদের সঙ্গে নেই। এরাই আমাদের প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার।’

এছাড়া স্ক্রিনশটগুলো নিয়ে সমালোচনার মধ্যে আলোচনায় উঠে এসেছেন গ্রুপে থাকা ১৬০ সদস্যের নাম। এই সদস্য তালিকায় রয়েছে অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবুর নামও। এবার বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন তিনি। ফেসবুকে এক পোস্টে অভিনেতা বাবু লিখেছেন, ‘হোয়াটসঅ্যাপে “আলো আসবেই” গ্রুপে অ্যাড হওয়া প্রসঙ্গে আমার কিছু কথা, একটা গ্রুপের অ্যাডমিনের কাছে ফোন নম্বর থাকলেই তিনি সেই গ্রুপে যাকে খুশি, যতজন খুশি অ্যাড করতে পারেন। আবার এমন অনেক গ্রুপ আছে সেখান থেকে চাইলেও কেউ বের হতে পারে না। যদি অ্যাডমিন তাকে ডিলিট না করে।’ এ অভিনেতা লিখেছেন, ‘আলো আসবেই গ্রুপে আমি কখনো প্রবেশ করিনি বা কে কী লিখছে, আমি যদি ওখানে না দেখি, আমি কী করে জানব ওখানে কী লিখছে? ঢালাওভাবে কাউকে দোষারোপ করা বা সমালোচনা করা ঠিক না।

গ্রুপের দুজনকে শোকজ

ছোট পর্দার অভিনয়শিল্পী সংঘ থেকে দুজন অভিনয়শিল্পীকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তারা হলেন ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর ও সাজু খাদেম। দুজনই অভিনয়শিল্পী সংঘের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। এর মধ্যে সাজু খাদেম সাংগঠনিক সম্পাদক ও ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর আইন ও কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি আহসান হাবিব নাসিম বলেন, ‘গত ৫ সেপ্টেম্বর কার্যনির্বাহী কমিটির এক সভায় তাদের কারণ দর্শানো নোটিশ (শোকজ) পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। পরে ৭ সেপ্টেম্বর চিঠি পাঠানো হয়। গঠনতন্ত্রের ৭.৫ ধারা মোতাবেক তাদের শোকজ করা হয়েছে। জানা গেছে, এই ধারায় বলা আছে সংগঠনবিরোধী কোনো কাজে লিপ্ত হলে তাদের শোকজ করতে পারে সংগঠন। কারণ দর্শানোর চিঠিটি পেয়েছেন দুজনই। এটি নিশ্চিত করছেন ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর। তিনি জানিয়েছেন, চিঠি দেওয়ার জন্য ৭ কার্যদিবস সময় পেয়েছেন তারা। সেই অনুযায়ী আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর শেষ দিন। উত্তর দেওয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন বলে জানান।

শিল্পী সংঘের আন্দোলন

এরই মধ্যে অভিনয়শিল্পী সংঘের নানা কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সংস্কার দাবি করেছে অভিনয়শিল্পীদের একটি দল। তারা বেশ কিছু সভা-সমাবেশও করেছে। তাদের দাবি প্রসঙ্গে নাসিম বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমাদের আলোচনার সুযোগ রয়েছে। তাই আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে। পাশাপাশি ২৮ সেপ্টেম্বর আমরা সাধারণ সভার ডাক দিয়েছি। সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।’

আবারও সোহানা সাবার পোস্ট

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়মী লীগ সমর্থিত অভিনয় শিল্পীদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ছিলেন সোহানা সাবা। ১২ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে  সোহানা সাবা লিখেছেন, ‘ভেবেছিলাম সামনে অন্ধকার ঘন, দেখেছিলাম অশনি সংকেত ও রণ। সমুদয় পাল্টানো এই উপত্যকায়, নিজেকে ভুল প্রমাণ করে তবু বিশ্বাস করতে চাই আলো আসবেই।’ ফেসবুক পোস্টের শেষে ভালোবাসার একটি ইমোজিও জুড়ে দেন তিনি। সোহানা সাবার এই স্ট্যাটাসে অধিকাংশ নেটিজেন হাসির প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কমেন্টে বিরূপ মন্তব্য করতে থাকেন। এরপর কমেন্ট অপশন বন্ধ করে দেওয়া হয়।

আরও গোপন গ্রুপ আছে

অভিনেত্রী মনিরা মিঠুর দাবি, আলো আসবেই গ্রুপের মতো আরও একটি গোপন গ্রুপ আছে। নিজের ফেসবুকে পোস্ট করে এ কথা জানান মিঠু। তবে পোস্টটি করার কিছুক্ষণ পর তার ফেসবুকে সেটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। মনিরা মিঠু নিজে থেকেই মুছে দিয়েছেন কি না এমন প্রশ্ন যখন উঁকি দিচ্ছে মনে তখন গণমাধ্যমকে অভিনেত্রী জানান, পোস্টটি তিনি মুছে দেননি এবং নিজেও বুঝতে পারছেন না তার পোস্ট বারবার ডিলিট হওয়ার কারণ কি! এরপর এ বিষয়ে ফেসবুকে একটি পোস্টও করেন মনিরা মিঠু।

শেষকথা

শিল্পীরা তাদের অভিনয় দিয়ে জায়গা করে নেন মানুষের হৃদয়ে। দল, মত নির্বিশেষে সবকিছুর উপরেই তাদের দেখতে চান দর্শক। ভক্তরা কখনো তাদের প্রিয়শিল্পীকে কোনো হত্যাকারীর দোসর হিসেবে দেখতে চান না। বোধ উদয় হোক প্রতিটি মানুষের। সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলার জন্য কোনো দল করা লাগে না। সত্যের জয় হোক।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

17 − 17 =