অদিতি মহসিন: কণ্ঠে যার রবির আলো

অলকানন্দা মালা

আজকাল রবি ঠাকুরের গান করেন অনেকেই। কিন্তু শ্রোতাদের সুরে সুরে রবির আলোয় আলোকিত করতে পারেন এরকম আছেন হাতে গোনা। তাদের একজন অদিতি মহসিন। যার কণ্ঠে রবি ঠাকুরের গান দুই বাংলাকে বুঁদ করে রাখে। শাড়ি চুড়ি টিপে অদিতি মহসিনের ছিমছাম সৌন্দর্য রবি ঠাকুরের বাণীর সঙ্গে মিলেমিশে যেন আসর জুড়ে এক মায়ার ইন্দ্রজাল তৈরি করে। তার কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে মুগ্ধ হন শ্রোতা।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা

অদিতি মহসিনের জন্ম ঢাকায়। মা হোসনে আরা খান আর বাবা নূর মহসিন খান। চার ভাই বোন। তিন ভাইয়ের এক বোন তিনি। তার বেড়ে ওঠাও এই রাজধানীর আলো বাতাসে। পড়ালেখা করেছেন শহীদ আনোয়ার হোসেন গার্লস স্কুলে। সেখান থেকে মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হন হলিক্রস কলেজে।

সঙ্গীতের সঙ্গে সখ্যতা

অদিতি মহসিনের সঙ্গীতের সঙ্গে সখ্যতার গল্পটা অন্যদের চেয়ে আলাদা। যে সঙ্গীত তাকে দেশ ও দেশের বাইরে এনে দিয়েছে একজন গুণী শিল্পীর সম্মান, এক সময় সে সঙ্গীত নিয়ে কোনো স্বপ্ন ছিল না তার। ছিল না কোনো ভালোবাসা বা টান। মায়ের জোরাজুরিতে গান শুরু করেন তিনি। অদিতি মহসিন তখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। অবসরে গুনগুন করতেন। তা শুনেই মা একদিন নিয়ে যান বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে। ভর্তি করে দেন গান শেখাতে। তবে বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না অদিতির। বরং স্কুলে পড়ার পাশাপাশি বাফাতে যাওয়া আসায় বিরক্ত ছিলেন তিনি। এ কারণে মাঝে মাঝেই ফাঁকি দিতেন। এভাবেই রাজ্যের অনাগ্রহ নিয়ে সঙ্গীতের সঙ্গে বেড়ে ওঠেন অদিতি মহসিন। বাফা থেকে সঙ্গীতে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন অদিতি। এরপর সাদী মোহাম্মদের কাছে নেন সঙ্গীতের তালিম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শান্তি নিকেতন

উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে অদিতি মহসিন ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখনও জবরদস্তি করেই সঙ্গীত সঙ্গে আছে তার। কে জানত বিন্দুমাত্র আগ্রহ না থাকা এই সঙ্গীতই আজীবনের সঙ্গী হয়ে যাবে তার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু মাস তিনেক পরই বৃত্তি পান শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বুঝতে পারছিলেন এ সুযোগ সবাই পায় না। তবুও দ্বিধা কাটছিল না। অদিতি মহসিনকে গানের সঙ্গে মা যুক্ত করলেও শান্তিনিকেতনে যাবার বেলায় ভূমিকাটা ছিল তার বাবার। সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হয়েছেন। সুযোগ পেয়েছেন ইংরেজি বিভাগে। শুধু গান শিখতে এমন সুযোগ ছেড়ে দেবেন। বিষয়টা নিয়ে দোটানায় ছিলেন অদিতি। এরসঙ্গে যোগ হয়েছিল আত্মীয় পরিজনদের কথাবার্তা। নিষেধের দলে ছিলেন অনেকেই। ফলে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন তিনি। এমন সময় বাবা পাশে দাঁড়ান তার। বলেন প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে বের হয়। কিন্তু তাদের সবাই কিন্তু বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায় না। বাবার ওই এক কথায় অদিতি বুঝতে পারেন তার করণীয়। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ছেড়ে রওনা দেন রবি ঠাকুরের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে।

সঙ্গীতের প্রতি প্রেম

শান্তিনিকেতনের পরিবেশ প্রকৃতিতে ঘেরা। সবুজে আচ্ছাদিত। এমন পরিবেশে বেরসিকও রসিক হয়ে ওঠে। দুর্দান্ত রকম হিসেবি মানুষও এলোমেলো হয়ে যায়। অদিতি মহসিনও হন এলোমেলো। প্রকৃতির সুরের সান্নিধ্যে এসে প্রেমে পড়ে যান সঙ্গীতের। ঠিক এভাবেই গানের প্রতি ভালোবাসা জন্মে তার।

শান্তিনিকেতনের সাত বছর

শান্তিনিকেতনের সাতটি বছর অন্যরকম ছিল অদিতি মহসিনের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় পড়ছেন এটি ছিল সবচেয়ে তৃপ্তির। তবে সেখানের যে জিনিসটি তাকে সবচেয়ে বেশি টানত তা হচ্ছে প্রকৃতি। ছয়টি ঋতু খুব স্পষ্ট বোঝা যেত সেখানে। গরমে থাকত ভীষণ গরম, বর্ষায় জল আর বৃষ্টি। শরতে কাশফুল। বাকি ঋতুগুলোও নিজেদের মতো করে বিকশিত হতো। পাশাপাশি শান্তিনিকেতনের আকাশ বাতাস ফুল দারুণভাবে সঙ্গ দিয়েছে তাকে। শান্তিনিকেতন অদিতি মহসিনকে একজন পরিপূর্ণ গায়িকা হিসেবে গড়ে তুলেছিল। সেখানে পড়ার পাশাপাশি স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের কাছে আলাদা করে নিয়েছেন সঙ্গীতের পাঠ। এছাড়া সেখানে গিয়ে তিনি কণিকা বন্দোপাধ্যায় ও নীলিমা সেনদের মতো সঙ্গীতজ্ঞদের থেকে সঙ্গীতের পাঠ নেওয়ার সুযোগ পান। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অদিতি ব্যাচেলর অব মিউজিক এবং মাস্টার অব মিউজিক উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। শান্তিনিকেতন নিয়ে অদিতি মহসিন বলেন, ‘বড় বড় মানুষদের সেখানে দেখতাম সাদামাটা জীবন যাপন করছেন। আমার সঙ্গীত গুরু কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে নীলিমা সেন, মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়, অরূপ রতন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মানুষদের সান্নিধ্য ও শিক্ষার প্রভাব আমার জীবনজুড়ে।’

ফেরা

২০০০ সালে দেশে ফেরেন অদিতি মহসিন। সঙ্গীতে পথ চলাটা শুরু হয় তার শিক্ষক হিসেবে। ছায়ানটের সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পাশাপাশি টেলিভিশন ও রেডিওতেও কাজ শুরু করেন। একইসঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও গাইতে থাকেন। অদিতি মহসিনের মতে ওই সময়টা আজকালের মতো ছিল না। একজন শিল্পী হতে কাঠখড় পোড়াতে হতো। এখন ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের যুগে একটি গান দিয়েই বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু সে সময় এমনটা ছিল না। একটি নির্দিষ্ট ধাপ পেরিয়েই শিল্পীকে শিল্পী হতে হতো।

আনুষ্ঠানিকভাবে পথচলা

অদিতি মহসিন আনুষ্ঠানিকভাবে গায়িকা হিসেবে পথ চলা শুরু করেন  ২০০৩ সালে। সে বছর বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশ পায় তার গানের সিডি। ‘আমার মন চেয়ে রই’ শিরোনামের সিডি বেশ প্রশংসিত হয়। এরপর তিনি বাজারে আনেন ‘শারদ প্রাতে’ নামের একটি অ্যালবাম। এটি মুক্তি পেয়েছিল কলকাতার প্রাইম মিউজিক থেকে ২০০৪ সালে। অদিতি মহসিনের কাজগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর নির্মিত একটি তথ্য চিত্রে গান করা। ড. নওয়াজেশ আহমেদের ফটোগ্রাফের ওপর নির্মিত এই তথ্যচিত্রে ছিন্নপত্র শিরোনামের গানটি গিয়েছিলেন তিনি। কণ্ঠ দিয়ে কাঁটাতারের সীমানা ভেঙেছেন অদিতি মহসিন। দুই বাংলার মানুষই তার কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে ভীষণ পছন্দ করেন। দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নিয়মিত রবি ঠাকুরের গান শোনান এই গায়িকা। দেশের বাইরেও সরব বিচরণ তার। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন, ইন্দোনেশিয়া এবং ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য প্রবাসী বাংলাভাষী বসবাসরত দেশে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়েছেন তিনি।

অর্জন

গান গেয়ে সঙ্গীতপ্রেমীদের শুধু ভালোবাসাই অর্জন করেননি অদিতি মহসিন। পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা। শান্তিনিকেতন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সঙ্গীতে ব্যাচেলরে প্রথম স্থান অর্জনের জন্য দেবব্রত স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছেন। এছাড়া ২০০৪ সালে সঙ্গীতের জন্য অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার (অনন্য ১০ জন শীর্ষ গায়িকা বাংলাদেশ)। এছাড়াও সেরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকা হিসেবে ২০০৬ সালে সিটিসেল চ্যানেল-আই সঙ্গীত পুরস্কার পান অদিতি মহসিন।

যা কিছু প্রিয়

অদিতির পছন্দের পোশাক শাড়ি। এ তালিকায় সবার ওপর রয়েছে জামদানি। পাশাপাশি তসর ও গাদোয়ালও পছন্দ তার। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শাড়ি পরেন তিনি। সঙ্গে মিলিয়ে পরেন পছন্দের গয়না ব্লাউজ। ঢাকার পাশাপাশি কলকাতা থেকেও শাড়ি সংগ্রহ করেন তিনি। এর বাইরে ব্যাগের প্রতি দুর্বলতা রয়েছে এই গায়িকার। তবে তা যে নামিদামি কোম্পানির হতে হবে এরকম না। যা চোখে ধরে, যে ব্যাগ নিজের সঙ্গে মানানসই মনে হয় সেটি সংগ্রহ করেন তিনি। তার ভাষায়, ‘আমি আসলে গুরুত্ব দিই আমাকে কিসে মানাবে। এ কারণে পছন্দসই কিছু পেলেই কিনে ফেলি।’

ডুবে থাকেন প্রকৃতিতে

প্রকৃতিপ্রেমী অদিতি মহসিন খাবারদাবারের ক্ষেত্রেও খাঁটি বাঙালি। ভালোবাসেন ভাত মাছ ডাল। বাইরের খাবারের চেয়ে ঘরের খাবারের প্রতি দুর্বলতাটা বেশি। ঘোরার ক্ষেত্রেও আহামরি ইচ্ছে নেই। নেই বিশেষ নির্দিষ্ট কোনো জায়গা। গাছ পাখি ও প্রকৃতির মাঝে চলতে পছন্দ করেন।

সঙ্গীতের বাইরে

সঙ্গীত প্রতিভার পাশাপাশি আরও একটি প্রতিভা রয়েছে অদিতি মহসিনের। সেটি হচ্ছে উপস্থাপনা। বেশ কয়েকবার টেলিভিশনে উপস্থাপনা করতে দেখা গেছে তাকে। গতবছর একটি বেসরকারি টেলিভিশনে ‘পরম্পরা’ নামের একটি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেছেন তিনি।

লেখাটির পিডিএফে দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সূরের মূর্চ্ছনা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

four + eight =