গানে গানে যুদ্ধ থামাও পিট সিগার

উপল বড়ুয়া

চারদিকে আজ এত যুদ্ধ, এই সময় সময় একজন পিট সিগার থাকলে ভালো হতো। ব্যাঞ্জো বাজিয়ে যুদ্ধবাজদের প্রশ্ন করতেন, ‘যিবৎব যধাব ধষষ ঃযব ুড়ঁহম সবহ মড়হব/ষড়হম ঃরসব ঢ়ধংংরহম/যিবৎব যধাব ধষষ ঃযব ুড়ঁহম সবহ মড়হব/ষড়হম ঃরসব ধমড়’।

২০ নভেম্বরের ১৯৯৬। কলকাতার কলামন্দিরে পিট সিগার ‘যিবৎব যধাব ধষষ ঃযব ভষড়বিৎং মড়হব’ গাওয়া শেষ করতেই গিটার বাজিয়ে একই সুরে গাইতে শুরু করলেন, ‘সারি সারি অনেক কবর/সারি সারি অনেক কবর/বিফল মাটিতে আছে তাঁদের খবর’। সিগার শুনে আশ্চর্য ও বেজায় খুশি। এমন খুশি তিনি আরেকবার হয়েছিলেন আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অভিষেক অনুষ্ঠানে গাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে।

গান ছিল সিগারের হাতিয়ার। অস্ত্র বলতে কখনো ১২ স্ট্রিংয়ের গিটার বা ৫ স্ট্রিংয়ের ব্যাঞ্জো। হুলিয়া মাথায় দুই যন্ত্র সঙ্গে নিয়ে মস্কো থেকে কিউবা, ভারত; প্রায় ৫০টি দেশে গান গেয়েছেন। যুদ্ধবাজ, শোষক, ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে সিগারের কণ্ঠ আজও প্রতিবাদ হয়ে বাজে। মানুষটা ছিলেন লম্বা ও চিকন। তবে কণ্ঠ ছিল চওড়া। সেই গলায় নতুন জীবন পেয়েছে আমেরিকান ফোক সং। নিউ ইয়র্ক ‘মানসিকতা’ থেকে বেরিয়ে বিশ্ব বাউল হয়ে উঠেছিলেন সিগার।

বাবা চার্লস সিগার ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ ও বাম ঘরানার লোক। এক চাচা ছিলেন কবি। গানের প্রতি ভালোবাসা ও মানুষের প্রতি দরদ, ছোটবেলাতেই তৈরি হয়েছিল পিট সিগারের। ১৬ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে এক লোকজ মেলায় ঘুরতে গিয়ে ব্যাঞ্জো নামক যন্ত্রটির প্রেমে পড়েছিলেন। ২০১৪ সালে ৯৪ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত সেই প্রেম ছিল অটুট। পঞ্চাশের দশকে বিশ্বসঙ্গীতে পিটার আর ব্যাঞ্জো হয়ে উঠেছিল সমার্থক। ব্যাঞ্জো আর গিটারের যুগলে পুঁজিবাদী আমেরিকার নাকের ডগায় বসে গেয়েছেন ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী গান, ‘ধিরংঃ ফববঢ় রহ ঃযব নরম সঁফফু’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সিগার ছিলেন ছিলেন আমেরিকান সৈনিক। সেই সময়কার স্মৃতি নিয়ে এই গানের কথা। মিশনে যাওয়ার সময় কীভাবে সেনা কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে ভেড়ার পালের মতো ব্যবহার করতেন, সেটি নিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়েছে এই গানে। ১৯৬৪ সালে আমেরিকার ৩৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে লিন্ডন বি জনসন নির্বাচিত হওয়ার পর ভিয়েতনাম যুদ্ধ তীব্র হয়ে উঠে। এ সময় জনসনের সমালোচনা করে গানটি লেখেন সিগার। লিরিকটির মাঝখানের সামান্য কিছু অংশ ভাষান্তর করলে মন্দ হয় না, ‘আমি কোনো নীতিকথা বলতে চাই না/সেটি তোমার ওপরে দিলাম ছেড়ে/হয়তো তুমি এখনো হাঁটছো, এখনো বলছো কথা/স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে পছন্দ করো তুমি/তবে যখনই পত্রিকা খুলে দেখি/একটা পুরোনো অনুভূতি নড়েচড়ে ওঠে/আমরা, এক কোমর কর্দমাক্ত ডোবায়/এবং এক বড় বেকুব বলছে জোরসে চলো’।

এই ‘বড় বেকুব’ আর কেউ নন, প্রেসিডেন্ট জনসন। সেনাশাসন বিরোধী সিগারের এই গান বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। মতামত তৈরি করেছিল। তার আরেকটি যুদ্ধবিরোধী গান ‘ষধংঃ ঃৎধরহ ঃড় হঁৎবসনবৎম’। ‘নুরেমবার্গ ট্রায়ালের’ কথা আজ কে না জানে! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে রাশিয়া-আমেরিকার মিত্রশক্তি যুদ্ধ ও মানবতারিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য বিচার করেছিল জার্মান নাৎসিদের। লম্বা সময় ধরে চলা সেই বিচারকার্য ও রায়ের স্মৃতি আজও বহন করে আছে নুরেমাবার্গ শহরটি। নাৎসিদের যদি যুদ্ধের জন্য শাস্তি হয় তবে ভিয়েতনাম যুদ্ধের জন্য মার্কিনিদের শাস্তি হবে না কেন? কেন শাস্তি হবে না অস্ত্র নির্মাতাদের? ১৯৬৮ সালের ১৬ মার্চ ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় দক্ষিণ ভিয়েতনামের কুয়াং এনগাই প্রদেশের সন মাই ভিলেজ গ্রামে নিরস্ত্র নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যা করেছিল মার্কিন সৈন্যরা, যা ‘মাই লাই ম্যাসাকার’ নামে পরিচিত। ঘটনাস্থলেই মারা যায় ৩৪৭ জন। সেই সংখ্যা পরে দাঁড়ায় ৫০৪। তাদের অধিকাংশই ছিল নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। নারীদের গণধর্ষণের পর খুন করা হয়েছিল। নুরেমবার্গ ট্রায়ালে যদি নাৎসিদের বিচার হয় তবে এই গণহত্যায় নির্দেশ দাতাদের নয় কেন নয়? ‘ষধংঃ ঃৎধরহ ঃড় হঁৎবসনবৎম’ গানে সেই প্রশ্নই করেছেন সিগার। সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছেন কাদের ইশারায় সৈনিকেরা এমন হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, ‘ফড় র ংবব ষরবঁঃবহধহঃ পধষষবু?/ফড় র ংবব পধঢ়ঃধরহ সবফরহধ? ফড় র ংবব মবহবৎধষ শড়ংঃবৎ ্ ধষষ যরং পৎব?ি/ফড় র ংবব ঢ়ৎবংরফবহঃ হরীড়হ? ফড় র ংবব ঃযব াড়ঃবৎং, সব ্ ুড়ঁ?’

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম কেলি, ক্যাপ্টেন আর্নেস্ট মেডিনা, জেনারেল স্যামুয়েল ডব্লু. কস্টার-গণহত্যায় জড়িত থাকার কারণে তাদের শাস্তি হয়েছিল (পরে খালাস পান মেডিনা)। কিন্তু  প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের? বন্দুকের নলের মতো সিগার অভিযোগের আঙুলটা তাক্ রেখেছেন তাদের জন্য। ভিয়েতনাম গণহত্যায় নিজেকে দাবি করে তিনি এরপরই যেসব প্রশ্ন করেছেন, ‘যিড় যবষফ ঃযব ৎরভষব? যিড় মধাব ঃযব ড়ৎফবৎং? যিড় ঢ়ষধহহবফ ঃযব পধসঢ়ধরমহ ঃড় ষধু ধিংঃব ঃযব ষধহফ? যিড় সধহঁভধপঃঁৎবফ ঃযব নঁষষবঃ? যিড় ঢ়ধরফ ঃযব ঃধীবং? ঃবষষ সব, রং ঃযধঃ নষড়ড়ফ ঁঢ়ড়হ সু যধহফং?’

এ নয় যে, যুদ্ধবিরোধী গান গেয়ে সহজে পার পেয়েছেন সিগার। এফবিআইয়ের টার্গেটে ছিলেন তিনি। লম্বা সময় নিষিদ্ধ ছিলেন রেডিও ও টেলিভিশনে। কিন্তু গান থামাননি। আফ্রিকা থেকে এশিয়া, কৃষ্ণাঙ্গ হোক বা অনাহারী; ব্যাঞ্জো হাতে দাঁড়িয়ে গেছেন সিগার। মুঠো ভরা খাদ্যের মতো তাদের মুখে তুলে দিয়েছেন গান। এমন মানবতাবাদী শিল্পী আজ কোথায় আছে? নেই বলেই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া যুদ্ধে সিগারকে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আজকের দিনে। যিনি আমাদের কাছে এসে বলবেন, ‘যিরপয ংরফব ধৎব ুড়ঁ ড়হ?’

গানটির ইতিহাস বড়ই করুন। শত শত বছর ধরে নিপীড়িত লাখো কয়লা শ্রমিকদের জীবনের গান এটি। ‘রক্তাক্ত হারলান’ নামে পরিচিত কেনটাকির ‘হারলান কাউন্টি ওয়্যার’-এর সময় ব্যাপ্টিস্ট স্তবসঙ্গীত ‘লে দ্য লিলি লো’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘যিরপয ংরফব ধৎব ুড়ঁ ড়হ?’ লেখেন ফ্লোরেন্স রিস, ১৯৩১ সালে। তিনি ছিলেন নারী ইউনিয়ন কর্মী। শ্রমিকদের মজুরি কমানোর প্রতিবাদে চলা যুদ্ধের সময় এই গান লেখেন রিস। যে গানের সঙ্গে পরে ব্র্রিটিশ ব্যালাড ‘জ্যাক মুনরো’র সুরের সাদৃশ্যতা খুঁজে পেয়েছিলেন লোকসাহিত্যিক এ.এল. লয়েড। প্রতিবাদের ভাষা অবশ্য সর্বত্র এক। সিগার আমেরিকার পথে প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে অনেক মণিমুক্তা সংগ্রহ করেছেন। আর সেসবকে নতুন প্রাণও দিয়েছেন। তিনি ‘যিরপয ংরফব ধৎব ুড়ঁ ড়হ?’ গানটি শেখেন ১৯৪০ সালে। একই বছর নিউ ইয়র্কভিত্তিক তার গানের দল ‘অ্যালমানাক সিঙ্গার্স’ শ্রমিক ইউনিয়নের গানটি প্রকাশ করে।

বাবার মতো সিগারও ইউনিয়ন করতেন। লোকসাহিত্যিকের মতো খুঁজে বেড়াতেন আমেরিকার গ্রাম, শহরতলী বা কয়লা-তামাক শ্রমিকদের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গানের কথা ও সুর। তার তেমন আরেকটি গান ‘বি ংযধষষ ড়াবৎপড়সব’। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের (১৯৫৫-৬৮) সঙ্গে জড়িত গসপেল সঙ্গীতটি নিয়ে অনেক অস্পষ্টতা রয়েছে। অনেকে মনে করেন, চার্লস আলবার্ট টিন্ডলের স্তোতসঙ্গীত ‘র’ষষ ড়াবৎপড়সব ংড়সব ফধু’ থেকে নেওয়া হয়েছে এই গানের কথা। পরে গানটি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠে সিগারের কণ্ঠের জাদুতে।

সিগারের ওপর প্রভাব ছিল আমেরিকান ফোক মিউজিকের আরেকজন পুরোধা সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব উডি গুথরির (১৯১২-৮৭)। আরও তিন সঙ্গীকে নিয়ে গানের দল ‘দ্য ওয়েভার্স’ গঠনের আগে অ্যালমানাক সিঙ্গার্সের হয়ে গুথরির ‘ঃযরং ষধহফ রং ুড়ঁৎ ষধহফ’ গেয়ে নবভাবে জনপ্রিয় করে তোলেন সিগার। এ সময় তিনি লেখেন তার বিখ্যাত দুই গান, ‘রভ র যধফ ধ যধসসবৎ’ ও ‘ঃঁৎহ! ঃঁৎহ! ঃঁৎহ!’

অ্যালমানাক সিঙ্গার্সের হয়ে ১৯৪০ সালে শ্রমিকদের নিয়ে অনেক গান করেছেন সিগার। শ্রমিক-দরদী এই গায়ক টেরি গ্রস নামের একজনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিনে, ‘যখন আপনি কাজে যান, তুমি জানোয়ারের মতো কাজ করো। কিন্তু সপ্তাহ শেষে তোমার কাজের মান একইরকম থাকে না। যখন পারিশ্রমিক নেওয়ার দিন আসে, তখন আপনার হাতে পয়সা জুটে না।’

পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকদের এই দৃশ্য তো চিরন্তন। তবে শ্রমিকেরা পয়সা না পেলেও এই ভেবে একটু আনন্দিত হতে পারেন যে, তাদের পাশে একজন পিট সিগার সবসময় ছিলেন। যিনি যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংহতি জানিয়ে রেখেছেন সবসময়ের জন্য, ‘ংড়ষরফধৎরঃু ভড়ৎবাবৎ/ ংড়ষরফধৎরঃু ভড়ৎবাবৎ/ংড়ষরফধৎরঃু ভড়ৎবাবৎ/ভড়ৎ ঃযব ঁহরড়হ সধশবং ঁং ংঃৎড়হম।’

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: গানে গানে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

6 − 2 =