স্বাধীনতার ৫০ বছর রাজনীতির ভেতরে-বাইরে

লায়েকুজ্জামান : স্টপ ফায়ার। এভাবে গুলি ছুড়ছো কেনো? আমি তো এখানেই। মুজিবের হুংকারে পাকিস্তানী সেনাদের গুলি বন্ধ হয়ে গেল। প্রিয় পাইপটা হাতে তিনি নীচে নেমে এলেন। আবার চিৎকার করে উঠলেন, হাউ ডিয়ার ইউ, হোয়াই ইউ হিট হিম, আই ওয়ান্ট হিম অ্যালাইভ’। ততক্ষণে হাজী গোলাম মোর্শেদের রক্তাক্ত দেহ ট্রাকে তোলা হচ্ছে। ২৫ মার্চ। ১৯৭১ সাল। মধ্যরাতের খানিকটা পর। শেরাটন হোটেলের নেওয়াজীর গণসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তাদের ওয়ারলেসে শুনতে পেলেন, ইথারে শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা বিভিন্ন জায়গায় দেওয়া হচ্ছে। আরো কিছু সময় পর তিনি আরেকটি কথা শুনতে পান। পাখি এখন খাঁচায় বন্দি। তিনি ধারণা করলেন। এই পাখিটাই হচ্ছে শেখ মুজিব। ২৫ মার্চের সে রাতে ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধু, বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, বাড়ির কাজের লোক রমা, বুড়িমা বাদেও আরেকজন ছিলেন। তিনি হাজী গোলাম মোর্শেদ। আওয়ামী লীগের কোন পদ-পদবীতে না থাকলেও তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু ভক্ত। যশোরের এই বঙ্গবন্ধু ভক্ত হাজী মোর্শেদের গাড়ীতেই বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছিলেন, বিকল্প পথ ব্যবহার করে। গাড়ীর চালকও ছিলেন হাজী মোর্শেদ।
সে রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে হাজী মোর্শেদ লেখককে বলেছেন, বত্রিশ নম্বরের পশ্চিম পাশের বাড়ি ‘দারায়ে খাস’-এর দোতলায় শুয়ে ঘটনা অবলোকন ও উচ্চঃস্বরে বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো শুনেন এ কে এম মোশাররফ হোসেন। আমার রক্তাক্ত দেহ তখন ট্রাকে তোলা হচ্ছিলো। (মোশাররফ হোসেন পরবর্তীকালে ক্যামিকাল কর্পোরেশনের চেয়ারমম্যান এবং মন্ত্রী) স্বাধীনতার পর তিনি আমাকে ওই অবস্থার বর্ণনা করেন। এর আগে মিসেস সিরাজুল হক (বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মা) সুবোধ চন্দ্র এমপিএ ও ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ ফোন করে বঙ্গবন্ধুকে পালানোর পরামর্শ দেন। আমি তাদের পরামর্শ বঙ্গবন্ধুকে জানাই। বঙ্গবন্ধু কোন মন্তব্য করেননি।
প্রতিদিনের মত ২৫ মার্চেও সকাল ৯টায় বত্রিশ নম্বরে পৌঁছাই। একটু পরে ইষ্টবেঙ্গল আনসারের ডাইরেক্টর আবদুল আউয়াল পিএসপি আসেন। দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু তাকে বিআরটিসির চেয়ারম্যান করেন। আমি যখন যশোর মহাকুমা আওয়ামী লীগের সম্পাদক ও যশোর জেলা বোর্ডের যুক্তফ্রন্ট দলের চীফ হুইপ সে সময়ে আবদুল আউয়াল যশোরের এসপি, তখন থেকে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এরপর ওসমানী সাহেব, সিরাজুল আলম খান আসলেন।
আবদুল আউয়াল আমাকে বললেন, প্রতিটি জেলায় আনসারের অস্ত্র আছে, এগুলো পুলিশ লাইনে রিজার্ভ থাকে। অস্ত্রগুলো রিজার্ভ পুলিশের মধ্যে বিতরণ করা যেতে পারে। আমি কথাটা বঙ্গবন্ধুকে জানালে তিনি ওসমানী সাহেবের সঙ্গে আলাপ করতে বললেন। ওসমানী সাহেবকে জানালে তিনি সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে আলাপ করে বিষয়টা হালকা ভাবে নিলেন। আমার কথায় ওসমানী সাহেব কোন প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। ইতিমধ্যে তাজউদ্দীন আহমেদসহ আরো অনেকেই বত্রিশে আসলেন।
দুপুর হয়ে গেল। বাসায় রওনা দেবো খাওয়ার জন্য, ওসমানী সাহেব বললেন, আমি ধানমণ্ডি যাবো একটু লিফট দেন। তাকে নিয়ে ধানমণ্ডির চার কি পাঁচ নম্বরে সড়কে আবদুস সামাদের বাসায় গেলাম। (সামাদ সাহেব একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে চাকুরী করতেন।) তার বাসায় দুপুরে খাওয়া-দাওয়া ও নামাজ আদায় করে আবার বঙ্গবন্ধুর বাসায় এলাম।
নেতারা আসা-যাওয়া করছেন। বিকেল ৪টার দিকে ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম এলেন। আমিরুল ইসলাম বললেন, মোর্শেদ ভাই আপনাকে একটু ঢাকার এসপি ইএ চৌধুরীর কাছে যেতে হবে।’ আমি বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকালাম। বঙ্গবন্ধু সায় দিয়ে বললেন, বলবি আর্মস, এ্যামুনেশন যেগুলো হেডকোয়ার্টারে আছে সেগুলো পুলিশের মাঝে বিতরণ করে দিতে। এর মধ্যে আউয়াল সাহেব এসে পড়েছেন। ইএ চৌধুরী যশোরের এসপি ছিলেন সে সুবাধে আমার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিলো অন্যদিকে তিনি আউয়াল সাহেবের কলিগ ছিলেন। বেইলি রোডে ইএ চৌধুরীর বাসায় গিয়ে খবরটা পৌঁছে দিলাম। তবে পরে জেনেছি তিনি কাজটা করেননি।
ইএ চৌধুরীরর বাসা থেকে আবার বত্রিশে ফিরে এলাম। তখন সাতটা বাজে। ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম বললেন, ভাই যশোরে একটা ফোন করতে হবে। আবার বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকালাম। তিনি বললেন, যশোরের আওয়ামী লীগ নেতা মশিউর রহমানকে ফোন করে বলতে হবে পুলিশ লাইনের অস্ত্র যেন ফোর্সদের মাঝে বিতরণ করে দেয়। ফোন বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে করা যাবে না। আমি ২২ নম্বর কাকরাইলের জুবলী হাউসে আমার বাসায় এসে ফোন করলাম। আমি যখন ফোন করি জানতে পারলাম সেখানে যশোরের আওয়ামী লীগে নেতা রওশন আলী, তবিবুর রহমান সরদারসহ অনেকে আছেন।
বাসায় নামাজ পড়ে ৯টার দিকে রওনা হলাম। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। আগে আজিমপুর গোরস্থানের দিকে যেতে চাইলাম মায়ের কবর জিয়ারত করতে। শাহবাগ মোড়ে গিয়ে দেখি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও এলিফ্যান্ট রোড বন্ধ, ব্যারিকেড দেয়া। শুধু এয়ারপোর্ট রোড খোলা। এয়ারপোর্ট রোড দিয়ে এগিয়ে কলাবাগানের ছোট্ট একটি সড়ক দিয়ে এগোলাম। হঠাৎ গাড়ীর সামনে একটি গাছ পড়লো। দেখি গাছের পাশে কুড়াল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন রাশেদ মোশাররফ। তিনি বললেন, এ পথ দিয়ে যেতে পারবেন না। ৮ নম্বর দিয়ে যান। বত্রিশ নম্বরের ব্রিজ পার হয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসার সামনে এসে দেখি সবকিছু নীরব। বাসার নীচে কেবল একজন দারোগা দাঁড়িয়ে আছেন।
আমি ওপরে উঠে দরজার সামনে দাঁড়ালাম। বঙ্গবন্ধু একটি গেঞ্জি গায়ে বসে আছেন। আমাকে দেখেই বললেন, ‘আমরা স্বাধীন হয়ে গেলাম। দে আয়ার কামিং টু অ্যারেষ্ট মি। আই হ্যাভ ডিসাইড টু স্টে’। ইপিআর এর একজন কর্মকর্তার কাছে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠিয়েই বঙ্গবন্ধু আমাকে কথাটি বললেন।
এখানে একটি ঘটনা বললে বুঝতে পারবেন, আমি কেন সে রাতে বঙ্গবন্ধুকে চলে যেতে বলিনি। ১৯৭০ সালে ঘূর্ণি ঝড়ের কারণে ভোলায় নির্বাচন হয় পরে। নির্বাচনের সময়ে আমি বঙ্গন্ধুর সঙ্গে ছিলাম। সে সময়ে খবর পাই চট্টগ্রামের এমএ আজিজ মারা গেছেন। সি প্লেনে চট্টগ্রামে গেলেন বঙ্গবন্ধু। জানাজা শেষে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরতে বঙ্গবন্ধু প্লেনের টিকিট করার নির্দেশ দিলে আমি তাঁকে বলেছিলাম প্লেনে না গেলে হয় না। জীবনের প্রথম এবং শেষবারের মত বঙ্গবন্ধু আমাকে ধমক দিলেন। পরে বললেন, দ্যাখ তুই সব সময়ে আমার সাথে থাকিস। মনে রাখিস আমি কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে তা থেকে আমাকে টলানোর চেষ্টা করবি না।’ তারপর থেকে নেতার কথা আমি মেনে চলেছি, বলে সে রাতে যখন উনি বললেন, আই হ্যাভ ডিসাইড টু ষ্টে, তখন আমি আর কিছু বলিনি।
আমি দরজার মুখে দাঁড়ানো অবস্থায় উনি বললেন, তুই চলে যা। আমি বললাম না। দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিছু সময় পর দু’জন নীচে এলাম। এরপর আরেফিন নামের একজন এলেন, একই সঙ্গে ছাত্রনেতা তবিবুর রহমান এসে নেতাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, মুজিব ভাই আপনি বাসা ছেড়ে চলে যান। বঙ্গবন্ধু তাকে বললেন, ‘ইফ দে ডোন্ট গেট মি, উইল ম্যাসকার দ্যা পিপল এ্যান্ড ডেসট্রয় দ্যা সিটি।’ তবিবুর রহমান চলে গেলেন। তাজউদ্দীন ভাই এসে কথা বলে চলে গেলেন।
রাত ১টা ১৫ মিনিটের দিকে হঠাৎ চার দিক আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু জানতে চাইলেন কোন দিক থেকে আলো আসছে। আমি একটা দিক দেখিয়ে দিলাম। বত্রিশ নম্বরে তখন শুধু ভাবী, রাসেল, রমা ও বুড়িমা।
আমি তখোন নীচ তলায় ফোনের কাছে এলাম। একটা ফোন রিসিভ করছি। হঠাৎ আওয়াজ পেলাম ‘মাত মারো’ ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেল। মাথার পেছনে আঘাত করলো। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। জ্ঞান ফিরলে দেখি ঘাসের ওপর শুয়ে আছি। পরদিন সকালে আমাকে সিএমএইচে নিয়ে যায়। একজন বাঙ্গালী নার্স আমাকে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। আমার কাপড় রক্তে ভিজে গিয়েছিলো। নার্স আমাকে হাসপাতালের এক সেট কাপড় দেয় পরতে। তিন চার দিন হাসপাতালে থাকার পর নিয়ে যায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে।
সেনানিবাসে ভাষায় বর্ণনাতীত নির্যাতন চালানো হয় আমার ওপর। পেটানো হতো উলঙ্গ করে। হাত-পায়ের নখগুলো উপড়ে ফেলা হয়। সামান্য যা কিছু খাবার দিতো তা রাখার জন্য একটি ছোট্ট সিলভারের বাটি দেয়া হয়েছিলো, যা দেশ স্বাধীনের পর আমি বন্দিখানা থেকে নিয়ে এসেছি। ওই একই বাটিতে মলমূত্র ত্যাগ করতে হতো, আবার ওই একই বাটিতে খাবার খেতে হতো। এভাবে নির্যাতনের পর এক পর্যায়ে আমাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two × 4 =