‘অনঙ্গ বউ’-‘গোলাপী এখন ট্রেনে’র ববিতা থাকতে চান মানুষের ভালোবাসায়

অভি মঈনুদ্দীন : ফরিদা আক্তার পপি। চলচ্চিত্রে ববিতা নামে পরিচিত। তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ৭০-র দশকের সেরা অভিনেত্রী। অভিনয় ছাড়াও তিনি একজন প্রযোজক। সত্যজিৎ রায়ের অশনি সংকেত চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে প্রশংসিত হন ববিতা। সিনেমাটি ২৩তম বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন বীয়ার জয় করে।
ববিতার চলচ্চিত্র কর্মজীবনের টার্নিং পয়েন্ট ১৯৭৩ সালে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি অসমাপ্ত উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অশনি সংকেত’। এতে অনঙ্গ বৌ চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হন। অশনি সংকেতে অভিয়েনের জন্য ববিতা ভারতে বাংলা চলচ্চিত্র প্রসার সমিতি পুরস্কার এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি বিশেষ পুরস্কার লাভ করেন।
তেতালিশের মনন্তর এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ বাংলার আর্থ-সামাজিক পটপরিবর্তন ছিলো এই চলচ্চিত্রের মূল উপজীব্য। চলচ্চিত্রের প্রাক্কালে সত্যজিত রায়ের নির্দেশে ভারতীয় চিত্রগ্রাহক নিমাই ঘোষ স্বাধীনতার পর ঢাকায় এফডিসিতে আসেন এবং সেখানে ববিতার প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ ছবি তুলেন। এর কিছুদিন পর তাকে প্রাথমিক নির্বাচনের সুখবর বহন করে ববিতার বাসায় ভারতীয় হাইকমিশন থেকে একটি চিঠি আসে। এর ধারাবাহিকতায় ববিতা বড় বোন সুচন্দা সাথে কোলকাতায় যান সত্যজিৎ রায়ের সাথে দেখা করতে। নানান পরীক্ষা নিরীক্ষার পর সত্যজিৎ রায় বলেন “আমি অনেক খুশি, ‘অনঙ্গ বউ’ পেয়ে গেছি।”
৩৫০ এর বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন ববিতা। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তনের পর তিনি টানা তিনবার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জেতেন। এছাড়া ১৯৭৬, ১৯৭৭, ১৯৮৫ সালে আবারো শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী পুরষ্কার পান। এছাড়াও ১৯৯৬ সালে শ্রেষ্ঠ প্রযোজক, ২০০২ ও ২০১১ সালে পার্শ্ব চরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী। এছাড়া ২০১৬ সালে তাকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়।
ববিতার চলচ্চিত্রে আসার পেছনে ছিল বড়বোন সুচন্দার অনুপ্রেরণা। সুচন্দা অভিনীত জহির রায়হানের সংসার চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পী হিসেবে ববিতার আত্নপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৮ সালে। এতে রাজ্জাক-সুচন্দার মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন ববিতা। যদিও ছবিটি মুক্তি পায়নি। চলচ্চিত্র জগতে তার প্রথম নাম ছিলো ‘সুবর্ণা’। তিনি কলম নামের একটি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেন। জহির রায়হানের ‘জ্বালতে সুরাজ কী নিচে’ চলচ্চিত্রে অভিনয়কালে তার নাম হয়ে যায় ‘ববিতা’। ১৯৬৯ সালে ‘শেষ পর্যন্ত’ চলচ্চিত্রে প্রথম নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেন। জহির রায়হানের হাত ধরে চলতে শুরু করলেও তিনি নিজগুণে পথ করে নিয়েছেন। ‘টাকা আনা পাই’ ছিল ববিতার জন্য টার্নিং পয়েন্ট। এরপর বতিতা অভিনীত নজরুল ইসলামের ‘স্বরলিপি’ ছিল সুপারহিট।
মাটি ও মানুষের কাছে যাওয়ার প্রত্যয়ে বিততা ছিলেন দৃঢ়। তাই সিনেমাপ্রেমীদের হৃদয়ের রানী য়ওয়ার পথ ধরে আজও তিনি জনপ্রিয়তা শীর্ষে। একে একে মুক্তি পেলো এহতেশাম পরিচালিত ‘পিচ ঢালা পথ’, বাবুল চৌধুরীর ‘টাকা আনা পাই’, মোস্তফা মেহমুদের ‘মানুষের মন’, সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’ মিতার ‘আলোর মিছিল’সহ আরো বেশ কিছু ছবি। মিতার ‘আলোর মিছিল’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ১৯৭৫ সালে ববিতা প্রথমবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। পরপর তিনি মোহসীনের ‘বাদী থেকে বেগম’ এবং আমজাদ হোসেনের ‘নয়ন মনি’ ছবিতে অভিনয়ের জন্যও একই সম্মাননায় ভূষিত হন।
চল্লিশ বছরের অধিক সময়ের চলচ্চিত্র জীবনে তিনি অভিনয় করেছেন নায়ক রাজরাজ্জাক, আলমগীর, সোহেল রানা, ফারুক, উজ্জ্বল, জাভেদ, জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চনসহ আরো বেশ কয়েকজন নায়কের বিপরীতে। সহকর্মীদের কাছে ববিতা সবসময়ই একজন বন্ধু বৎসল মানুষ।
ববিতা পরবর্তী সময়ে ‘পোকা মাকড়ের ঘর বসতি’, ‘রামের সুমতি’ এবং ‘ম্যাডাম ফুলি’সহ আরো বেশ ক’টি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। নায়িকা হিসেবে ববিতা প্রায় দেড় শত ছবিতে অভিনয় করেছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘সুন্দরী’, ‘এক মুঠো ভাত’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘বসুন্ধরা’, ‘সোহাগ’, ‘ফকির মজনুশাহ’, ‘ওয়াদা’, ‘লাঠিয়াল’, ‘কথা দিলাম’, ‘নিশান’, ‘এতিম’, ‘লাইলী মজনু’, ‘দূরদেশ’, ‘মিস লংকা’, ‘ফুলশয্যা’, ‘বীরাঙ্গণা সখিনা’, ‘মিন্টু আমার নাম’, ‘বেহুলা লক্ষিন্দর’।
সর্বশেষ ‘পুত্র এখন পয়সা ওয়ালা’ সিনেমায় আপনাকে দেখা গেলো, এরপর আর দেখা যায়নি, কেন?
নারগিস আক্তারের ‘পুত্র এখন পয়সাওয়ালা’ সিনেমাতেই আমি সর্বশেষ অভিনয় করেছি। এরপর কিন্তু আমি এমন ঘোষণা দেইনি যে সিনেমাতে আর অভিনয় করবো না। আমার কাছে ভালো কোনো চলচ্চিত্রের প্রস্তাব আসেনি। গত বছর একটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের কথা থাকলেও ব্যাটেবলে হইনি। আমি এখন ভালো কাজটিই করতে চাই। আমি শিল্পী, শিল্পীর কোন অবসর নেই, নেই গুডবাই বলার কোন সুযোগ। মনের মতো কাজ পেলে অবশ্য আসবো নতুন সিনেমায়।
বাবা-মায়ের দেয়া নামটি এখন অনেকটাই মুছে গেলেও মাঝে মাঝে কী এর জন্য দুঃখবোধ হয়?
এখন আর তেমন হয় না। কারণ এই নাম নিয়ে কিন্তু আমার বাবা-মায়ের তেমন কোন আপত্তি ছিলো না। তাই সবাই যখন নামটি মেনে নিয়েছিলেন, আমি তাতে মিশে গেছি। নিজেকে ববিতা নামেই চিনেছি। আসলে নাম একজন মানুষের জীবনে তেমন কোনো গুরুপূর্ণ বিষয় নয়। কাজই আসল, যা নামকে স্বরণীয় করে। আমার ক্ষেত্রেও তাই। বতিতা নামের মাঝে আমার প্রতি লাখো মানুষের ভালবাসা মিশে আছে।
চলচ্চিত্রে কাজ করতে এলে পারিবারিকভাবে বাধার সম্মুখীন হতে হয়, এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
আমাদের সময়ের চেয়ে এখন বিষয় বদলেছে। অভিয়নে বিশেষ করে সিনেমায় আসার পক্ষে পরিবারের, সমাজের বাধা এখনো আছে। শিক্ষিত ছেড়ে মেয়েরা অভিনয়ে আসতে শুরু করার পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। আর আমাদের সময়কালে পরিবারের ও সমাজের বাধা পেরিয়ে অভিনয়ে আসাটা ছিল এক বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের পরিবারও ছিল খুব রক্ষণশীল। দাদা দাদী চাননি আমি অভিনয়ে আসি। মার আগ্রহেই আসা সম্ভব হয়েছে। আর সাথে ছিল বড় বোনোর উৎসাহ।
তাহলে একজন ভালো শিল্পী হবার জন্য স্মার্ট শিক্ষিত হওয়া উচিত বলেই আপনি মনে করছেন?
না, শুধু এই দুটো বিশেষ বৈশিষ্ট্যই যে থাকবে তা নয়। একজন শিল্পী হচ্ছেন সমাজের মানুষের আদর্শ। স্মার্ট শিক্ষিত হবার পাশাপাশি তাকে যেমন বিনয়ী হতে হবে ঠিক তেমনি হতে হবে সিনিয়র শিল্পীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কেতবল অর্থ নয়, অনুসরণীয় হওয়ার জন্য কাজ করতে হবে। যাতে তিনি সমাজে অনুসরণীয়, অনুকরণীয় হতে পারে। বিনয়, মেধা ও দক্ষতার সমন্বয় একজন সফল শিল্পর জন্ম দিরতে পারে।
মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আপনার অনুভূতি কী?
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারণেই কিন্তু আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি। তার জš§শতবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন চলছে। করোনার কারণে সরাসরি অংশ নিতে না পারলেও টেলিভিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপভোগ করেছি। সবকিছু বেশ চমৎকার।
আপনার বাকী জীবনের পরিকল্পনার কথা বলুন?
নির্দিষ্ট করে কোনো পরিকল্পনা নেই। যশ-খ্যাতি সবইতো পেলাম। বেঁচে আছি, বেশ ভালো আছি, মহান আল্লাহর দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া। চলচ্চিত্রে অনেক দিন কাজ করছি, আজীবন কাজ করে যেতে চাই। তবে এখন সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করে যেতে চাই। তবে রাজনীতিতে জড়াতে চাই না।
ছবি: গোলাম সাব্বির

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

14 − 2 =