শৈলকন্যা শিলং

মাহমুদ হাফিজ : ডাউকি-শিলং সড়ক ক্রমশ পাহাড় বেয়ে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই আমরা পেরিয়ে যাচ্ছি বিপজ্জনক সব বাঁক। রাস্তা হালে বেশ চওড়া করা হয়েছে, রাস্তার অবস্থাও ভাল। ডানে বা বাঁয়ে কখনো পাহাড় আসছে কখনো গভীর গিরিখাদ। গাড়ির মধ্যে রক্ত হিম করে বাইরে তাকিয়ে আছি সৌন্দর্যভূক উষ্ণতায়। একটু অসাবধানতায় ভবলীলা সাঙ্গ হওয়া মুহূর্তমাত্র। চালক দেরমান সাংমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে স্বাভাবিকভাবেই নিজের কাজটি মানে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ি পথে নিত্য গাড়ি চালিয়ে অভ্যস্থ এখানকার বাঙালি, গারো, খাসি, জৈন্তা চালকরা। পার্বত্য রাস্তায় দ্রুত ছুটে চলার সম্ভাব্য বিপদ আমলে না নিয়ে এ মুহূর্তে মেঘের দিকে মনোনিবেশ করে সৃষ্টির অপার সৌন্দর্য উপভোগই বুদ্ধিমানের কাজ মনে হলো। জীবনের প্রতি পদে পদেই তো কতো রিস্ক!
উঁচু উঁচু পাহাড় ডিঙিয়ে যেতে থাকি। একটার পর একটা। পাহাড় না বলে ক্যাসকেড বলা হয়। পাহাড়ের পর পাহাড়। কখনো পাহাড়ের ভাঁজে, উপত্যকায়, পাহাড়ের শীর্ষ দিয়ে রাস্তাটি চলে গেছে শিলং পর্যন্ত। উঠছি তো, উঠছিই। সমুদ্রসমতল থেকে ছয়হাজার ফুটের বেশি উচ্চতায় শিলংয়ের অবস্থান।
রাস্তায় কখনো কখনো হুশহাশ করে গাড়ি অতিক্রম করে যাচ্ছে। কখনো ঘনজঙ্গল, কখনো হাতে গোণা বসতি। কদাচিৎ দুয়েকজন খাসি উপজাতিকে জঙ্গল জীবনযাত্রায় দেখা যায়। দূরে কাছে সবুজ পাহাড়ের কোলে তুলোর পেঁজার মতো সাদা সাদা মেঘ ভেসে রয়েছে। মেঘকে আমরা নিচে থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে এরকম দেখি, বিমান থেকে আরেক রকম দেখা যায়, ছোঁয়া যায় না। মেঘালয় মেঘের আলয়, মেঘের বাড়ি, সেখানে এর সঙ্গে মিতালি করা যায়। মেঘের ওপর থেকে মেঘ দেখা যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন কৌণিকে। কখনো ছুটে চলা যায় মেঘের সমান্তরালে। জীবন এমন সুন্দর যে কখনো কখনো অপার্থিবতা এনে দেয় এই পার্থিব দুনিয়ায়। আজ তেমনি একদিন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢুকে পড়ি এক অপার সৌন্দর্যের পরাবাস্তব জগতে। যেখানে শুধু মেঘেরই ভেলা, মেঘ হাতছানি দেয় না, রীতিমতো সমস্ত বাহু বাড়িয়ে আলিঙ্গন করতে আসে। গাড়ির জানালা দিয়ে অদূরের পাহাড়ি উপত্যকা বা পাহাড়ের কোলে যে মেঘদলকে ভেসে থাকতে দেখেছি-তা এখন আমাদের ছুঁতে কাছে ছুটে এসেছে। কিংবা বলা যায়, আমরা ছুটতে ছুটতে ঢুকে পড়েছি মেঘদলের ভেতর। আবছা আঁধারের মমতা বেষ্টন করে রেখেছে আমাদের। বাস্তবের মধ্যে পরাবাস্তবতা অনুভব করছি। সে অবস্থাটি চাক্ষুষ দেখে হৃদয় দিয়ে অনুভব করেই কেবল বোঝা যায়, বর্ণনাবহুল রচনা দিয়ে অন্যকে বোঝানো যায় না।
পরাবাস্তবতার মধ্যেই বাস্তবতাটি হলো আমাদের ছুটে চলা। গাড়ির সামনে ভিজিবিলিটি কমে গেছে। তবু দক্ষ চালক সমান গতিতেই মেঘের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। আমাদের ভ্রমণদলে আমরা যারা এ পথে নতুন, তাদের অনেকে জানালা দিয়ে হাত বের করে মেঘ ছুঁয়ে মুখে ঠেকাচ্ছে, কেউ বাইরে হাত দিয়ে মেঘের স্পর্শ নেয়ার চেষ্টা করছে। কারও মোবাইল ক্যামেরায় চলছে ছবি তোলা।
কি আশ্চর্য, মেঘের মায়া কাটিয়ে আমরা যখন বেরিয়ে আসছি মাঝে মাঝে, তখন দেখা দিচ্ছে উঁচু পাহাড়ের সৌন্দর্য। কোথাও ঘন জঙ্গলের বেষ্টনি, কোথায় টিলা-মালভূমি। মুহূর্তেই অদূরে পাহাড়ি উপত্যকায় দেখা মিলছে রৌদ্দকরোজ্জ্বল দিনের। আরেক দিকে কালোমেঘ, বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টি তো, এই রোদ, এই পরিস্কার তো এই আঁধারে ছাওয়া। কখনো সামান্য উষ্ণতা তো পরক্ষণেই শীতলতা। আবহাওয়া ও মেঘ রোদ্রের এই খেলা মনোরম, প্রাণজুড়ানো। ‘মেঘ রোদ্র গরম ঠান্ডার প্রসঙ্গ উঠতেই আমাদের তিন স্থানীয় ভ্রমণসঙ্গীর চটপটেজন বাখিয়ামন বললো, ডাউকি থেকে শিলং আসতে চারটি ঋতু-গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও শীতের সৌন্দর্য-বৈচিত্র্য অনুভব করা যায়। একই দিনে চারঋতুর অনুভব অপূর্ব বটে !
এই অপার সৃষ্টিবৈভবের মধ্যে কদাচিৎ বিচ্যূতিও ঘটেছে সৌন্দর্যের। পাথুরে পাহাড় কেটে পাথর সংগ্রহ করা হয়েছে কোথাও। রাস্তার পাশেই এর দেখা মেলে। সবুজের মধ্যে কাটা পাহাড় সাদা শরীরে লাজুকভঙ্গিতে বিসদৃশ হয়ে দন্ডায়মান। আমরা মনে পড়লো পবিত্র কোরআনের অমর বাণী-‘জাহারাল ফাসাদু ফিল বার্রি ওয়াল বাহরি বিমা কাসাবা আইদিন নাস’- জলে স্থলে যে অনাসৃষ্টি তা মানুষের হাতেরই। ভ্রমণ গাইড কাম হোস্ট স্ট্রিমলেট ডেখার জানালেন, পাথর সংগ্রহ করে বাংলাদেশে রপ্তানি করা হয়। আয়ের এক অপার উৎস এই প্রকৃতি।
গাড়ির ভেতর তখন চলছে বাংলা, ইংরেজি, খাসি ভাষায় নানা আলাপচারিতা। সাইডটকে বাংলা বা খাসি ভাষা ব্যবহার হচ্ছে। স্ট্রিমলেট, বাখিয়ামন, ইভানিশা ও গাড়ি চালক খাসিতে আলাপ করছে। চালক দেরমান সাংমার ভাষা গারো হলেও খাসি ভাষা জানে পুরো দস্তুর। আমি, জলি, ভ্রামণিক কামরুল হাসান, তুসু বলছি বাংলায়। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলা কথা হচ্ছে ইংরেজিতে। চলন্ত গাড়িটি যেন হয়ে উঠেছে বহুভাষাভাষীর এক পাঠশালা। কারণ আমরা ইতোমধ্যে আমাদের মেজবানদের কাছ থেকে শিখতে শুরু করেছি খাসি ভাষার নানা শব্দ। যেমন-‘খুবলেই’ হচ্ছে খাসি ভাষার স্বাগত জানানো বা ধন্যবাদজ্ঞাপনের শব্দ। বাম অর্থ খাওয়া। নাম জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে, কেরতেয়াং ইউ য়া, ইত্যাদি।
অপার সৌন্দর্য উপভোগ, আলাপ-আলোচনার মধ্যই কেটে গেছে ঘণ্টাতিনেক। পাহাড় মেঘ পেরিয়ে এসেছি পড়েছি খাসি, বাঙালি, গারোদের কোলাহলমুখর এক ছোট্ট শৈল শহরে। মেঘের রাজ্য মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ে। করতে চাই দিনকয়েকের শৈলবাস।
দুই.
পরদিন মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ের সকালটি বড় মনোরম হয়ে ধরা দিলো। এখানে সচরাচর মেঘলা দিন থাকে। আজ ঝলমলে রোদের ঝিলিক। তবে ভ্রাম্যমাণ মেঘের ভেলায় তা আবার মাঝে মাঝে ছায়াময় মায়াময় হয়ে ওঠে। সন্ধ্যায় শিলং পৌঁছে এর রাত্রির রূপটা দেখেছি মাত্র। আসল চিত্রটি চোখের সামনে এলো সকালে। সাতসকালে শৈলকন্যা শিলংয়ের রাস্তায় রাস্তায় ইউনিফর্ম পরা স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের কলতান। হেঁটে বা গাড়িতে ছুটেছে শিক্ষালয়ে। অফিসগামীরা ছুটছে ব্যক্তিগত গাড়ি, ট্যাক্সি বা পাবলিক বাসে। পাহাড়ি সরু রাস্তার পাশে, আবাসিক পাড়াগুলোতে দোকানের ছড়াছড়ি। নাক বোঁচা, ছোট চোখের খাসি-গারো নারীরাই সেগুলো চালাচ্ছে। পথে পথে বাঁধভাঙা মানুষের জোয়ার। রাস্তাঘাট ছেলেদের তুলনায় কর্মব্যস্ত লাস্যময়ী মেয়েদের কলহাস্যে মুখর। দেখেই বোঝা যায় মেঘের মেয়ে মেঘালয় কন্যাশাসিত সমাজের আওতাভুক্ত। মাতৃতান্ত্রিক সমাজের ধারায় চলছে এই শহর।
পাহাড়ি উপত্যকার শহরটিতে এশিয়ার বৃহত্তম গল্ফ কোর্স, ক্যান্টনমেন্ট, মন্দির, মসজিদ, গির্জার ছড়াছড়ি। আছে স্টেডিয়াম। সিএম হাউজ, গভর্নর হাউজ, হাইকোর্ট, বিধানসভা, সেক্রেটারিয়েট নানা সরকারি দপ্তর। শিক্ষার জন্য রয়েছে সেন্ট এডমন্ড, সেন্ট অ্যান্থনি, সেন্ট মেরি স্কুল ও কলেজসহ অসংখ্য স্কুল কলেজ। শিক্ষার হার পঁচাত্তর শতাংশ। উচ্চশিক্ষার জন্য রয়েছে নর্থ ইস্টার্ন হিল ইউনিভার্সিটি-নেহুসহ বেশ কয়েকটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও টেকনিক্যাল কলেজ। বিশ্ব পরিব্রাজকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকায় শহরের পাড়ায় পাড়ায় হোটেল-রেস্তোরাঁ। আছে পুলিশ বাজার নামে সিটি সেন্টার। শহরের আনাচে কানাচে বাজার, শপিং মল। পাহাড়ি খাদ, আঁকাবাকা রাস্তা, লেক, গার্ডেন, পাইনগাছের ঘনবন শৈলশহরটিকে দিয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য। এর আকাশে সারাক্ষণ মেঘরোদ্রের লুকোচুরি। কখনো মেঘ, কখনো রোদ্দুর, কখনো ঝুমবৃষ্টি এর জলহাওয়ায়। প্রাকৃতিক জলহাওয়া শহরটিকে প্রকৃতিগত দিক থেকে নাতিশীতোষ্ণ করে রেখেছে। আঁকাবাঁকা রাস্তায় চলতে গিয়ে কখনো ওপর থেকে নিচে শহরের দালানকোঠা দেখা যায়। আবার একই রাস্তা নিচের দিকে নেমে গেলে চোখের তারায় শহরকে দেখা যায় ওপরের পাহাড়ি ঢালে।
মেঘালয় ও শিলংকে স্কটল্যান্ড অব দ্য ইস্ট নামে খাতি দিয়েছে ব্রিটিশরা। এর দৃষ্টিনন্দন উপত্যকা, পাহাড়ি রাস্তা, নয়নাভিরাম মেঘ, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া, অগুণতি জলপ্রপাত, ঘন পাইনবন এসব স্কটিশ হাইল্যান্ডের সঙ্গেই তুল্য। এখানে যে ১৮ হোল গল্ফকোর্স আছে, তাও এডিনবরা সংলগ্ন ডালকিত এর গল্ফকোর্স এর সঙ্গে তুলনা করা যায়। গারো, খাসি, জৈন্তিয়া পাহাড়ে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণে মোট ১১টি জেলা নিয়ে মেঘালয় রাজ্য। ভারতের লোকসভার দুটি আসন শিলং ও তুরা। গারো, খাসি, জৈন্তিয়া জাতিসত্তাপ্রধান মেঘালয়ের আদিবাসীদের বেশিরভাগ খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত। শিলং শহরসহ দুর্গম পাহাড়ি গ্রাম পর্যন্ত চার্চ। হিন্দু, মুসলিম, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন এবং প্রাচীন ধর্মাবলম্বীও রয়েছে। এখানকার জাতিসত্তা খ্রীষ্ট ধর্মের যে শাখাটিতে ধর্মান্তরিত তাকে প্রেসবাইটেরিয়ান্স বলা হয়। যা ব্রিটেন বিশেষ করে স্কটিশ হাইল্যান্ডে অনুসরণ করা হয়।
স্কটল্যান্ড অব দ্য ইস্ট-মেঘালয়ের প্রধান প্রধান শহরের মধ্যে রাজধানী শিলং ছাড়াও আছে নংপোহ, তোরা, উইলিয়ামনগর, রসুবেলপাড়া, নংসতৈন, নংকসেহ, আমপাতি, জোয়াই, বাঘমারা, সোহরা (চেরাপুঞ্জি), ডাউকি।
মেঘালয় উত্তরপূর্ব ভারতের পর্যটন আকর্ষণ কেন্দ্র। সব ঋতুতেই প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে লাখ লাখ পর্যটক শিলং ভিড় করে থাকে। ছুটে যায় মেঘালয়ের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে। এই রাজ্যের সোহরা বা চেরাপুঞ্জি বৃষ্টির বিশ্ব রাজধানী। মেঘালয় নামটির হিন্দী অর্থ মেঘের আলয়। বাংলা ভাষায়ও তাই। রাজ্যের পর্যটনকেন্দ্রগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক জলপ্রপাত, লেক, শেকড় সেতু, পরিচ্ছন্ন গ্রাম, পাথুরে নদী, রোমাঞ্চকর ট্রেক, গ্রান্ড ক্যানিয়ন বা মহাগিরিখাদ, মেঘ-কুয়াশাময় পাহাড়ি ভিউপয়েন্ট এবং দুর্গম আদিবাসী গ্রাম অন্যতম। চেরাপুঞ্জির মেঘদল, বৃষ্টি, সেভেন সিস্টার ফলস, ওয়াই সোডং ফলস, থাংখারাং পার্ক, মাসমাই কেভ, কোহ রামহাহ বা জায়ান্ট রক, বাংলাদেশ ভিউপয়েন্ট, ডাউকির উমগট নদী, মাওলিন্নং ভিলেজ, সোনংপেডেং, উমক্রেন ফলস, বরহিল ফলস, লিভিং রুট ব্রিজ বা জীবন্ত শেকড়সেতু, ওয়াহ রিম্বেন ফলস পর্যটকদের আকর্ষণ করে। শিলংয়ের ওয়ার্ডস লেক, পাশ্ববর্তী নমপোহ’র উমিয়াম লেক, লাবানের গ্রান্ড মদিনা মসজিদ, ব্রুকসাইডের রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত বাংলো, স্মিথ ভিলেজ, লেইটলাম গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, রাসোং ভিলেজ পর্যটকদের টেনে আনে মেঘালয়ে।
আমরা হাঁটতে থাকি মেঘের বাড়ি মেঘালয়ের রাস্তায়। নাকবোঁচা, ক্ষুদ্রচোখের পাহাড়ি কন্যার ঢল দেখি। দোকানপাটেও তাদের আধিপত্য চোখে পড়ে। ঘোমটা টানা পর্দানশীন, সিঁদুরপরা হিন্দুবধূ, টুপিওলা মুসলিম বা পাগিড়ধারি শিখদের দেখে এখানকার ধর্মীয় সম্প্রীতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। গারো, খাসি, জৈন্তিয়া জাতিসত্তার কথা মনে উঠলে যে পাহাড়ি মানুষের চিত্র মনে ভাসে, মেঘালয়ের পাহাড়িরা এর উল্টো। এখানকার পাহাড়ি জাতিসত্তায় শিক্ষিত, আধুনিক ও মার্জিতসম্পন্ন এবং চমৎকার ইংরেজিতে কথা বলে। রাজ্যের সরকারি ভাষাও ইংরেজি। খাসি, গারো ও জৈন্তিয়ারা মাতৃভাষাও ব্যবহার করে। কদাচিৎ শিলংয়ের রাস্তায় পাহাড়ি আদিবাসীর পোশাকে বাঁশের ঝুড়ি পিঠে দুয়েকজন পাহাড়িকে দেখা যায়। তারা হয়তো দুর্গম গ্রাম থেকে রাজধানী শহরে আসা মানুষ। কিন্তু তাদের সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য।
আমাদের ছোট্ট পর্যটকদলটি ছোট পাহাড়ি শহরটির এ গলি ও গলি হাটি আর প্রতিটি কোণ উপভোগ করি। শহরের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া মেঘমালা, বৃষ্টি, মেঘভেঙে ঠিকরে বের হয়ে আসা রোদ্দুর, এর ঠান্ডা বাতাস আমাদের মন প্রশান্ত করে দেয়।
চেরাপুঞ্জি: বৃষ্টির বিশ্ববসতি
শৈলবাসের এক সকালে চেরাপুঞ্জির দিকে রওয়ানা দিই। গাড়ি যতো এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের এক্সাইটমেন্ট ততোই দানা বাঁধছে। কিশোর-যুবাদের কাছে চেরাপুঞ্জি এক নষ্টালজিক গন্তব্য। স্কুলস্তরের ভূগোল বইয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত কোথায় হয়Ñ প্রশ্নে চেরাপুঞ্জির নামটি লিখতে হয়েছে বার বার। কিশোর বয়স থেকে নামটি মনে গেঁথে রয়েছে। অতিবৃষ্টির এই বিশ্ব রাজধানীতে আজ সরজমিন দেখতে যাচ্ছি-ভেবেই গা শিউরে শিউরে ওঠে।
আজ গাড়িতে খাসি মেজবানদের ইভানিশা নেই। নতুন যোগ হয়েছে ডোডো নামে দলনেতা মিসেস ডেখারের বোন। আলাপ-গুঞ্জনে আমরা যতো চেরাপুঞ্জি শব্দ উচ্চারণ করি, তারা সোহরা সোহরা বলে খাসি ভাষায় বাতচিত করে। ধারণা আছে চেরাপুঞ্জি ব্রিটিশদের দেয়া নাম। আদি নাম সোহরা ব্যবহার করতেই খাসিরা বেশি স্বচ্ছন্দ। চেরা বা সোহরারিম ছিল আদি গ্রামটির নাম। এই জনপদ ইস্ট খাসি হিল জেলার সাবডিভিশন। ব্রিটিশরা আসার পর চেরা গ্রামের দক্ষিণে তাদের সদর দপ্তর নির্মাণ করলে তখন থেকে এটি ‘সোহরা’ নামে পরিচিতি পায়। পরে যা চেরাপুঞ্জি নামে অভিহিত হতে থাকে। ব্রিটিশরা ১৮৩২ সালে এখানে আসামের রাজধানীও প্রতিষ্ঠা করেছিল, ১৮৬৬ সালে তা সরিয়ে নেয়া হয় শিলংয়ে। এই সৌন্দর্যময় পাহাড়প্রকৃতির দুরত্ব শিলং থেকে ৫৬ কিলোমিটার।
এসব হিসাব নিকাশের দিকে মনযোগী না হয়ে আমরা এখন মত্ত হতে চাই বৃষ্টিবন্দনায়। কিশোরবয়স থেকে মনে গেঁথে থাকা গন্তব্য দেখে নয়ন জুড়াতে চাই। ভারতীয় বন্ধুরাই সাবধান করে দিয়েছে, যাচ্ছো তো যাও, বৃষ্টি পাবে না। চেরাপুঞ্জিতে এখন বৃষ্টি হয় না। ভাবি, বৃষ্টি যদি না পাই, তাহলে চার পরিব্রাজকের সঙ্গে নেয়া চার রেইনকোট আর তিনটি ছাতার কি দশা হবে! পায়ের জুতো, গায়ের জ্যাকেট সবই বৃষ্টি সহনক্ষম। বিশ্বের আর কোনো ভ্রমণে এমন পূর্বপ্রস্তূতি নিয়েছি কিনা মনে পড়ে না। বৃষ্টিবন্দনায় খোদ মেঘের মধ্যে গাড়িতে বসে মনে মনে ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে, ছায়া দে রে তুই’ গেয়ে চলেছি।
গাড়ি ছুটছে। পূর্বদিনের গাড়িচালক আজ আসেনি, নতুন একজনকে সে চুক্তি করে পাঠিয়েছে। এই চালক কিছুটা বাংলা ভাষা জানে, আলাপীও। সে এটা ওটা দেখিয়ে আমাদের প্রাণিত করতে চাচ্ছে। আমাদের মন পড়ে আছে জানালার অদূরের অপূর্বমনোহর প্রকৃতিতে। শিলং থেকে ডাউকিমুখো যে রাস্তা, সেটি ধরে ছুটে চলেছি। পথে উমতিঙ্গর নামে একটি চমৎকার পাহাড়ি ছড়া বা খাল। খালটিতে পানি বেশি নেই। ভারিবর্ষণের সময় দূর পাহাড় থেকে নুড়ি ও বড় বড় পাথরের চাঁই এসে এর তলদেশে জমা হয়েছে। এই খাল গিয়ে মিশেছে মাফলাঙ ড্যাম থেকে উৎপন্ন উমলি নদীর সঙ্গে। উমতিঙ্গর সেতু পার হয়ে বামের দিকের রাস্তা চলে গেল ডাউকির দিকে। আমরা ছুটে চলি সোজা, মাজরঙের দিকে। মাজরঙ জনবসতিটি পেরিয়ে গেলেই গাড়ি ঢুকে পড়ে চমৎকার যাদুবাস্তবতার এক মেঘদল, পাহাড়ি ক্যাসকেডময় জগতে। আশপাশের দৃশ্যপট দ্রুতই বদলে যেতে থাকে। যেখানে জনবসতি কম, প্রকৃতিরই কর্তৃত্ব। এই অপার সৌন্দর্যের শুরু মাউকদক সেতু থেকেই। সেতু পেরিয়ে কিছুদূর এগোলে কুয়াশাময় মেঘের ভেলার মধ্যে গাড়ি ঢুকে যায়। মেঘ জাপটে ধরে আমাদের। মেঘ কাটিয়ে কাটিয়ে গাড়ি সামনে এগোতে থাকে। গাড়ির মধ্যে আনন্দে হৈ চৈ করতে থাকি সবাই। কেউ গান ধরে, কেউ ছবি তোলে, কেউ মগ্ন আলাপচারিতায়। রাস্তার ডাইনে পাহাড় বামে খাদ, কখনো বামে পাহাড় ডাইনে খাদ। পাহাড়ের গা ঘেঁষে নির্মিত রাস্তা দিয়ে বাঁকের পর বাঁক পেরিয়ে গাড়ি উঠে যাচ্ছে ওপরে। হিসাবমতে, আমাদের ঊর্ধ্বগামী হতে হবে সমুদ্রসমতল থেকে পাঁচ হাজার ফুটের মতো। মাউকদক উপত্যকার মজাটা হচ্ছে, এখানে পাহাড়ের পর পাহাড়। দুইপাহাড়ের মাঝখানে উপত্যকাজুড়ে সাদা মেঘের মেলা খেলা করে বেড়াচ্ছে। পাহাড়ি সবুজ আর সাদা মেঘ তৈরি করছে নয়নজুড়ানো দৃশ্যপট।
আমরা এই স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকি। আরও কয়েকটি পাহাড় পেরিয়ে গেলে কিছু জায়গা চোখে পড়ে যা মালভূমির মতো। রাস্তার পাশে বিভিন্ন হোটেল-রিসোর্টের সাইনবোর্ড। এর কিছু পর ঘন মেঘের মধ্যে ইশারা করে স্ট্রিমলেট ডেখার বলে ওঠেন, ‘ওই যে, কোল মাইনিং এরিয়া। এগুলোর কয়লা সব রপ্তানি হয়ে গেছে। এখন পরিত্যক্ত।’ একসময়ের জ্বালানি সাংবাদিক বলে এনার্জি নিয়ে আমার আগ্রহ এন্তার। দেখি ঘনমেঘের আবছা আধারে টিলা টিলা কিছু একটা দেখা যায়। কিছু ছোটখাটো স্থাপনাও আছে। র?্যাটহোল মাইনিংয়ে মেঘালয়ে পাহাড় খুঁড়ে কয়লা তোলা হয় বলে মাইনিংয়ের বড় কোন স্থাপনা নেই বুঝতে পারি।
বৃষ্টির বিশ্ব বাড়িতেই আছি। জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে মেঘ ছুঁতে পারছি না। কিছূক্ষণ বাইরে হাত রাখলেই হাত ভিজে যাচ্ছে পানিতে, কিন্তু বৃষ্টির দেখা নেই। সামনে চেরাপুঞ্জি টাউনশীপ। আমরা সেদিকে না গিয়ে সোজা এগোতে থাকি। হাতের বামদিকে ইকো পার্ক যাওয়ার রাস্তা পেরিয়ে গেলে সেভেন সিস্টার ফলস। মেঘে ঢাকা বলে সেখানে ছবি তোলার জো নেই। সেখানে না নেমে বাংলাদেশ ভিউপয়েন্ট পেরিয়ে এগিয়ে যেতে থাকি খুব কাছ থেকে বাংলাদেশ দেখতে। গন্তব্য চেরাপুঞ্জি সেন্টার থেকে আট কিলোমিটার দূরে কোহ রামহা পিকনিক স্পট ও থাংখারাং পার্ক।
আটকিলোমিটার রাস্তার তিনকিলোমিটার কাঁচা। কংক্রিটের বদলে পাহাড়ি নুড়ি আর মাটি বালির। কাঁচা রাস্তাটির কোথাও কোথাও এবড়োখেবড়ো। ভারিবর্ষণ হলে তা আর চলার মতো অবস্থা থাকে না, বন্ধ হয়ে যায়। সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছতে এপথ ক্রমশ পাহাড়ি ঢালু হয়ে নিচে নামতে থাকে। সচরাচর ড্রাইভাররা এই স্পটের দিকে ভুলেও যেতে চায় না বলে জানাচ্ছে আমাদের আজকের ড্রাইভার। এমনিতে দূর, রাস্তা কাঁচা, দূর্গম। এরওপর একবার আটকে পড়লে ফিরে আসা দুষ্কর। তাই সেভেন স্টার জলপ্রপাতের কাছে ‘বাংলাদেশ ভিউপয়েন্ট’ নামের একটা জায়গায় নিয়ে বায়োস্কোপওলার মতো ‘ওই যে বাংলাদেশ’ বলে গাড়িচালকরা পর্যটকদের শান্তনা দিয়ে থাকে। আমাদের সঙ্গে খাসি হোস্টগণ, ফাঁকি দেয়ার জো ড্রাইভারের নেই।
যাওয়ার পথে আর কোনো গাড়ি দেখি না। ইতোমধ্যে বেলা গড়িয়ে বিকালের দিকে মোড় নেয়াও আরেকটি কারণ হতে পারে। একপাশে পাহাড়, আরেকপাশে ঘনবন মাঝে মধ্যে পাতলা। চলার পথে মূহুর্তে চোখে ধরা দেয় অদূরের সমতলভূমি। পানিতে ভাসমান সবুজ থোকা থোকা গ্রাম। গুগলে দেখি, সেটা বাংলাদেশের কোম্পানিগঞ্জ।
ভ্রমণসঙ্গী কবি কামরুল হাসান বললেন, প্রাকৃতিকসম্পদওলা পাহাড়ের একটাও আমাদের না, আমাদের শুধুই সমতল?
বললাম, জানেন মরহুম র‌্যাডক্লিফ।
বললেন, সাহেব তো আর নিজহাতে মাপজোঁক করেননি।
চেরাপুঞ্জিকে আমি নাম দিয়েছি বৃষ্টির বিশ্ব বসতি। এখানে বৃষ্টি আকাশ থেকে পড়ে না। যে মেঘ থেকে আমরা বৃষ্টি ঝরতে দেখি, সে মেঘেরা বাস করে। আর মেঘবৃষ্টির পরিমাণ এতো বেশি যে বহু আগে তা বিশ্বরেকর্ড করে বসে আছে। সে হিসেবে আমরা আজ বৃষ্টির বিশ্ব বাড়ির অতিথি। কিন্তু বৃষ্টি কই? ঘনমেঘে চারপাশ ছেয়ে আছে, বৃষ্টির কোন আলামত দেখতে পাচ্ছি না। বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুরা ফেসবুকে আমার চেক ইন আর গুগল মানচিত্রের লোকেশন দেখে ‘ওখানে বৃষ্টি পাবে না, চেরাপুঞ্জিতে এখন বৃষ্টি হয় না’ বলে যে মন্তব্য করেছিল, তাই কি তবে সত্য হতে চলেছে? বাংলাদেশ থেকে আনা রেইনকোট আর ছাতাগুলো টাটা সুমোর পেছনের বুটে পড়ে আছে। গায়ে চড়ানো তো দূরে থাক, এগুলোর মোড়ক পর্যন্ত খোলা হয়নি। অথচ যাওয়ার প্রস্তুতির সময় ভ্রমণসঙ্গী গিন্নী ও কনিষ্ঠপুত্রধনের জিজ্ঞাসার জবাবে বলেছি, ‘রেইনকোট-ছাতার এন্তেজাম করলাম, এবারের ভ্রমণ বৃষ্টিমুখর। বৃষ্টি দেখতেই শিলং যাচ্ছি’।
থাংখারাং পার্কের লুকআউট পয়েন্ট থেকে কিনরেম ফলস দেখে বের হতেই মেঘের ঘনঘটা। বৃষ্টি এলো এলো। বৃষ্টিকে স্বাগত জানাচ্ছি বটে, উদ্বেগও আছে। ভারিবর্ষণ শুরুর আগেই শেলা-সোহরা সড়কের কাঁচা অংশ অতিক্রম করে ওপরের পাহাড়ের দিকে উঠে যেতে হবে। আসার সময় সড়কের কাঁচা অংশের যে অবস্থা দেখেছি, পাহাড়ি ঢলের পর আমরা যে আটকে পড়তে যাচ্ছি, তা প্রায় নিশ্চিত।
পিচঢালা নতুন রাস্তায় এলেই গাড়ি ঊর্ধ্বগামী হতে থাকে। সেভেন সিস্টার্স ফলস্ এর দিকে এগোতে থাকলে গাড়ির মধ্যে তুসুর চিৎকার ‘মেঘ মেঘ, পাহাড়ের নিচে নেমে যাচ্ছে মেঘ’। সবাই তাকিয়ে দেখি, ডানের উপত্যকাজুড়ে মেঘের ভেলা পাহাড়শীর্ষসমূহের নিচের দিকে পরিভ্রমণরত। সবুজ পাহাড়ের কোলে শুভ্র মেঘের এই পরিভ্রমণ চোখ প্রশান্ত করে দেয় আমাদের। চোখের সামনে ইউরোপীয় সৌন্দর্য দেখে গাড়ি থেকে না নেমে আর স্থির থাকতে পারি না। জায়গাটির নাম নেই। আমি গুগলে দেখলাম, কিছুদূরে ‘রিংগুড’ নামে একটা নামের উল্লেখ আছে। সেভেন সিস্টার্স ফলস থেকে জায়গাটি অন্তত তিন কিলোমিটার নিচে।
ডাইনের ভ্যালির দিকে তাকিয়ে দেখি মেঘপাহাড়ের বিরামহীন লুকোচুরি। কখনো পাহাড়ের নিচে নেমে যাচ্ছে মেঘ। কখনো আবার পাহাড়কে চুমু দিয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরে। কোন কোন মেঘের দল একস্থানে ভেসে রয়েছে। কিছু মেঘ উড়ছে একাধিক পাহাড়ের মাঝখানে ঢেউখেলানো ভাঁজে ভাঁজে। এই অভূতপূর্ব দৃশ্য চোখের সাড়ে তিন ইঞ্চি লেন্সে রেকর্ড করে মস্তিষ্কের ডার্করুমে রেখে দিই। এখন লেখাটি আসছে মস্তিষ্কের ডার্করুম থেকে সেই চলচ্ছবি ডেভেলপের মধ্য দিয়ে। মোবাইল ক্যামেরায় কিছু মেঘকে ক্যামেরাবন্দী করতেও আমাদের দলটি ভুল করে না। এই দৃশ্যপটটির মজা হচ্ছে এখান থেকে সেভেন সিস্টার্স ফলসটিও দেখা যায়। তবে সেভেন সিস্টার্স যে চুনাপাথরের পাহাড় থেকে নামছে, জায়গাটি তার নিচে বলে জলপ্রপাতটি ওপরের দিকে দৃষ্টিগোচার হয়।
আমরা পাহাড়ি বাঁক নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেভেন সিস্টার্স বা মাওসমাই জলপ্রপাতের ভিউপয়েন্টে পৌঁছাই। রাস্তার পাশে বড়সড়ো পার্কিং, দোকানপাট। গাড়ি পার্ক করার পর জলপ্রপাত উপভোগ করতে নেমে পড়লাম আমরা। আমরা বলতে, চারজন। জলি, তুসু আমি আর কবি কামরুল হাসান। হোস্টগণ অনেকবার আসায় গাড়িতেই বসে রইলেন। ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। জামাকাপড়ের ওপর যে বৃষ্টিসহনক্ষম জ্যাকেট আছে তা দিয়েই চালানো যাচ্ছে, ছাতা বা রেইনকোট বের করতে হলো না।
আমার গায়ে লাল জ্যাকেট। যাত্রাকালে জলিকে বলেছিলাম, মেঘরাজ্য মেঘালয়ের সব ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড হবে সবুজ। সবুজের ওপর কন্ট্রাস্ট করতে গায়ের পোশাক হতে হবে জুৎসই রঙের, তাতে ছবি ভাল ফুটবে। সে মতে, জামার ওপরে চাপিয়েছি লাল জ্যাকেট। যে লোকেশনে দাঁড়িয়েই পোজ দিই না কেন ছবি হচ্ছে ‘সেইরকম’।
রেলিংঘেরা ভিউপয়েন্টের নিচে পাহাড়ি উপত্যকা। অদূরে পাহাড়ের গা দিয়ে নামছে সাত সাতটি জলপ্রপাতের ধারা। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়, হা হয়ে ক্ষণিক সবকিছু ভুলে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। একহাজার ৩৩ ফুট উচ্চতার সেভেন সিস্টার্স বা মাওসমাই ফলস ভারতের অন্যতম দীর্ঘ জলপ্রপাতের মর্যাদা বহন করছে। জায়গাটি পর্যটকের পদভারের মুখরিত। ওয়াও ওয়াও ধ্বনি, আবাল বৃদ্ধ বণিতার গুঞ্জন, ক্যামেরা, ট্যাব, মোবাইলের ক্লিক ক্লিক। এখন প্রযুক্তির যুগ। মিডিয়া এখন আর সনাতনধারার পত্রিকা, বেতার, টেলিভিশনের মধ্যে সীমিত নেই। সোস্যাল মিডিয়া যুগে পর্যটন কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে কেউ ফেসবুকে লাইভ দিচ্ছে, কেউ ক্যামেরার সঙ্গে সেলফি স্ট্যান্ড লাগিয়ে সেলফি তুলছে, কেউ জলপ্রপাত পেছনে রেখে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বর্ণনা দিয়ে ভিডিও করছে। নিশ্চিত ইউটিউব চ্যানেলে ছাড়া হবে এসব ভিডিও। প্রযুক্তিযুগে পর্যটনস্পটগুলোর চেহারাও গেছে বদলে। তুসু জলপ্রপাতকে পেছনে রেখে সেলফি তুলতে চেষ্টা করছে। আমি একজায়গায় ‘সেলফি ডেঞ্জার জোন’ লেখা সাইনবোর্ড দেখিয়ে তাকে সাবধান করে দিই।
দুপুরে শিলং থেকে বের হওয়ার সময় থেকে এখন পর্যন্ত চা খাইনি। ইতোমধ্যে মধ্যাহ্নারের সময়ও চলে যাচ্ছে। হোস্টগণ বাসা থেকে খাবার দাবার সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। স্ট্রিমলেট ডেখার আগে থেকেই পরিকল্পনা করেছেন, এখানে তাঁর বোনের বাড়িতে বসে সঙ্গে আনা লাঞ্চ করাবেন। চা পানের ব্যবস্থা হবে সেখানেই। আমাদের পেটে ততোক্ষণে ইঁদুর দৌড় শুরু হয়েছে। এই দৌড় ভুলে আছি উদার প্রকৃতি দেখার ঘোরে। খাবার কথা মনে হলে, খাওয়ার কাজটি সারার জন্য সবাই একমত হওয়া গেল। চেরাপুঞ্জি সদরের ডুকান সড়কে ডেখারের বোন ভিক্টোরিয়া কারশিংতোর বাড়ি। মধ্যাহ্নভোজ ও চা পানের বিরতির জন্য গাড়ি সেদিকে ছুটে চললো। আমি আর জলি পেছনের সিটে। জলি ফিস ফিস অনুযোগ করলো ‘তোমার খবর আছে, কতোবার বলেছি মেঘের আবছা আঁধারে আমার ছবি তুলে দিতে, তুমি কানে তুললে না’।
বললামÑ ‘হবে হবে’।
তার সাফ জবাবÑ ‘কই, এখন তো আকাশে মেঘ বৃষ্টি কিছুই নেই। মেঘ পাবা কোথায়?’
দীর্ঘদিন বাচ্চাদের পড়িয়ে পড়িয়ে মনটি নরম মেঘের মতো হয়ে যাওয়া এই ভদ্রমহিলা মেঘ, বৃষ্টি, ফুল, পাখি, কোলের শিশু দেখলে ছবি তুলতে ব্যগ্র। আমার তা জানা থাকলেও যতোটা মনযোগ স্ত্রীরা সাধারণত পেয়ে থাকে, দল বেঁধে ভ্রমণে তা পায় না এবং এই ভ্রমণে সে নিশ্চিতভাবেই বঞ্চিত হচ্ছে। দর্শনীয় স্থানে নেমে সবাই ছবি, সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। কারও প্রতি কারও মনযোগ দেয়ার ফুরসত নেই। কয়েকবার মেঘবৃষ্টির দেখা পাওয়া গেলেও সহধর্মিনী মনের মতো ছবি তুলতে না পারায় আমাকে ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে।
ঘটনা মিরাকলের মতোই। সেভেন সিস্টার্স ভিউপয়েন্ট থেকে যাত্রা শুরুর পরই মেঘবৃষ্টি উধাও। রোদ না উঠলেও চারদিক পরিস্কার। তবে আমি চিন্তিত না। চেরাপুঞ্জিতে প্রথম এলেও জানি এখানে এই রোদ, এই মেঘ, এই বৃষ্টি। দেখা যাবে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই হয়তো মেঘ বৃষ্টির দেখা পাওয়া যাবে। সময়ের ফারাক তিন মিনিট হোক আর তিরিশ মিনিট।
ডুকান রোড চেরাপুঞ্জির একদম কেন্দ্রে। সোহরা-শেলা সড়ক থেকে বাঁয়ে সোহরা-লেইটকিনসো সড়কে ঢুকে দ্বিতীয় গলিটিই ডুকান রোড। গাড়ির ভেতর থেকে স্ট্রিমলেট এর আরেক বোন-আমাদের আজকের সহযাত্রী ‘ডোডো’ নির্দেশনা দিতেই গলির দু’তিনটি বাড়ির পরে সুদৃশ্য একটি বাড়ির সামনে গাড়ি থেমে গেল। ওপরে টিন, নিচে কংক্রিটের দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। সামনে মধ্যবয়স্ক মার্জিত রুচির সুশ্রী এক ভদ্রমহিলা দু’হাত উঁচিয়ে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছে। সবাই নেমে দ্রুত গেট দিয়ে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি ও জলি পেছনের আসন থেকে পরে নামতেই দেখি স্বাগত জানাতে এসেছে মেঘদল। এতোক্ষণ বুঝতে পারিনি। প্রধান সড়ক দিয়ে আসার সময়ও চারদিক পরিস্কার ছিল। আকস্মিক ডুকান রোডে ভিড় করেছে দুনিয়ার সব মেঘ। চারদিক অন্ধকার। ঠান্ডা তুলতুলে মেঘ ও কুয়াশা আমাদের ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে ধীরে। কিংবা আমরাই মেঘের ভেতরে ঢুকে পড়েছি। ভাবলাম, ‘বাঁচা গেল’।
সহসাই বাড়ির ভেতর না ঢুকে ফটোসেশন কিংবা পুরোবস্তুর স্যুটিংয়ে লেগে গেলাম। জলিকে বললাম, গলির মাথায় হেঁটে গিয়ে আমার দিকে আস্তে আস্তে ফিরে আসতে। জলি সেভাবে এলো। আমি বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ক্লিকের পর ক্লিক করে যাচ্ছি। মেঘ ঘন ছিল। দৃশ্যমানতার হেরফেরে অপসৃয়মান মেঘের বহুমাত্রিক ছবি এলো। প্রথম খুব ঝাপসা, তারপর আস্তে আস্তে পরিস্কার ।
ঘনমেঘের আস্তরণের মধ্যে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই কাপড়চোপড় ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে মেঘ। ঠান্ডাও লাগছে বেশ। এই না হলে চেরাপুঞ্জি! ‘আমি আসছি’ বলে জলিকে দ্রুত বাড়ির ভেতরে পাঠালাম।
স্যুটিংয়ে এবার আমার পালা। ভেতরের দিকে আগুয়ান পুত্রধন তুসুকে ডেকে নিলাম। তার প্রযুক্তিজ্ঞান টনটনে। ছবিও তোলে ভাল। আমিও দূরে গলির মুখে গিয়ে আবার ফিরে আসতে লাগলাম। মেঘের ঘনত্ব মাঝে মাঝে কমবেশি হয়। তাই ঘনমেঘে উড়ে আসার আশায় এরকম কয়েকবার করলাম। আমি ঘনমেঘের আবছা আঁধার থেকে হেঁটে ক্রমশ বের হয়ে আসি ক্যামেরার দৃশ্যমানতায়। তুসু ক্লিক করতে থাকে পটাপট। মনে হচ্ছে, হিন্দি সিনেমার কোনো নায়ক গল্পের প্রয়োজনে মেঘের ভেতর থেকে পরিচালকের নির্দেশে ক্যামেরার দিকে এগিয়ে আসছে। টেক ওয়ান, টেক টু, টে থ্রি আওয়াজে চলছে স্যুটিং।
ডুকান রোডটি এসময় বড় নির্জন। কদাচিৎ দুয়েকটি গাড়ি চলে। বিকেলের দিকে বলে হয়তো এই নির্জনতা। গলির মাথায় বসতি ঘন নয়। রাস্তার নির্জনতা পেয়ে ফটো স্যুটিং নির্বিঘ্নেই চললো। ছবি দেখে নিজের গোবেচারা চেহারা নিজেই চিনতে পারছি না। ছবি ফেসবুকে পোস্ট হলে একজন কমেন্টবক্সে লিখলেন ‘হিরো নাম্বার ওয়ান’। লাজুকভঙ্গিতে অস্ফূট ধ্বনি করলাম-যাহ।
গেট পেরিয়ে খোলা বারান্দা। বারান্দার পেছনে ড্রইংরুম। ঢুকে দেখি আধুনিক ও শহুরে পরিবেশ। বেত ও কাঠের ডাবল সোফা সেট। মেঝেতে কাঠস্টাইলের রেক্সিন। দেয়ালগুলো ডিজাইন করা কাঠে মোড়ানো। দেয়ালে বসানো শোকেসের মধ্যে কাঁসাপিতলের আসবাব। খাসি আতিথ্যগ্রহণে এসে শহুরে আধুনিকতা দেখে একরকম হতাশ হতে যাচ্ছি, তখন স্ট্রিমলেট বললেন, এই বাড়ি খাসি ঐতিহ্যের ছোঁয়া রেখেই সাজানো। শো কেসে প্রাচীন খাসিদের ব্যবহার করা কাঁশা পিতলের বাসন, ছাদ বা চাতালের দিকটা শীতলপাটির বুনন, দেয়ালসজ্জিত কাঠের আবরণে। শিলং শহরের খাসি বাড়িগুলোতেও আজকাল এগুলো নেই।
কিছুক্ষণ পর খাওয়ার জন্য ভেতরে ডাক পড়লো। ছোট্ট করিডোর পেরিয়ে ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখি দেয়ালঘেষে চারদিকে চেয়ারপাতা। গৃহকর্তা ডেরিয়াস অটোমেটিক ইলেকট্রিক ওভেনে হাত-পা গরম করছেন। বাইরে থেকে আসায় তার হাত পা ঠান্ডা। জানা গেল, এখানে সংবছরই ঠান্ডা থাকে। আগুনের শেক দিয়ে হাত পা উষ্ণ রাখা বাসিন্দাদের অভ্যেস। পাশের চেয়ারে ডেরিয়াসের স্ত্রী ভিক্টোরিয়া। দু’জনের আয়েশী ভঙ্গির পাশে বসেছেন আমাদের মেজবান দলনেতা স্ট্রিমলেট ডেখার। আমরা আসন নিতে নিতেই পাশের টেবিলে বসে প্লেটে প্লেটে খাবার পরিবেশন শুরু করেছে ভ্রমণসঙ্গী বাখিয়া মুন। প্লেটে ভাত, ডিমসেদ্ধ, বানানা বল ওরফে কলা ভর্তা, আচার, ডাল।
গত কয়েকদিনে পরিচয় পাওয়া গেছে ভ্রমণসঙ্গী বাখিয়া মুনের। বয়সে অনেকটাই নবীন কলেজশিক্ষক মুন সংসারী, করিৎকর্মা ও বন্ধুপ্রিয়। বাড়ি থেকে নিজ হাতে রান্না করে মধ্যাহ্ন খাবার নিয়ে এসেছে। সঙ্গে প্লেট, চামচ আনতেও ভুল করেনি। তার ধারণা ছিল, ঝর্ণা বা পার্কের উন্মুক্ত জায়গায় ভোজন হতে পারে, তাই সব ব্যবস্থা। গাড়ির বুটে কয়েক ব্যাগে এসব রাখা ছিল। বনের বদলে বোনের বাড়িতে খাওয়ার আয়োজন হওয়ায় চালকের সহায়তায় ব্যাগগুলো ভেতরে আনা হয়েছে। ভাবলাম, একে বলে বরাত। পেটে ক্ষুধা আর খাবার দুটিই সঙ্গে করে নিয়ে এতোক্ষণ ঘুরে বেরিয়েছি আমরা, ওপরের নির্দেশ আসেনি বলে উদরপূর্তিরও ফুরসত মেলেনি।
ডাইনিং লাগোয়া রান্না ঘরের বেসিনে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। কবি কামরুল হাসান আগে আগে গিয়ে হাত ধুয়ে নোটবুক বের করেছেন। পাশের উনুনে চা বানানোয় নিয়োজিত লাজুক স্বভাবের তরুণীর নাম জিজ্ঞেস করে টুকে নিচ্ছেন। সে পরিস্কার হিন্দিতে বলছে, মেরা নাম দয়া।
আমি, কবি কামরুল হাসান আর ডেরিয়াস কাছাকাছি চেয়ারে বসেছি। চা পানের সময় স্ট্রিমলেট বললেন, ডেরিয়াস চেরাপুঞ্জির নামকরা টেইলরিং মাস্টার। স্যুট-কম্প্লিট এর স্পেশালিস্ট। চেরাপুঞ্জিতে স্যুট-কোট বলতেই ডেরিয়াস। পোশাক আর মানুষ সিনোনিমাস হয়ে গেছে।
একথা শুনে ভ্রমণদলের কামরুল হাসান নড়েচড়ে বসলেন। ডেরিয়াসের সঙ্গে আগ্রহভরে আলাপ জমালেন। পেশায় এই বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের সিগনেচার ড্রেস স্যুট টাই। এখানে অ্যাডেভেঞ্চার ট্যুরিজমে এসেও নিজের ড্রেসকোড থেকে বিচ্যূত হননি। ভারত বা চেরাপুঞ্জিতে এর দামদর, ফেব্রিক ইত্যাদি নিয়ে নানা প্রশ্ন করে ঝালিয়ে নিচ্ছেন।
খাসি, বাঙালি, শিলং, চেরাপুঞ্জি, বৃষ্টিমুখরতা নানা বিষয় নিয়ে অনেক্ষণ আড্ডা চললো। বিদায়বেলায় গ্রুপ ফটো তোলার পর আবিষ্কৃত হলো ‘দয়া’র চেহারারই আরেক তরুণীর ছবি গ্রুপ ফটোতে। মনে হচ্ছিলো যমজ দু’জন। জিজ্ঞেস করে জানা গেল তার নাম ইভা। দয়া’র ছোট। সেও লেখাপড়া করছে। দুই মেয়ে নিয়ে ডেরিয়াস-ভিক্টোরিয়ার সুখের সংসার।
খাসি আতিথ্যে আমাদের মন ভরে উঠলো। ফিরতিপথে ভাবলাম, চেরাপুঞ্জি এসে দর্শনীয় স্থানকে ব্যাকগ্রাউন্ড করে ছবি তোলে অনেকেই, খাসি আতিথেয়তা ক’জন পায় !

স পথনির্দেশ: ঢাকা থেকে সিলেট। বাস, মাইক্রো বা অটোতে তামাবিল সীমান্ত। সীমান্ত পেরিয়েই মেঘালয়ের ডাউকিবাজার থেকে টাটাসুমোতে বা ছোট গাড়ি রিজার্ভ করে দুইঘণ্টার যাত্রায় শিলং পৌঁছানো যায়। পুলিশবাজার এলাকায় নানাদামের অনেক হোটেল আছে। সরকারি ট্যুরিস্ট বাসে খুব কমখরচে বা গাড়ি রিজার্ভ করে মেঘালয়ের দর্শনীয় স্থান দেখা যায়। বিমানে ঢাকা-কলকাতা-গৌহাটি হয়ে সড়কপথে শিলং। সড়কপথে মেঘালয় যেতে ভিসা নেয়ার সময় ডাউকি সীমান্ত উল্লেখ করতে হয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

1 × two =