পণ্যের বৈচিত্র্য আনয়নের মাধ্যমে রপ্তানি আয় বাড়ানোর আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

ঢাকা,  ১৪ জুলাই, ২০২৪ (বাসস): প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পণ্যের বৈচিত্র্য আনয়নের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য, গালফ, আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন বাজার লক্ষ্য করে রপ্তানি বৃদ্ধি করে আয় বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, “আমরা অল্প কিছু রপ্তানি পণ্যের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না। আমাদের রপ্তানি বাড়াতে হবে। তাই আমাদের রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে।”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে রাজধানীর ওসামানী স্মৃতি মিলনায়তনে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৩২টি ক্যাটাগরিতে ৭৭ রপ্তানিকারকের মাঝে জাতীয় রপ্তানি ট্রফি প্রদান অনুষ্ঠানে দেওয়া প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে বলেন, আমি আপনাদের আর একটি কথা বলবো আসলে যুদ্ধ জড়িয়ে পড়ে ইউরোপীয় দেশগুলো কিংবা আমেরিকাই বলেন, তাদের মূল্যস্কীতি বেশি এবং অর্থনীতি কিন্তু খুব চাপের মুখে। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমাদের কিন্তু নতুন সুযোগ আছে। মিডলইস্ট, গালফ কান্ট্রি, আফ্রিকা, সাউথ এশিয়া, সাউথ ইস্ট এশিয়া, ইস্ট এশিয়ান কান্ট্রিগুলো, ইস্ট ইউরোপীয় কান্ট্রিগুলো এদের সাথে যত বেশি আমরা আমাদের যোগাযোগ রাখতে পারবো, আমাদের রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে পারবো। এই সুযোগটা আমাদের নিতে হবে। এজন্য আমরা ইতোমধ্যে কাজ করছি। মাঝে মাঝে প্রতিনিধিও পাঠাচ্ছি এসব জায়গায়।

তিনি বলেন, আমি আপনাদেরও বলবো এসব দেশের দিকে আপনারা আরো বেশি করে নজর দেন। কারণ, যেসব দেশের সঙ্গে এত দিন আমরা রপ্তানি বাণিজ্য করতাম তাদের ক্রয় ক্ষমতাও কমে গেছে, দারিদ্রের হার বেড়ে গেছে, সেখানকার অবস্থা হয়তো ওপর দিয়ে বোঝার উপায় নেই। কিন্তু সেসব দেশে যারা থাকে তারা জানে। সেজন্যই আমাদের নতুন নতুন জায়গা এবং নতুন নতুন পণ্য খুঁজতে হবে।

তিনি এসময় রপ্তানি বাস্কেটটকে স্ফিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, আমরা কেবল আরএমজি পণ্যের ওপরই নির্ভরশীল থাকবো কেন? ট্রেন্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই আমাদের পোশাকের ডিজাইনগুলো পরিবর্তন করতে হবে। সরকার এজন্য বেসরকারি খাতের সহায়তায় ফ্যাশন ডিজাইন বিশ^বিদ্যালয় করেছে কেননা এক্ষেত্রে গবেষণারও প্রয়োজন রয়েছে।

বর্তমান যুগ ইকোনমিক ডিপ্লোমেসির যুগ এবং সেভাবেই বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোকে তাঁর নির্দেশ দেওয়া রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোন দেশের বাজারে আমরা ঢুকতে পারবো। সেটা সরকারের পক্ষ থেকেও আমরা করবো কিন্তু ব্যবসায়ীদেরকেও নিজেদের পার্টনার নিজেদেরকে খুঁজে নিতে হবে। সেদিকেও আপনাদের নিজেদের দৃষ্টি দিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিজেদের উৎপাদন যেমন বাড়াবো, রপ্তানিও বাড়াবো আবার দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়িয়ে অর্থনৈতিকভাবেও আমরা এগিয়ে যাব।

শেখ হাসিনা বলেন, এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘরে ঘরে ইন্টারনেট, ছেলে মেয়েদের জন্য কম্পিউটার ট্রেনিং ও কম্পিউটার ইনকিউবেশন সেন্টার করে দিয়ে কারিগরি শিক্ষা ও ভোকেশনাল ট্রেনিংকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। ৪র্থ শিল্প বিপ্লব যখন আসবে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের জনশক্তি তৈরী করা-এটাও আমাদের জন্য প্রয়োজন। সেভাবে উপযুক্ত জনশক্তি তৈরীতে তাঁর সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়েছে।

তিনি বলেন, স্টার্টআপ প্রোগ্রাম নিয়ে এক্ষেত্রে উদ্যোক্তা হিসেবে আমাদের যুব সমাজ যাতে এগিয়ে আসে। এজন্য ‘কোম্পানী আইন’ সংশোধন করে সরকার ‘ওয়ান ম্যান কোম্পানী’ করার ব্যবস্থাও করে দিয়েছে। এসএমই ফাউন্ডেশনে নারীদের জন্য উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সরকার ১শ’ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে সেখানে নারীরা চাইলে আলাদা ভাবে প্লট নিয়ে নিজের ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারবে। কারণ, আমি চাই আমাদের সমাজে মেয়েরাও এগিয়ে আসুক এবং তারাও এই ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত হোক, বলেন প্রধানমন্ত্রী।

এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, আজ জাতীয় রপ্তানি ট্রফি বিতরণকালে অনেক যুব উদ্যোক্তা দেখতে পেয়ে তিনি আনন্দিত হয়েছেন। অনেকেই বাবার ব্যবসা ধরে রেখে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এবং ট্রফি হাতে তুলে নিয়েছেন।

“এতেই আমার মনে একটি আশার আলো দেখতে পাই যে বাংলাদেশটা এগিযে যাবে এবং এই যুব সমাজই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে,” যোগ করেন তিনি।

জাতির পিতার কন্যা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। এই স্বাধীনতা কখনও ব্যর্থ হতে পারে না। এর সুফল আমরা প্রত্যেক মানুষের ঘরে পৌঁছে দেব। কেনুুনা দেশের মানুষের জীবন মান উন্নত করাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। আর সেই প্রতিজ্ঞা নিয়েই দেশে ফিরেছি  (’৭৫ এ জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর রিফিউজি হিসেবে ৬ বছর বিদেশে কাটাতে বাধ্য হয়েছিলাম। ’৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলে একরকম জোর করে দেশে ফেরা) এবং সেভাবেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

রপ্তানিতে ২০২১-২২ অর্থবছরে সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রপ্তানি ট্রফি লাভ করেছে  হামীম গ্রুপের প্রতিষ্ঠান রিফাত গার্মেন্টস লিমিটেড।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বিজয়ীদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রপ্তানি ট্রফি শিরোনামে ১টি বিশেষ ট্রফিসহ (স্বর্ণ) মোট ২৯টি স্বর্ণ, ২৭টি রৌপ্য এবং ২১টি ব্রোঞ্জ ট্রফি প্রদান করেন।

অনুষ্ঠানে সরকারের রপ্তানি বাণিজ্যের ওপর একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়।

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি টিপু মুনশি। সম্মানিত অতিথি হিসেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহা. সেলিম উদ্দিন ও এফবিসিসিআই’র সভাপতি মাহবুবুল আলম বক্তৃতা করেন। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন স্বাগত বক্তৃতা করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রপ্তানি ট্রফি লাভকারি রিফাত গার্মেন্টস লিমিটেড-এর পরিচালক সাজিদ আজাদ এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিভাগে সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়ের জন্য পিকার্ড বাংলাদেশের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর অমৃতা মাকিন ইসলাম স্বর্ণপদক জয়ের অনুভূতি ব্যক্ত করেন।

যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশ গড়ে তোলার পাশাপাশি একজন মা যেমনভাবে তার রুগ্ন শিশুর যত্ন নেয় সেভাবেই আমাদের শিল্প কলকারখানাগুলোর জাতীয়করণ, সংস্কার ও পুনপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের শিল্পখাতকে এগিয়ে নেওয়ায় জাতির পিতার বিভিন্ন যুগান্তকারি পদক্ষেপেরও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। ’৭৫এর বিয়োগান্তক অধ্যায় স্মরণ করে বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে তিনি বলেন, আজ ১৪ জুলাই, এদিন তাঁর ভাই শেখ কামালের বিয়ে হয়েছিল দেশসেরা মহিলা ক্রীড়াবিদ সুলতানা কামালের সঙ্গে। যাদের কাউকেই ১৫ আগস্ট ঘাতকরা রেহাই দেয়নি।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে বলেন, আজকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দিতে পেরেছি এবং রিনিউয়েবল এনার্জির ওপরও জোর দিচ্ছি। সোলার প্যানেল, বায়ুচালিত বিদ্যুৎ এবং নতুন আর একটি বিষয় হাইড্রোজের থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সেটার জন্য আমরা প্রস্ততি নিচ্ছি। এটা এখনও গবেষণা পর্যায়ে রয়েছে। সেটা যখন আসবে আমরা সেটাও বাস্তবায়ন করবো। এভাবেই আমরা বিদ্যুতে আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করছি।

দারিদ্রের হার হ্রাস এবং ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আর কোন হত দরিদ্র থাকবে না মর্মে দৃঢ় প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অর্থনীতি এখন বিশে^র ৩৩তম অর্থনীতিতে উন্নীত হয়েছে। ইনশাল্লাহ আগামীতে এক্ষেত্রে আরো সামনের দিকে নিয়ে যাব এবং বড় অর্জন করতে পারবো বলে আমার বিশ^াস রয়েছে। কেননা তাঁর সরকার প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা একই সঙ্গে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত গৃহীত প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে এবং জাতির পিতার রেখে যাওয়া স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়শীল দেশের মর্যাদা লাভ করে দেশের অর্থনীতিকে তাঁর সরকার যথেষ্ট শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়েছে। টানা সরকার পরিচালনায় পরিকল্পিতভাবে তাঁর সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণেই এটা সম্ভব হয়েছে।

২০২৬ সাল থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের যাত্রা শুরু হবে। সেজন্য ইরোপীয় ইউনিয়সসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তাঁর সরকার আলাপ-আলোচনা ও চুক্তি করছে, বলেন তিনি।

তিনি বলেন, শুধু সীমিত কয়েকটি পণ্যের ওপর আর আমরা নির্ভরশীল থাকতে চাই না।  আজকে আমাদের বহুপণ্যের বিদেশে অনেক চাহিদা রয়েছে। আফ্রিকার দেশগুলোতে যেমন আমাদের ওষুধের দাম অনেক বেশি, তারা একটু রঙচঙা জিনিস পছন্দ করে, কাজেই আমাদের সিরামিক যত রঙচঙা হবে তাদের কাছে তত আকর্ষণীয় হবে। পাশাপাশি, আমাদের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হস্তশিল্প এবং পাট ও পাটজাত পণ্য রয়েছে। আর জুট জিনোম যেহেতু আমরা আবিস্কার করেছি, তাই, এর বহুমুখীকরণ করে পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে এটি বাজারজাত করা সবথেকে সহজ।

তিনি বলেন, কৃষি গবেষণায় একটা বিপ্লব ঘটে গেছে বাংলাদেশে। কাজেই বহুমুখী পণ্য উৎপাদন হচ্ছে সেগুলো কিভাবে প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানি করা যায সে ব্যবস্থাটা নেওয়া। তাছাড়া, এখন ম্যান মেইড ফাইবারের চাহিদা বেড়ে বেড়ে গেছে। কাজেই এই ম্যান মেইড ফাইবার এবং এর অ্যাপারেলসও তৈরী করে আমরা বিদেশে রপ্তানি করতে পারি। সবথেকে বড় কথা ডিজিটাল ডিভাইস এবং আইসিটি সেক্টর, যার চাহিদা এখন সবথেকে বেশি। কাজেই আমরা যদি ডিজিটাল ডিভাইসগুলো তৈরী করতে পারি যেজন্য আমরা সারাদেশে আইসিটি পার্ক নির্মাণ করে দিয়েছি সেখানে যতবেশি বিনিয়োগ হবে তত বেশি উৎপাদন বাড়বে এবং আমরা বিদেশেও রপ্তানি করতে পারবো। আর নিজেদেরও তো চাহিদা বেড়ে গেছে আমাদের ছেলেমেয়েদের হাতেই ল্যাপটপ, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ট্যাব সববিছুই আছে, তারা ব্যবহার করতে পারছে। কাজেই সেদিকে আমাদের বেশি করে নজর দেওয়া উচিত।

তিনি বলেন, কাজেই উৎপাদিত পণ্য কিভাবে বহুমুখীকরণ করা যায় এবং নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করা যায় সেদিকে সকলেই একটু দৃষ্টি দেবেন।

শেখ হাসিনা বলেন, “আজকে এই আর্থনীতিকে এত বাধা বিঘ্নের পরেও যে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছি এখানেও আপনাদের একটা বিরাট সহযোগিতা দরকার। কাজেই আপনদের যেটা চাহিদা সেটা আমরা পূরণ করবো, কিন্তু আপনাদেরও দায়িত্ব আছে দেশের প্রতি, যেটা মাথায় রাখতে হবে।”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

eleven + 18 =