ইরানী বিশ্বাস
যেকোনো সংগ্রামেই বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে কলম। আর এই কলম দিয়ে যুদ্ধ জয়ের একমাত্র মানুষ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি শুধুু নিজে বাঁচতে আসেননি এ পৃথিবীতে। তিনি দেশ, সমাজ ও জাতিকে জাগাতে এবং বাঁচাতে এসেছিলেন। কবির ভাষায়, ‘অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছি, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছি, কাহারো তোষামোদ করি নাই, প্রশংসার এবং প্রাসাদের লোভে কাহারো পিছনে পোঁ ধরি নাই। আমি শুধু রাজার বিরদ্ধেই বিদ্রোহ করি নাই, সমাজের, জাতির, দেশের বিরুদ্ধে আমার সত্য তরবারির তীব্র আক্রমণ সমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে।’
তাঁর এই লেখা পড়েই বোঝা যায়, তিনি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মান মানুষ নয়। তিনি জীবনকে জীবনের নিয়মে বেঁচে থাকার সংগ্রামের কথা বলেছেন। তিনি বিলাসী মানুষের ভিড়ে সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের কথা বলেছেন। নজরুল কোনো বিলাসী সাহিত্যের চর্চা করেননি। তিনি শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষের কথা সাহিত্যের মাধ্যমে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। সামন্ত যুগে প্রভুদের কাছে সাহিত্য ও শিল্প ছিল বিলাস সামগ্রী। সেখানে গ্রিস-রোম পুড়ে অঙ্গার হলেও নীরোদরা মনের আনন্দে বাঁশি বাজাতো। আর নীরোদের পোষ্যরা প্রভুর মনোরঞ্জন করাকেই শিল্প বলে মনে করতেন। এ কারণেই সামন্ত যুগে মেহনতি মানুষের কালিঝুলি মাখা, নির্যাতিত ও শ্রমঘর্মসিক্ত মানুষের আর্তনাদের স্থান ছিল না। তাই সামন্ত যুগের সাহিত্য দিয়ে নজরুলের সাহিত্য বিচার করা চলে না। নজরুলের সাহিত্যে বিদ্রোহ ছিল। ছিল অধিকার আদায়ের আক্ষেপ। অনাহুত মানুষগুলোকে সভ্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার অব্যক্ত চেষ্টা ছিল তাঁর সাহিত্যে। তাই তিনি লিখেছিলেন,
“বন্ধু গো আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে,
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।”
জন্মের পরেই নজরুল জীবনের আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে নিয়েছিলেন দারিদ্র্য। তিনি জন্মের পরে এ পৃথিবীতে সৌন্দর্যের ঝরনাধারা দেখেননি। কলাপাতায় মোড়া মাখন খেয়ে বড় হননি। জীবনের যে বয়সটাতে আনন্দে আর খেলার ছলে কাটানোর কথা, ঠিক সে বয়সটাতে তিনি রুটির দোকানে কাজ নিয়েছিলেন। রাস্তায় ল্যাম্প পোস্টের নিয়ন আলোয় যিনি বইয়ের পাতা উল্টিয়েছেন। তিনি কি করে সাহিত্যের বিলাসীতায় গা ভাসাবেন? তাই তো তিনি লিখেছিলেন,
“হে দরিদ্র তুমি মোরে করেছো মহান।”
যুগের যন্ত্রনা আর বুকের যন্ত্রনা এ দুয়ে তাঁকে করেছে মহান। তিনি দেখেছেন মহাযুদ্ধে ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা, যুদ্ধের পর বাজার মন্দা, অর্থনৈতিক সংকট, বেকার সমস্যায় শত শত যুবকের আত্মহত্যা, পুঁজিবাদী, দালাল, কন্ট্রাক্টর, চোরাকারবারীদের দোর্দণ্ড প্রতাপ, সাম্রাজ্যলিপ্সা, মানবাত্মার অপমান, নারীর অমর্যাদা। মা-বোনের ইজ্জত বিক্রি হতে দেখেছেন সামান্য অর্থের বিনিময়ে। তাই তো তিনি কলকৈল্যবাদী হয়ে বিলাসী সাহিত্য রচনা করতে পারেননি। মুখোশ পরা ভদ্রবেশি বর্বরতা কবি চিত্তে তীব্র আন্দোলিত করেছে। তাই তো তিনি বলেছেন, ‘আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা, পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি। তার চোখে চোখ ভরা জলও দেখেছি। শ্মশানের পথে, গোরস্থানের পথে তাকে ক্ষুধাজীর্ণ মূর্তিতে ব্যথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি। যুদ্ধভূমিতে তাকে দেখেছি, কারাগারের অন্ধকুপে তাকে দেখেছি, ফাঁসির মঞ্চে তাকে দেখেছি।’
নজরুল কোনো দার্শনিক তত্ত্বেও কবি নন। তাঁর দর্শন অতীব সরল। তিনি সত্যকে সত্য ও মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে দ্বিধাবোধ করেননি। এমনকি কোনো মারপ্যাঁচের প্রয়োজন বোধ করেননি। নজরুল একটি বিশেষ যুগের কবি ছিলেন, এমন অপবাদ আছে। অনেকেই বলেছেন, রবির হাতে যেমন রচিত হয়, সেই চিরকালের বাণী কই? এ প্রশ্নের জবাবে নজরুল তাঁদের বলেছেন,
রবির কিরণ ছড়িয়ে পড়ে দেশ হতে আজ দেশান্তরে,
সে কিরণ তবু পশিল না মা, বন্ধ কারার অন্ধ ঘরে।
শুধু জীর্ণ সমাজ ও অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধেই তাঁর বিদ্রোহ ছিল না। প্রচলিত শিল্পকলার বিষয়েও তিনি ছিলেন সক্রিয়। তিনি বলতেন, আর্ট অর্থ সত্য প্রকাশ করা। গ্যায়েট আর্ট সম্বন্ধে বলতেন, ‘প্রতিভার কাছে আমাদের প্রথম ও শেষ দাবি সত্যপ্রীতি।’ গ্যায়েট-র এই কথার সাথে একাত্ব ছিলেন নজরুল। অন্যায়, অত্যাচার ও উৎপীড়ন দেখে বিলাসী আর্টের দিকে যেতে পারেননি তিনি। মানবতার যুগে, মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে পাশ কাটিয়ে কোন শিল্পকলা হতে পারে না। দেশের প্রতি ছিল তাঁর বিরাট দায়িত্ব। লোভ-প্রলোভনের মোহে শৈল্পিক সত্ত্বাকে হজম করতে তিনি দেননি। ভিক্টর হুগো বলেছিলেন, গোনা কয়েকটা দিন মাত্র আমাদের আয়ু। সেই দিনগুলো যেন আমরা নীচ দুর্বৃত্তদের পায়ের তলায় গুড়ি মেরে না কাটাই। নজরুলের ক্ষেত্রে হুগোর উক্তি যথার্থভাবে প্রযোজ্য ছিল।
যুগের ঘটনাকে বাদ দিয়ে কোনো সাহিত্য রচিত হতে পারে না। তাহলে তা দেশ, সমাজ ও মানুষের প্রতি বিশ্বাসঘাকতা করার সামিল হয়। রমা রোলাঁর মতে, ‘বর্তমানের প্রতি উদাসীন থাকাই তো সর্বমানবের চিরন্তন স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা।’ টি এস এলিয়ট বলেছেন, ‘যুগের প্রতিচ্ছবি যে শিল্পীর দর্পণে ধরা পড়ে না তাঁর সাথে দেশ ও দেশের মানুষের কোনো সম্পর্ক থাকে না।’ আবার গোর্কি’র অভিমত, ‘শিল্পী হচ্ছেন তাঁর দেশের ও তাঁর স্বদেশ ও সমাজের যেন চক্ষু, কর্ণ আর হৃদয়। এক কথায় তার যুগের বাণী বা প্রতিধ্বনি। তিনি যথাসাধ্য সবকিছু জানাবেন। অতীতের সঙ্গে তাঁর পরিচয় থাকবে যত বেশি ততই তিনি নিজের যুগকে ভালোভাবে বুঝতে পারবেন, ততই তিনি তার কালের সর্বজনীন বিপ্লবী রূপ ও কর্তব্যের পরিধি তীব্রভাবে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন’।
নজরুল অকৃত্রিমভাবে বঞ্চিত সমাজে লাঞ্ছিতদের কথাই লিখেছেন। বঞ্চিত মানুষের বেদনার সাথী হতে পেরেছিলেন বলেই লিখেছিলেন, ‘জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান, বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাব আমি নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা এই আমার তপস্যা’।
ফরাসি কবি পল এলুয়ার ব্যক্তি জীবনে নজরুলের মতো নির্যাতন ও অত্যাচারে উৎপীড়িত হয়ে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জবানবন্দিতে বলেছিলেন, ‘সময় এসেছে যখন সব কবির উপর অধিকার ও কর্তব্য ন্যস্ত হয়েছে এই কথা ঘোষণা করবার যে, অন্য মানুষদের জীবনে, সর্বসাধারণের জীবনে গভীরভাবে প্রোথিত…মূক জনতার হয়ে কথা বলার সাহস চাই’। কিন্তু নজরুল ছিলেন সহসী। তিনি কারো কাছে মাথা নত করেননি। লাভের জন্য তিনি কখনো কারো কাছে সালাম ঠোকেননি। সুবিধাবাদীদের মতো স্বার্থ উদ্ধারের জন্য হৃদয়বৃত্তিকে হনন করেননি। তিনি বলেছেন,
বল বীর-
বল চির উন্নত মম শির।
নজরুল সাহিত্যের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। তাঁকে আমরা শুধু আমাদের স্বার্থবুদ্ধির টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছি মাত্র। তাই তাঁকে বাংলার কবি হিসেবে চিত্রিত করেই আমরা আত্মপ্রসাদ লাভ করি। তাঁর ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসে দেখা যায় নায়ক প্রমথ বলে, আমার ভারত এ মানচিত্রের ভারতবর্ষ নয়। আমার ভারতবর্ষ-ভারতের এই মূক-দরিত্র-নিরন্ন পর-পদদলিত তেত্রিশ কোটি মানুষের ভারতবর্ষ।…আমার ভারতবর্ষ মানুষের যুগে যুগে পীড়িত মানবাত্মার ক্রন্দন-তীর্থ, ওরে এ ভারতবর্ষ তোদের মন্দিরের ভারতবর্ষ নয়, মুসলমানের মসজিদের ভারতবর্ষ নয়, এ আমার মানুষের – মহামানুষের মহাভারত’।
কেবল বাংলা বা ভারতের জন্য নয়, হিন্দু-মুসলমানের জন্যও নয়, নিখিল বিশ্ব ও মানবতার জন্য তাঁর ছিল গভীর আর্তি। তিনি লিখেছিলেন,
গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ, মুসলিম-খ্রিশ্চান।
প্রচলিত ধারায় নজরুল সাহিত্যের সঠিক মূল্যায়ন হবে না। কারণ জনতার সাথে ছিল তাঁর গভীর একাত্মতা এবং তাদের মধ্যে ছিলেন একান্তভাবে সমর্পিত ও নিবেদিত। আভিজাতের বৃত্ত ভেঙে তিনি মূক জনতার মধ্যে মিশে গিয়েছিলেন। তার লেখায় উঠে এসেছে,
‘আমি উঁচু বেদীর উপর সোনার সিংহাসনে বসে কবিতা লিখিনি। যাদের মূক মনের কথায় আমি ছন্দ দিতে চেয়েছি, মালকোচা মেরে সেই তলার মানুষের কাছে নেমে গেছি। দাদারে বলে দু’বাহু মেলে তারা আমায় আলিঙ্গন করেছে। আমি তাদের পেয়েছি-তারা আমায়ে পেয়েছে।’
নজরুল হিন্দু মেয়ে প্রমিলাকে বিয়ে করেছিলেন। এ কারণে তিনি মৌলবাদীদের রোষাণলে পড়েছিলেন। নজরুল মুসলিম হয়ে হিন্দু দেব-দেবী নিয়ে কবিতা লেখেন, এ নিয়ে অনেক গুঞ্জন উঠেছিল। নজরুল লিখেছিলেন,
১
হিন্দু না ওরা মুসলিম, ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।
২
গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান।
৩
তব মসজিদে, মন্দিরে প্রভু নাই, নাই মানুষের দাবী
মোল্লা, পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি।
নজরুল আসলে কোনো ধর্ম বা কোনো সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন না। অথচ মৌলবাদীরা মহৎ, উদারপ্রাণ, অসম্প্রদায়িক মানুষের কবি নজরুলকে সাম্প্রদায়িকতায় ও সীমাবদ্ধতার বৃত্তে বন্দি করতে চান। তারা নজরুলকে ইসলামী রেনেসাঁর কবি বলেছেন শুধু ইসলামের কবিও বলেছেন। অথচ আজকের রক্ষণশীল গুরুরাই নজরুলকে গালি দিয়ে বলেছে খোদাদ্রোহী, নরাধম নাস্তিক।
রক্ষণশীলতার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নজরুল বলেছেন, ‘বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি। হিন্দু মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধবিগ্রহ মানুষের একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব – অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তুপের মতো জমা হয়ে আছে। এই অসাম্য এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্য-সঙ্গীতে, কর্ম-জীবনে, অভেদ-সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম-অসুন্দরকে ক্ষমা করতে, অসুন্দরকে সংহার করতে এসেছিলাম – আপনার সাক্ষী আামার পরম সুন্দর’।
বিদ্রোহের অন্য নাম কাজী নজরুল। বাঙালির মনে অথবা ঘরে যেখানেই বিদ্রোহের দামামা বেজে ওঠে সেখানেই যেন নজরুলের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। তাঁর লেখার পরতে পরতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে সেই চিহ্ন।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ