আবেগী মেহজাবীন চৌধুরী

ময়ূরাক্ষী সেন

২০০৯ সালে লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টারে বিজয়ী হয়ে মিডিয়াতে আসেন মেহজাবীন চৌধুরী। মিডিয়াতে পা দিয়েই তার শুরু হয় একে একে সব জনপ্রিয় কাজ। অল্প সময়ের মধ্যে ছোট পর্দার বেশ জনপ্রিয় নায়িকা হয়ে যান তিনি। ছোট পর্দার নায়িকা হিসেবে তিনি কতটা জনপ্রিয় তা এখন বোঝা যায় সোশ্যাল মিডিয়া ও ইউটিউবের ভিউ’র মাধ্যমে। ন্যাচারাল অভিনয় ও সৌন্দর্য দিয়ে তিনি ভক্তদের মন জয় করে নেন। লাক্স সুন্দরী হওয়ার পর তার প্রথম কাজ ছিল মাহফুজ আহমেদের বিপরীতে, ‘তুমি থাকো সিন্দুপারে’ নাটকে। এরপর আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বিজ্ঞাপন, মডেলিং ও অভিনয়ের মাধ্যমে প্রশংসা কুড়াতে থাকেন তিনি। তবে ২০১৩ সালে ‘অপেক্ষার ফটোগ্রাফি’ তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

২০১৭ সালে সোস্যাল মিডিয়ার ভাইরাল নাটক ‘বড় ছেলে’তে অভিনয় করে মেহজাবীন ব্যাপক প্রশংসা পান। শুধু অভিনয় নয়, নাটকও লিখেছেন তিনি। ২০২০ সালে ‘থার্ড আই’ তার লেখা প্রথম নাটক। মেহজাবীন বেশ কয়েকটি ওয়েব সিরিজেও কাজ করছেন। সাবরিনা, রেডরাম, কাজলের দিনরাত্রি ইত্যাদি তার জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ। বাংলালিংক, রাঁধুনী লাক্সের মতো বিভিন্ন বিখ্যাত ব্রান্ডের বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন তিনি, নাটক ছাড়াও সেসব বিজ্ঞাপন খুব জনপ্রিয় হওয়াতে তাকে অনেকে বিজ্ঞাপনের নায়িকা হিসেবেও চিনে থাকে। এত কাজের ভিড়ে অর্জনের ঝুড়িও ভর্তি তার। মেহজাবীন ২০১৬ সালে চ্যানেল আইতে প্রচারিত ‘মঙ্গোলি-চ্যানেল আই সেরা নাচিয়ে’ নৃত্য রিয়েলিটি শোতে অতিথি বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

মেরিল প্রথম আলো পুরস্কারসহ সেরা অভিনেত্রী হিসেবে বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। সমালোচনার উর্ধ্বে থাকে না কোনো শিল্পী। ২০২১ সালে তেমনি এক তেমনি সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল মেহজাবীন চৌধুরীকে। তার অভিনীত নাটক ‘ঘটনা সত্য’ অনেক সমালোচনার শিকার হয়। নাটকটিতে দেখানো হয়েছিল স্পেশাল চাইল্ড হচ্ছে পাপকর্মের ফল, এমন ভুল এবং অযৌক্তিক বার্তা দর্শক মেনে নিতে পারেনি। ফলে তুমুল সমালোচনা ঝড় ওঠার জন্য নাটকের পুরো টিম দুঃখ প্রকাশ করে এবং পরবর্তীতে নাটকটি ইউটিউব থেকে সরিয়ে ফেলা হয়।

এই ঘটনা ছাড়া মেহজাবীনকে খুব বেশি সমালোচনা শিকার কখনোই হতে হয়নি। এখন বেশিরভাগ স্টার কিংবা শিল্পীরা সোশ্যাল মিডিয়াতে নানা ধরনের মন্তব্য করে ভাইরাল কিংবা সমালোচনার শিকার হন। সে ক্ষেত্রে মেহজাবীন কখনো স্রোতে গা ভাসাননি। অল্পভাষী ও স্পষ্ট কথা বলার জন্য তিনি বরাবরই সকলের প্রিয়।

বর্তমানে মেহজাবীনের আলোচনায় থাকা নাটক হলো ‘অনন্যা’। নাটকটিতে মেহজাবীনকে কর্মজীবী মা হিসেবে দেখা যায়, ইতিমধ্যে নাটকটি দর্শকের ব্যাপক সাড়া পেয়েছে। সাড়া পাবারই কথা কারণ নাটকটিতে মেহজাবীনের এমন অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে যা আমাদের সমাজের কর্মজীবী মায়েরা অনুভব করতে পারবে। পুরুষদের মতো নারীরা সমান তালে বাইরে কাজ করলেও ঘরে ফিরে তাদের ঘরের সকল কাজ সামলে উঠতে হয়। সন্তান থেকে শুরু করে সংসারের প্রতিটি খুঁটিনাটি নারীকে দেখতে হয়। ঠিক এই সময়টা একজন নারীর প্রয়োজন পরিবারের সহযোগিতা। সমাজের এই চিত্রটি তুলে ধরা হয়েছে নাটকে। নাটকের নির্মাতা মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ, গল্প জাহান সুলতানা এবং জাকারিয়া নেওয়াজের। চিত্রনাট্য করেছেন জাহান সুলতানা। অনন্যা’তে মেহজাবীন ছাড়াও অভিনয় করেছেন ডলি জহুর, শাশ্বত দত্ত, আজম খান, এবি রোকন আরো অনেকে।

গণমাধ্যমে এই নাটক সম্পর্কে মেহজাবীন জানান, আগের তুলনায় তিনি তার কাজের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন কিন্তু এমন অসাধারণ একটি চরিত্রে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন বলেই এই নাটকে কাজ করছেন। তাছাড়া নির্মাতা মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজের উপর তার ভীষণ আস্থা। সকল কর্মজীবী মায়েদের উৎসর্গ করে এই নাটকটি তৈরি করা হয়েছে। পর্দায় অনেক নারী নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পারবে। নারী কেন্দ্রিক যেকোনো চরিত্রের প্রতি মেহজাবীনের কাজ করার আগ্রহ সবসময়। এর আগেও তিনি বিভিন্ন নারীদেরকে উৎসর্গ করা কাজের সাথে জড়িত ছিলেন।

সবধরনের চরিত্রে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ তিনি খুব ভালোভাবে গ্রহণ করেন। প্রতিবাদী নারী থেকে শুরু করে কমেডি নায়িকা সব চরিত্রই দর্শক তাকে পেয়েছে। ন্যাচারাল অভিনয়ের জন্য তিনি প্রশংসা কুড়িয়েছেন সব সময়।

মেহজাবীন বরাবরই তার ব্যক্তিজীবনের ইতিবাচক দিকটি তুলে ধরেছেন দর্শকদের সামনে, ব্যক্তি জীবনের নেতিবাচক দিক নিয়ে তিনি আলোচনা করতে পছন্দ করেন না। মেহজাবীন ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম শহরে জন্মগ্রহণ করেন। শান্তা মরিয়ম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পড়াশোনা শেষ করেন। ব্যক্তি হিসেবে মেহজাবীন খুবই ধৈর্যশীল একজন মেয়ে। ধৈর্য এবং নিষ্ঠার সাথে কাজ করার জন্য তার বেশ সুনাম রয়েছে। শুটিংয়ে সবসময় নির্দিষ্ট স্থানে তিনি সময়মতো উপস্থিত থাকেন। কারণ বরাবরই তার কাছে সময়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। আগের থেকে কাজের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার কারণ হচ্ছে এখন তিনি বেশি ভালো কাজের সাথে থাকতে চান। কাজের সংখ্যা নয় বরং কাজের মানকে তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।

নিজের ধৈর্যের প্রশংসা নিজে করলেও বরাবরই বলেছেন মেহজাবীন বেশ আবেগী একজন মানুষ। জীবনের যেইসব পরিস্থিতি ও ঘটনাগুলো চাইলেই এড়িয়ে যাওয়া যায় তিনি সেসব মনে রেখে অনেক বেশি আবেগী হয়ে পড়েন। তাই নিজের খারাপ দিক বলতে তিনি বরাবরই বলেন আবেগটা একটু বেশি। ছোট থেকে মেহজাবীনের অভিনেত্রী হওয়ার শখ ছিল। তার শখ পূরণের সহযোগী ছিলেন তার বাবা-মা। ছোটবেলা থেকে তিনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন বাবা-মায়ের সেই স্বপ্নের পথেই তাকে হাঁটতে সাহায্য করেছেন। সব সময় চান তার বাবা-মার একটি ভালো সন্তান হতে, পৃথিবীর সব সুখ যেন তিনি তার বাবা মাকে দিতে পারেন।

একটি প্রশ্নের মুখোমুখি মেহজাবীনকে সবসময় হতে হয়, তিনি বিয়ে কবে করছেন! তিনি বরাবর হেসে উত্তর দেন, যখন উপযুক্ত সময় হবে তখন। জীবন নিয়ে খুব বেশি পরিকল্পনা তিনি করেন না, কারণ ভবিষ্যতের কোনো নিশ্চয়তা কেউ কখনো দিতে পারে না। নিজের পেশা ও চরিত্রের প্রয়োজনে তিনি এতবার বউ সেজেছেন যে আলাদা করে বউ সাজার খুব একটা আগ্রহ কাজ করে না বা কিভাবে বউ সাজবেন তা নিয়ে ভাবেন না।

ভ্রমণ করতে মেহজাবীন খুব পছন্দ করেন। কাজের জন্য প্রচুর ব্যস্ত সময় পার করতে হয় তার, কিন্তু নিজের রিফ্রেশমেন্টের জন্য ছুটি পেলেই তিনি দেশের বাইরে চলে যান। ভ্রমণ করার ফলে তিনি পুনরায় আবার কাজের শক্তি খুঁজে পান। রান্না করতে ও খেতে দুটোই ভালোবাসেন তিনি। খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি নিজেকে ফিট রাখার জন্য মাঝেমধ্যে ব্যায়াম করেন, তার ফিটনেসের রহস্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাজের সুবাদে তার এত ছোটাছুটি করতে হয় যে তিনি যা খান তা বার্ন হয়ে যায়। তাছাড়া জেনেটিকালিও তার পরিবারের সকলেই বেশ ফিট। তাই আলাদা করে নিজের ফিটনেসের জন্য খুব বেশি একটা কষ্ট করা লাগে না তার।

সাজগোজের ক্ষেত্রেও মেহাজাবীন ন্যাচারাল থাকার চেষ্টা করেন, চরিত্রের প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের মেকআপ নিলেও সব সময় তিনি হালকা মেকআপ পছন্দ করেন। নিজেকে ফ্যাশনেবল ভাবে সাজিয়ে তুলতে চান কিন্তু বেশিরভাগ সময় তার সুযোগ হয়ে ওঠে না কারণ শিল্পী হবার কারণে চরিত্রের মধ্যে সবসময় থাকতে হয়। তাই চরিত্র যেমন আবদার করে তাকেও তেমনভাবে সাজতে হয়। চরিত্র ও কাজকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন মেহজাবীন। নিজের ভক্তদের তিনি সাপোর্টার বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কারণ তিনি মনে করেন তারা যদি তাকে সাপোর্ট না করতো তাহলে তিনি আজকের মেহজাবীন চৌধুরী হতে পারতেন না। তাই উপহার হিসেবে তিনি তার সকল দর্শকদের ভালো কাজ দিতে চান।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সেলিব্রেটি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

eight + seven =