করোনা, গরম, সুস্থতা এবং …

ডা. অপূর্ব পন্ডিত : শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের পূর্ণতা-সুস্থতার প্রধান শর্ত। আমরা অসুস্থ হলেই বুঝি, সুস্থতা কী? হাতের একটি আঙুল কেটে গেলেই বুঝতে পারি, আঙুলটি কত জরুরি কাজ করতো? গরমে, ঘামে, অস্বস্তিতে-যখনই এসি, ফ্যান ব্যবহার করবেন, বাড়বে করোনা সংক্রমণের হার।
অনেক রোগের প্রকোপ ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কমে যায়। কিছু ইনফ্লুয়েঞ্জা শীত মৌসুমে দেখা দেয়, যেগুলো আবার গরমকালে চলে যায়। অন্যদিকে, টাইফয়েডের মতো অনেক রোগের শীর্ষ সময়Ñ গ্রীষ্ম।
কোভিড-১৯ বা নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও তাই গরমে সংক্রমণ বাড়ছে।
গরম মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। আউয়ালের গল্পটি এখানে বলাই দরকার। আউয়াল, শীতকালে দারুণ সতেজ। সে একটি পত্রিকা অফিসে গ্রাফিক্সের কাজ করে। একদিন বস অফিসে, মানেই সবাই তটস্থ। কিন্তু আউয়ালের সেদিকে মন নেই। কাজের ফাঁকে কখন যেন জুতা খুলে বসেছে। বসের চিৎকারে আউয়ালের সম্বিৎ ফিরেÑআউয়াল, তোমার মোজার গন্ধে আর বাঁচিনা। তুমি কি মানুষ? আউয়ালের গরমকাল, মানেই অস্বস্তি। শরীরে একটা বিভৎস গন্ধ। জুতা খোলার উপায় নেই, সেইসঙ্গে কদিন পরপরই ঠান্ডা সর্দি, হাঁচি লেগেই থাকে।
গবেষণায় দেখা গেছে, গরমের সময় মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা বেশি দেখা দেয়। তাই এ সময়ে সতর্ক হয়ে না চললে, যে কোনো সময়ই আপনি অসুস্থ হতে পারেন।

গরমে যেসব সমস্যা হয়
হিট স্ট্রোক : প্রচণ্ড গরম ও আর্দ্রতায় যে কারও শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে হিট স্ট্রোক হতে পারে। শরীরের তাপমাত্রা যখন ১০৪ ফারেনহাইটের বেশি হয়, তখনই হিট স্ট্রোক হতে পারে। হিট স্ট্রোক মেডিকেল ইমার্জেন্সি, সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে চিকিৎসা না দেওয়া হলে রোগী মৃত্যুবরণ করতে পারে। এর লক্ষণÑ ঘাম না বের হওয়া, ত্বক লাল হয়ে যাওয়া, শুষ্ক হওয়া, হঠাৎ মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা, বমি ভাব, অস্থিরতা, শ্বাস নিতে সমস্যা, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না থাকা।
ছোট বাচ্চা, বয়স্ক লোক, ব্যায়ামবীর বা দিনমজুরদের হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা খুবই বেশি। শিশু ও বৃদ্ধদের তাপনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম থাকায়, হিট স্ট্রোকের আশঙ্কা বেড়ে যায়। বয়স্ক ব্যক্তিরা প্রায়ই অন্যান্য রোগে ভুগেন কিংবা নানা ওষুধ সেবন করেনÑ যা হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
হিট স্ট্রোকে প্রাথমিক চিকিৎসা : আক্রান্ত লোকটিকে ছায়াযুক্ত একটি জায়গায় নিয়ে আসতে হবে, ভারী কাপড় খুলে দিয়ে গায়ে ঠান্ডা পানি ঢালতে হবে। তাকে সম্ভব হলে ফ্যানের নিচে বা এসি রুমে নেওয়া ভালো। এতে শরীরের ঘাম উড়ে যাবে। সম্ভব হলে তার বগল ও রানের খাঁজে বরফ দিতে হবে। যদি আক্রান্ত লোকটি পানি পানের মতো অবস্থায় থাকে, তাহলে তাকে ঠান্ডা পানি বা পানীয় পান করতে দিন।
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধ : গরমের সময় শরীরকে পানিশূন্য হতে না দেওয়া। শরীরে পানির পরিমাণ স্বাভাবিক রাখতে প্রচুর পরিমাণ পানি, ডাবের পানি, মুখে খাওয়ার স্যালাইন পান করা।
বেশি গরমের সময় ব্যায়াম বা ভারী কায়িক পরিশ্রম না করা। গরমে বাইরে বের হলে সাদা বা হালকা রঙের কাপড় পরে বাইরে বের হওয়া।
পানিস্বল্পতা : এ সময় শরীরের কোষ সজীব রাখতে প্রচুর পানি খেতে হবে। লবণের অভাব পূরণ করতে খাওয়ার স্যালাইন খাওয়া যেতে পারে। শরীরে পানি কম হলে প্রস্রাব হলুদ ও পরিমাণে কম হবে এবং জ্বালাপোড়া বা প্রস্রাবের সংক্রমণ হতে পারে। পানির সঙ্গে অন্যান্য তরল যেমনÑ ফলের রস খাওয়া যেতে পারে। ভাজা-পোড়া, অধিক তেল, মসলাজাতীয় খাবার একদমই এড়িয়ে যেতে হবে।
ত্বক সমস্যা : প্রখর রোদে ত্বকে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ সময়ে খোলা আকাশের নিচে হাঁটাচলা বেশি হলে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি ত্বক ভেদ করে কোষের জন্য বিপদ ডেকে আনে। ত্বকে ফোসকা পড়াসহ ত্বক বিবর্ণ হতে পারে। সানগ্লাস পরা, ছাতা ব্যবহার, হালকা কিংবা সাদা রঙের পোশাক পরা গরমে উত্তম।
শরীরে যাতে ঘাম ও ধুলোবালি না জমে, ঘামাচি থেকে পরিত্রাণ পেতে সিনথেটিক পোশাক না পরা, পরিষ্কার পানি দিয়ে গোসল করা উচিত।
ডায়রিয়া : গরমে ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ে। একটু সচেতন হলে এটি এড়ানো যায়। যেমনÑ হাত পরিষ্কার করে খাবার খেলে। বাসি, পচা খাবার না খেলে।
সর্দিজ্বর : গরমে ফ্লু ভাইরাসগুলো যেমনÑ এডিনোভাইরাস, রাইনোভাইরাস জাতীয় ভাইরাল সংক্রমণ বেশি হয়। ফলে জ্বর, সর্দি, কাশি, হাঁচি ও কফ নিঃসরণ বেড়ে যায়। শিশুদের নিয়ে খুব রোদে ঘোরাঘুরি করলে, বাইরের তাপ ও শরীরের তাপের মধ্যে সমতা থাকে না বলে জ্বর হতে পারে। এ সময় শরীর থেকে প্রচুর পানি, ঘাম ও প্রস্রাব বেরিয়ে যায়।
ছত্রাক সংক্রমণ : গরমে শরীরে ঘাম জমে ছত্রাক সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। ঘাম শরীরের কুঁচকিতে, আঙুলের ফাঁকে ও জননাঙ্গে জমা হয়ে সেখানে ছত্রাক সংক্রমণের পথ বিস্তার করে। তাই এ সময় শরীরের ভাঁজগুলোতে ঘাম জমতে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে ছত্রাকবিরোধী পাউডার এসব স্থানে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে।
গরমে সুস্থতার উপায়
* প্রথম ও প্রধান সাবধানতা হল-বাইরের খোলা জায়গার পানি, শরবত, আখের রস পরিহার করা। এগুলো গ্রহণের ফলে ডায়রিয়া, আমাশয় হয়।
* নিরাপদ বিশুদ্ধ পানি পান করা। ঘরের তৈরি শরবত, পানি জাতীয় শাকসবজি ও ফল বেশি খাওয়া।
* ডাব, তরমুজ, বাঙ্গি, বেলের শরবত-এগুলো হাত ধুয়ে খাবারের উপযোগী করা।
* মাছ, মাংস, ভুনা, ভাজি, খিচুড়ি, পোলাও, ফাস্টফুড কমিয়ে পাতলা আম ডাল, পাতলা দুধ, টকদই, করলার ঝোল তরকারি, লেবু চিনির শরবত, সালাদ, রসালো ফল খাওয়া।
* সাদা ভাত-পোলাও, বিরিয়ানি, খিচুড়ি, পরোটা থেকে অনেক বেশি খাদ্যোপযোগী।
* যারা নিয়মিত হাঁটেন, তারা শুধু সময় পরিবর্তন করলেই চলবে। যেমন সকালে না হেঁটে বিকাল বা সন্ধ্যার পর হাঁটা বেশি আরামদায়ক।
* খুব বেশি হাঁটা, ব্যায়াম, অতিরিক্ত পরিশ্রম ও খাদ্য গ্রহণ পরিহার করুন।
* পোশাক পরুন আরামদায়ক। বেছে নিন, হালকা রং।
* পরিচ্ছন্ন থাকুন।
যারা অতিরিক্ত ওজনে ভুগছেন, তারা সতর্ক হোন পথ্য ও পুষ্টির ব্যাপারে। উচ্চ ক্যালরি পরিহার করে নিম্ন ক্যালরির খাদ্য গ্রহণ করলে, ওজন কমবে। এর মধ্যে রয়েছেÑ ফল (যেমন তরমুজ, বাঙ্গি, জাম, জামরুল, ডাব ইত্যাদি) ও সবজি (যেমন লাউ, পেঁপে, ঝিংগা, কুমড়া ইত্যাদি)। খাদ্য তালিকায় তেল ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সতর্ক হোন।
করোনা বিশ্বমারি
চলছে করোনা বিশ্বমারি। করোনা সংক্রমিত ব্যক্তির শ্বাসপ্রশ্বাস, হাঁচি-কাশি কিংবা কথা বলার সময় মুখ থেকে নিঃসৃত তরল কণা বা ড্রপলেটের মাধ্যমে বেরিয়ে এসে, যে কোনো বস্তু বা তলে লেগে যায়। সে জায়গা স্পর্শ করলে হাত থেকে ভাইরাসটি নাক-চোখ-মুখ দিয়ে সুস্থ ব্যক্তিও আক্রান্ত হতে পারে। তাই পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি। অন্তত তিন ফুট দূরে থাকতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসি বা ফ্যানের ব্যবহার গরমে বাধ্যতামূলক হওয়ায়- করোনার বিস্তার বেশি। বদ্ধঘরে ফ্যান বা এসি চলার কারণে ভাইরাস ঘরের ভিতর ছড়ায় এবং সংক্রমণ বাড়ায়।
বিভিন্ন আবহাওয়ার বিশ্বের ৫০০ স্থান নিয়ে একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, কোভিড-১৯ বিস্তারের ক্ষেত্রে ভাইরাস ও তাপমাত্রা, বায়ুপ্রবাহ এবং আর্দ্রতার সম্পর্ক রয়েছে। সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাওয়া মহামারি স্প্যানিশ ফ্লু গ্রীষ্মকালে সবচেয়ে বেশি বিস্তার হয়েছিল।
ইউরোপের অনেক দেশেই সেকেন্ড ওয়েভ চলছে। আইসিইউতে, উইলিয়াম হফম্যান (৭৯) কে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ১২ মার্চে। হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ এবং কর্তৃপক্ষ সেখানে ২৭ বছরের ফ্রেডরিককে ভর্তি করে নিলেন। কারণ, ফ্রেডরিকের সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যত হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আর হফম্যানের শেষ বয়সে আইসিইউ সিট দিয়ে লাভ কি? কি নিষ্ঠুর বাস্তবতা-ইউকে, আমেরিকায়?
বাংলাদেশে অনেকেই ভেবেছিল, রাস্তায় লাশের সাড়ি পরে থাকবে কেউ দেখবে না। যদিও ক’দিন যাবৎ করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুহার উর্ধ্বমুখী তবুও অর্ধকোটিরও বেশি মানুষ এখন পর্যন্ত ভ্যাক্সিনেটেড হয়েছে। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকরা জীবন দিয়ে হলেও করোনাযুদ্ধে জয়ী হওয়ার চেষ্টা করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে করোনা স্বাস্থ্যসেবায় বিশে^ রোলমডেল হয়েছে বাংলাদেশ। তবে প্রয়োজন সচেতনতা।
মনে রাখতে হবে-শারীরিক দূরত্ব, মাস্ক ব্যবহার-করোনাকালীন সুস্থতার চাবিকাঠি।
লেখক : সম্পাদক, আমারহেলথ ডটকম।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × 2 =