কিডনি রোগ

ময়ূরাক্ষী সেন

দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অনেক গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখতে তারা আমাদের অজান্তে কাজ করে যাচ্ছে। শরীরের কোনো একটি অংশ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় তবে তার মর্ম আমরা বুঝতে পারি। শরীরের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবার আগে তেমন একটা লক্ষণ দেখা দেয় না, আবার লক্ষণ দেখা দিলেও তা এত সামান্য যে আমরা এড়িয়ে যাই। তেমনই এক অঙ্গের নাম কিডনি। কিডনিতে সমস্যা দেখা দিলে শুরুর দিকের লক্ষণ থাকে খুবই সামান্য, খুব বেশি গুরুতর অবস্থায় যাওয়ার আগে কিডনির সমস্যার লক্ষণ প্রকাশ পায় না। কিন্তু যে কোনো সমস্যা শুরুতেই যদি শনাক্ত করা যায় তাহলে তা থেকে সেরে ওঠার উপায়ও সহজ হয়ে যায়।

কিডনির প্রধান কাজ হচ্ছে রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ, অতিরিক্ত পানি এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থ শোধন করা। এই টক্সিনগুলো প্রথমে মূত্রাশয়ে জমা হয়, যা পরে প্রস্রাব আকারে বের হয়। তাই শুরু থেকে সচেতন থাকতে কিডনির সাধারণ কিছু সমস্যা ও এর লক্ষণগুলো সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

কিডনি রোগের লক্ষণ

কিডনিতে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে, তবে কিডনির যেকোনো সমস্যার কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে।

ক্লান্তিবোধ

সারাদিন পরিশ্রম ও কাজের ফলে মানুষের শরীরে ক্লান্তি আসবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় কোনো কারণ ছাড়াই ক্লান্তি লাগছে, পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশ্রামসহ কোনো উপায়ে এ ক্লান্তি ভাব দূর করা যাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে তারা অনেক সময় কিডনির নানারকম টেস্ট দিয়ে থাকেন। কারণ কিডনিতে কোনো ধরনের সমস্যা হলে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয় এবং এ কারণেই মূলত ক্লান্তিবোধ হয়।

চুলকানি

কিডনিতে সমস্যা দেখা দিলে শরীর থেকে সঠিকভাবে ইউরিয়া বের হতে পারে না। ফলে তা ত্বকের নিচে জমা থাকে। এর ফলে ত্বকে চুলকানিসহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। প্রাথমিক অবস্থায় ত্বকের রঙ পরিবর্তন হয়ে গেলে ও চুলকানি হলে মানুষ চর্ম চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। চুলকানি নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গেলেও কিডনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। ত্বকের সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায় কিডনি বিকল এমন ঘটনাও কম নয়।

শরীরে ফোলাভাব

কিডনি রোগে আক্রান্ত হলে শরীর থেকে সহজে পানি বের হতে চায় না। ফলে চোখ, হাত, পা ইত্যাদি স্থান ফুলে যায়। অনেকের শরীরের ফোলা ভাব এলার্জির কারণে হয়। তবে এলার্জিজনিত কারণে কিংবা অন্যান্য কারণে শরীরের ফোলা ভাব দু সপ্তাহের বেশি কখনো স্থায়ী হয় না। কিন্তু কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ফলে শরীরের ফোলা ভাব অনেকদিন স্থায়ী থাকে। তাই দীর্ঘদিন ধরে শরীরের কোনো অংশ ফুলে থাকলে কিংবা যদি মনে হয় সে স্থানে পানি জমে আছে তাহলে এড়িয়ে না গিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় জরুরি।

প্রস্রাবের পরিবর্তন

কিডনিতে সমস্যা দেখা দিলে প্রস্রাবের পরিবর্তন একটি সাধারণ লক্ষণ। অনেক ক্ষেত্রে প্রস্রাবের রঙ পরিবর্তন এবং কখনো প্রস্রাবের সাথে রক্ত যেতে পারে। অনেক কিডনি রোগীদের প্রস্রাব করার সময় পেটে ব্যথা হয় কিংবা জ্বালাপোড়া হয়ে থাকে। কিডনিতে সমস্যা দেখা দিলে প্রস্রাবের সাথে শরীর থেকে অতিরিক্ত প্রোটিন বের হয়ে যায়। প্রস্রাবের মাধ্যমে প্রোটিন বের হওয়ার কারণে প্রস্রাবে ফেনাভাব দেখা দেয়। কিডনি রোগের ফলে কখনো প্রস্রাবের মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে যায় কখনোবা কমে যায়। বিশেষ করে রাতে প্রস্রাবের বেগ অতিরিক্ত থাকে। অনেক সময় প্রস্রাবের বেগ অনুভব হলেও প্রস্রাব হয় না। তাই এমন ধরনের সমস্যা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা

কিডনি রোগ হলে নিঃশ্বাসের সমস্যা হতে পারে। কিডনিতে সমস্যা হলে শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় পানি বের হতে পারে না। ফলে কিছু পানি জমা হয় ফুসফুসে। তখন হাঁপানির মতো শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। অনেকের শ্বাসকষ্টের জন্য রাতে ঘুম ভেঙে যায়। স্বাভাবিকভাবে রোগীরা প্রথম অবস্থায় ভাবে হাঁপানি সমস্যা হয়েছে, কিন্তু পরবর্তীতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অনেক সময় কিডনি রোগ শনাক্ত করা হয়।

পিঠ থেকে কোমর অবধি ব্যথা

বেশিরভাগ কিডনি রোগী যে সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যান তা হলো কোমরে ব্যথা। কিডনি রোগে আক্রান্ত হলে অনেক সময় মাংসপেশিতে টান লাগে। তখন পিঠ থেকে কোমর অবধি ব্যথা অনুভব হয়। ব্যথার পাশাপাশি বমি বমি ভাব কখনোবা বমি এবং খাবার রুচি কমে যায়।

কিডনি রোগের কারণ

যাদের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তাদের কিডনি রোগ হওয়ার সম্ভাবনা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। কিছু কিডনি রোগ বংশগত কারণেও হয়ে থাকে। বারবার প্রস্রাবে ইনফেকশন ও ডিহাইড্রেশনের কারণে কিডনিতে সমস্যা দেখা দেয়। কিডনির অনেক ধরনের সমস্যার মধ্যে কিডনিতে পাথর একটি কমন সমস্যা। বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন কিডনিতে পাথর নানা কারণে হলেও সবচেয়ে বেশি হয় পানি শূন্যতার জন্য। যারা নিজের দেহের চাহিদার থেকে কম পানি পান করে ও গরমের মধ্যে কাজ করে তাদের কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এছাড়া অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অধিক ওজন ও কিছু ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কারণেও কিডনিতে সমস্যা দেখা দেয়।

কিডনি ডায়ালাইসিস

ডায়ালাইসিস শব্দটির সাথে সবাই কমবেশি পরিচিত। কিডনি ডায়ালাইসিস তখন করা হয় যখন কিডনি বিকল হয়ে পড়ে। কিডনি নষ্ট হয়ে গেলে একজন রোগীকে প্রায় সারাজীবন ডায়ালাইসিস করাতে হয়। শরীরে জমে থাকা অতিরিক্ত পানি ডায়ালাইসিস যন্ত্রের মাধ্যমে বের করা হয়। ডায়ালাইসিসের অনেক ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে যেমন রোগী অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে, ঠিকমত খেতে পারে না ও বমি ভাব হয়। ডায়ালাইসিসের দুটি ভাগ রয়েছে হিমোডায়ালাইসিস ও পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস। আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত হিমোডায়ালাইসিস। ডায়ালাইসিস করা রোগীদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতে হয়। খাবার ও প্রতিদিনের কর্মকাণ্ডে বিশেষ সতর্ক থাকতে হয়। এ সময় কোন ধরনের খাবার তারা খেতে পারবেন তা পুষ্টিবিদ পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

কিডনি সুস্থ রাখার উপায়

কিডনি সুস্থ রাখার জন্য শরীরের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। অনেকে এমন পেশায় নিয়োজিত থাকেন যাতে শারীরিক পরিশ্রম বেশি করতে হবে। তাদের পানির চাহিদা অন্যান্য মানুষের তুলনায় বেশি। সেদিকে লক্ষ্য রেখে পানি পান করতে হবে। যারা অতিরিক্ত গরমের দেশে থাকে তাদের কিডনি রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই নিজের পেশা, দেশ ও আবহাওয়া সবকিছুর উপর নির্ভর করছে কতটুকু তরল শরীরের প্রয়োজন। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে ও মানসিক চাপমুক্ত থাকতে হবে। যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। তাই তাদের ক্ষেত্রে অবশ্যই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে কিডনি সঠিকভাবে কাজ করছে কি না। কিডনি রোগকে বলা হয় নীরব ঘাতক। কথা নেই বার্তা নেই ছোট যে কোনো লক্ষণ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে অনেকে দেখেন কিডনিতে সমস্যা হয়েছে। অনেকের এমন অবস্থায় কিডনি রোগ শনাক্ত হয় যখন করার আর কিছু থাকে না।

চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের ঔষধ সেবন করা যাবে না। অতিরিক্ত পেইনকিলার গ্রহণ করলে কিডনি রোগ হতে পারে। ৩৫ বছরের পর অবশ্যই কয়েক মাস পর পর অন্তত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা কিডনিতে কোনো ধরনের সমস্যা আছে কি না।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্বাস্থ্য কথা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

sixteen − twelve =