চুম্বকের আদ্যোপান্ত

বাচ্চাদের খেলনা গাড়িই হোক বা গান বাজানো কিংবা পথ হারানো পথিকের সাথি কম্পাস হোক; সবক্ষেত্রে চুম্বক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। চুম্বক কে আবিষ্কার করেছিলেন সে সম্পর্কে অনেক গল্প রয়েছে। প্রাচীন গ্রিক গল্প অনুসারে, গ্রিসের ম্যাগনেসিয়ায় বসবাসকারী ম্যাগনেস নামে এক রাখাল চুম্বক আবিষ্কার করেছিলেন। তবে কিছু ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে ম্যাগনেট-এর নামকরণ গ্রিসের ম্যাগনেশিয়ার নাম থেকে করা হয়েছিল, যেখানে এই পাথরটি প্রথম পাওয়া গিয়েছিল। লোডস্টোন একটি প্রাকৃতিক চৌম্বকীয় খনিজ ম্যাগনেটাইট। এটা প্রকৃতিতে প্রাপ্ত চুম্বক এবং লোহাকে আকর্ষণ করতে পারে। বস্তুর চুম্বকত্ব ধর্ম প্রথম আবিষ্কার হয়েছিল প্রাচীনকালে লোডস্টোনের মাধ্যমে। ঝুলন্ত লোডস্টোনের টুকরো পৃথিবীর প্রথম কম্পাস এবং দিকনির্ণয়ের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব থেকে লোডস্টোন নামটি এসেছে। এটি সেই সব খনিজ উপাদানের মধ্যে একটি যা প্রকৃতিতে খুব কম পাওয়া যায়।

৪ হাজার বছর আগের কথা। ম্যাগনেস নামে এক রাখাল ছিল দক্ষিণ গ্রিসে। মাঝে মাঝেই সে ভেড়া চরাতে যেত মাঠে। পাথুরে পাহাড়ি মাঠ। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অজস্র পাথর। একদিন সে একটা ভেড়া হারিয়ে ফেলে। খুঁজে খুঁজে হয়রান। কোথাও পায় না। অবশেষে ভেড়ার খোঁজে পাহাড়ে ওঠে ম্যাগনেস। হঠাৎ একটা কালো পাথরে তার পা আটকে যায়। অবাক হয় ম্যাগনেস। কিসে আটকালো ভেবে পায় না। বোঝার চেষ্টা করে। এক সময় সে আবিষ্কার করে কালো পাথরের সাথেই তার জুতা আটকে গেছে। অদ্ভুত ব্যাপার! ম্যাগনেসের জুতার নিচে পেরেক জাতীয় কিছু ছিল, যাতে পাহাড়ে উঠতে গিয়ে পিছলে না যায়। ম্যাগনেস বুঝতে পারে লোহার পেরেককে টেনে ধরেছে কালো পাথর। অপ্রাত্যাশিতভাবেই আবিষ্কার হয়ে যায় চুম্বক পাথরের। ম্যাগনেসের নাম থেকেই ওই পাথরের নামকরণ করা হয় ম্যাগনেট।

১৬০০ সাল ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম গিলবার্ট প্রথম কৃত্রিম চুম্বক আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি প্রমাণও করেছিলেন যে পৃথিবী নিজেই একটি বড় চুম্বক। উইলিয়াম গিলবার্ট দেখতে পেলেন যে লোহাকে চুম্বকে পরিবর্তিত করা যেতে পারে। চুম্বকত্ব নিয়ে প্রথম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কাজ শুরু করেন উইলিয়াম গিলবার্ট। উইলিয়াম গিলবার্ট ছিলেন রেঁনেসা পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একজন। রানি এলিজাবেথের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন তিনি, ছিলেন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির একনিষ্ঠ ভক্ত। তাকে পৃথিবীর প্রথম পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানীও বলা চলে। পিসার হেলানো দেয়ালে গ্যালিলিওর সেই বিখ্যাত পরীক্ষার পূর্বেই, আদর্শ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে তিনি বিদ্যুৎ ও চুম্বক নিয়ে কাজ করেন।

‘বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি’ শব্দযুগল এতো জোর দিয়ে বলার কারণ হচ্ছে তখনো আদর্শ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি তেমন প্রতিষ্ঠিত কিছু ছিল না। আজকে আমরা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার আদর্শ হিসেবে যা দেখি এটি রেঁনেসা পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ পদ্ধতি অনুসারে পৃথিবীর যেকোনো অজানা বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে গবেষকদের একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এগোতে হয়। প্রথমে তারা প্রাকৃতিক কোনো ঘটনাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং কোনো একটি প্যাটার্ন খুঁজে বের করেন। এরপর এটিকে ব্যাখ্যা করার জন্য একটি অনুমানমূলক মডেল দাঁড় করান। এরপর হাতে-কলমে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখেন যে, এ মডেল কতটা অকাট্য। গিলবার্ট তার কাজের ক্ষেত্রে এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেন। চুম্বকত্বের প্রতি তার আগ্রহ জন্মে কম্পাস দেখে। মানুষ তখন চুম্বক সম্পর্কে বিস্তারিত না জানলেও, এর মাধ্যমে দিক নির্ধারণ করতে শিখে গিয়েছিল। তৈরি করেছিল দিক নির্ণায়ক যন্ত্র কম্পাস। সেটি দেখেই গিলবার্টের আগ্রহ জাগে চুম্বক নিয়ে। এরপর এক দশকের পরিশ্রম ও নিজের সম্পদের একটি বড় অংশ ব্যয় করে গবেষণা করার পর, গিলবার্ট চুম্বক বিষয়ে তার সিদ্ধান্তে আসেন।

১৬০০ সালের দিকে তিনি প্রকাশ করেন তার বিশালাকার ৬ ভলিউমের বই ‘ডি ম্যাগনেট’ বা ‘অ্যাবাউট দ্য ম্যাগনেট’। তার সকল পরীক্ষার ফলাফল ও অনুমান এতে লিপিবদ্ধ ছিল। এ বিশাল গবেষণা থেকে তিনি নিচের উপসংহারগুলো টানেন, বিদ্যুৎ ও চুম্বকত্ব সম্পূর্ণ পৃথক দুটি বিষয়। চুম্বকের ধনাত্মক ও ঋণাত্বক মেরুকে আলাদা করা সম্ভব নয়। পানিতে বৈদ্যুতিক আদানের আকর্ষণ-বিকর্ষণ বল বিনষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু চুম্বকের বল নষ্ট হয় না। উচ্চ তাপে চুম্বকীয় বল বিলুপ্ত হয়। এছাড়া পৃথিবীর চুম্বকত্ব নিয়ে তার হাইপোথিসিসও জানিয়েছিলেন তিনি। তখন সেটি তিনি প্রমাণ না করতে পারলেও, পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করতে সক্ষম হন। উইলিয়াম গিলবার্ট তার ‘ডি ম্যাগনেট’ শিরোনামের বইয়ে কীভাবে ইস্পাত থেকে কৃত্রিমভাবে চৌম্বক তৈরি করবেন তা উল্লেখ করেছিলেন।

১৮২০ সালে হান্স ক্রিশ্চিয়ান ওরস্টেড তড়িৎ চুম্বকত্বের আবিষ্কারক। হান্স ক্রিশ্চিয়ান ওরস্টেড ছিলেন ড্যানিশ পদার্থবিজ্ঞানী এবং রসায়নবিদ যিনি আবিষ্কার করেছিলেন যে, তড়িৎ প্রবাহ চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে যা তড়িচ্চুম্বকত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তিনি বিদ্যুৎ এবং চৌম্বকবাদের মধ্যে সম্পর্ক এবং বৈদ্যুতিক চৌম্বকত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি একটি প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলেন যে কোনও চুম্বকের কম্পাসটি যদি বৈদ্যুতিক তারের কাছে স্থাপন করা হয় তবে সেই চুম্বকটির কম্পাসের সুঁই বৈদ্যুতিক চৌম্বকীয় শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সঠিক দিকটি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয় না।

আকর্ষণ শক্তির মাধ্যমে চুম্বক লোহা, কোবাল্ট এবং নিকেলের মতো লোহার পদার্থকে আকর্ষণ করে। যার ফলে লোহাকে যেকোনো প্রকার মিশ্রণ থেকে পৃথক করা যায়। চুম্বকের যেহেতু আকর্ষণ শক্তি রয়েছে অন্যদিকে বিকর্ষণ শক্তিও বিদ্যমান যেমন দুটি চুম্বক একে অপরকে বিকর্ষণ করে এবং দুটি চুম্বকের বিপরীত মেরু একে অপরকে আকর্ষণ করে। চুম্বকের চৌম্বক বল সবচেয়ে বেশি থাকে তার মেরুতে। এছাড়াও দুর্গম জায়গায় সঠিক দিকনির্দেশনা পেতে কোনও চুম্বককে যদি বাতাসে বাধাহীন অবস্থায় ঝুলানো যায় তবে এটি সর্বদা উত্তর-দক্ষিণের দিকে নির্দেশ করবে।

চুম্বকের ব্যবহার দেখা যায় নানা কাজে। চুম্বক এবং এর বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার আমাদের জীবনে অনেক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। টিভি, কম্পিউটার, সামুদ্রিক পরিবহন, চৌম্বকীয় অনুরণন, ইমেজিং মেশিন, ক্রেডিট এবং ডেবিট কার্ড, স্পিকার এবং মাইক্রোফোনস, ক্রেনস, বৈদ্যুতিক মোটর এবং জেনারেটর ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদিনের ব্যবহারের আইটেমগুলিতে চুম্বক ব্যবহৃত হয়। চুম্বক এখন ম্যাগলেভ ট্রেন চালানোর জন্যও ব্যবহৃত হয়।

স্থায়িত্বের ওপর নির্ভর করে চুম্বক দুই ধরনের, স্থায়ী চুম্বক এবং অস্থায়ী চুম্বক। স্থায়ী চুম্বক বলতে বোঝানো হয় যে সকল চুম্বক বেশিদিন স্থায়ী হয়। যেমন দণ্ড চুম্বক, অশ্বখুরাকৃতি চুম্বক, চুম্বক শলাকা ইত্যাদি। অন্যদিকে যে চুম্বকগুলোর স্থায়িত্ব বেশিদিনের জন্য হয় না তাকে অস্থায়ী চুম্বক বলে। যেমন কাঁচা লোহার দণ্ডকে ঘর্ষণ প্রণালীতে চুম্বকে পরিণত করা হলে তা বেশ শক্তিশালী চুম্বকে পরিণত হয়, কিন্তু ওই চুম্বকের চুম্বকত্ব বেশি দিন স্থায়ী হয় না। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী চুম্বক হলো নিওডিমিয়াম চুম্বক। ১৯৮৫ সালে এই চুম্বকটি আবিষ্কার হয়। বর্তমানে এই চুম্বকটির গুরুত্ব অপরিসীম। কম্পিউটারের হার্ড ড্রাইভ থেকে শুরু করে, স্পিকার, বৈদ্যুতিক মোটর, উইন্ড টারবাইন ইত্যাদিতে এটি ব্যবহার করা হয়।

পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে প্রাকৃতিক চুম্বক পাওয়া যায় স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলে। এছাড়াও পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে যেমন সার্বিয়া, ভারতের কাসার দেবী মন্দির, উত্তরাখান্ড, পেরুর মাচু পিচু, যুক্তরাজ্যের স্টোনহেঞ্জ এমন বেশকিছু অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে চুম্বকীয় ক্ষেত্র দেখা যায়। চুম্বকের অস্তিত্ব শুধু যে পৃথিবীতেই আছে তা কিন্তু নয়। মহাকাশে রয়েছে ম্যাগনেটার নামের একটি তারা। তবে দুঃখের বিষয় সেটি সুপারনোভা বিষ্ফোরণের ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলেন এর চুম্বকত্ব এতো বেশি যে, পৃথিবীর মতো দু-তিনটি গ্রহ এর কাছ দিয়ে গেলে তা এদের গ্রাস করতে সক্ষম।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আবিষ্কার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

2 × three =