প্যারাসুট কিভাবে আসলো

গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত

আবিষ্কারের গল্প জানানোর আগে একটা সত্য গল্প জানাই। আপনি নিশ্চয়ই বেয়ার গ্রিলসকে চিনেন। ব্রিটিশ অভিযাত্রী এবং টিভি ব্যক্তিত্ব। ডিসকভারি ওয়ার্ল্ড চ্যানেলে ‘ম্যান ভার্সাস ওয়াইল্ড’ টিভি শো’র কল্যানে দুনিয়াব্যাপী পরিচিতি নাম বেয়ার গ্রিলস। সারা দুনিয়ার অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষদের কাছে স্বপ্নের নায়ক তিনি। ১৯৯৬ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে তার জীবন থমকে যেতে পারত। তিনি সে বছর আর্মিতে থাকাকালীন সময়ে জাম্বিয়ার মরু অঞ্চলে এক অনুশীলনে ষোল হাজার ফুট উচ্চতা থেকে প্যারাসুট নিয়ে ঝাঁপ দেন। কিন্তু প্যারাসুট ঠিক মতো না খোলায় মরুভূমিতে আছড়ে পড়েন। তার মেরুদণ্ডের তিনটি কশেরুকা ভেঙে যায়। তার চিকিৎসকরাও ভাবেননি বেয়ার গ্রিলস কোনদিন স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারবেন; রোমাঞ্চের সন্ধানে সারা দুনিয়া চষে বেড়ান তো বহু দূরের কথা। সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে দুর্ঘটনার মাত্র দেড় বছরের মাথায় জয় করেন আজন্ম লালিত স্বপ্ন এভারেস্টের চূড়া। কল্পনা করুন, একটা প্যারাসুটের জন্য কতটা বদলে যেতে পারতো বর্তমান সময়ের অ্যাডভেঞ্চার আইকন বেয়ার গ্রিলসের জীবন। এবারের আয়োজনে আমরা জানাবো প্যারাসুট আবিষ্কারের কথা।

পাখির মতো মুক্ত আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়ানোর ইচ্ছেটা মানুষের বহুকাল আগে থেকে। মানুষ নিজের ইচ্ছে পূরণের জন্য অজস্র কিছু আবিষ্কার করেছে। আকাশে পাখির মতো উড়ে বেড়ানোর জন্য উদ্ভাবন করেছে বহুকিছু। বহু চেষ্টার ফল হিসেবেই আবিষ্কৃত হয় প্যারাসুট। প্যারাসুট হলো ছাতার মতো একটি বস্তু। আকারে ছাতার চেয়ে বেশ বড়। ফেঞ্চ শব্দ ‘প্যারাসিট’ থেকে ‘প্যারাস্যুট’ শব্দটি এসেছে। ১৭৮৫ সালে লুইস সেবাস্তিয়েন ‘প্যারাস্যুট’ শব্দটি প্রথমবারের মতো ব্যবহার করেন। ফরাসি শব্দ ‘প্যারা’, যার অর্থ প্রতিরক্ষা এবং ‘স্যুট’, যার অর্থ পতন; শব্দ দুটিকে একসাথে করে ব্যবহার করেন। এর শাব্দিক অর্থ, পতনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা।

বিমান কিংবা উঁচু কোনো স্থান থেকে মানুষ যখন প্যারাসুটসহ লাফ দেয় তখন এর চাঁদোয়া খুলে ছাতার মতো আকৃতি লাভ করে। ফলে বাতাস আরোহীর নিম্নগতিকে কমিয়ে দেয়। বায়ুর বাধা কাজে লাগিয়ে স্কাই ডাইভারের অভিকর্ষজ ত্বরণ কমিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে মানুষকে নিচের দিকে নামানোটাই প্যারাসুটের মূল কাজ। প্যারাস্যুট একজন স্কাই ডাইভারের গতি কমিয়ে সেটাকে অবতরণের মুহূর্তে সেকেন্ডে ৫ থেকে ৬ মিটার বা ঘণ্টায় ১২ মাইল করে দেয়; যাতে করে মাটিতে পা ছোঁয়ানোর সাথে সাথেই তিনি স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে বা কিছুটা দৌড়াতে পারেন। প্যারাস্যুটকে সাধারণত বাতাসেই বস্তুর গতি ৭৫ শতাংশ কমিয়ে আনতে হয়। সাধারণভাবে প্যারাসুট রেশম অথবা নাইলন দিয়ে তৈরি হয়। নাইলনের তৈরি চাঁদোয়াবিশেষ এ বস্তুটি খোলা অবস্থায় ৭ থেকে ৯ মিটার প্রশস্ত হয়। বিমান কিংবা উঁচু কোনো স্থান থেকে নির্বিঘ্নে নিচের দিকে নেমে আসার জন্য প্যারাসুট বেশ কার্যকরী।

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন প্যারাসুট তৈরির চিন্তাভাবনার নিদর্শন পাওয়া যায় রেঁনেসা যুগে। প্যারাসুটের সবচেয়ে প্রাচীন নকশা পাওয়া যায় ১৪৭০ সালের রেঁনেসা যুগের ইতালি থেকে প্রাপ্ত একটি হস্তলিপিতে। সেই নকশাতে দেখা যায়, একজন মানুষ একটি কোনক আকৃতির যন্ত্রের সাহায্যে ঝুলে পতনের গতি কমাবার চেষ্টা করছে। এর উন্নততর নকশা পাওয়া যায় আরেকটি ছবিতে, যাতে দেখা যায় যে একজন মানুষ দুটি লাঠির সাহায্যে কাপড় বেঁধে বাতাসের বাধার সাহায্যে পতনের গতি কমানোর চেষ্টা করছে। যদিও সেই প্যারাস্যুটের সারফেস বাতাসে বাধার সৃষ্টি করে তার ভরের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত গতি কমাতে পারার মতো অত বড় ছিল না। তবুও এই ছবিটি বলে দেয়, তৎকালীন এই উন্নতিই প্যারাসুট উন্নয়নে অবদান রেখেছিল।

প্যারাসুট আবিষ্কার ঠিক কবে হয়েছিল তা নিয়ে একক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। অনেকেই মনে করেন, নবম শতকে আল আন্দালুস এবং আবাবাস ইবনে ফার্নাস নামে দুজন ব্যক্তির কাছ থেকে প্রথমবারের মতো প্যারাসুট জাতীয় একটি বস্তু উদ্ভাবনের ধারণা পাওয়া গিয়েছিল। ১৪৮৫ সালে বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি পিরামিড আকৃতির একটি প্যারাসুটের ছবি আঁকেন। যা রয়েছে তার ‘কোডেক্স অ্যাটল্যান্টিকাস’ নামক বইয়ে। যদিও সে সময় ভিঞ্চির আঁকা এই প্যারাসুটের বাস্তবসম্মত কোনো পরীক্ষা করা হয়নি। তবে ব্যবহারিক পর্যায়ে দ্বাদশ শতকে চীনে ছাতা আকৃতির এক ধরনের প্যারাসুটসদৃশ্য বস্তুর অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়। মূলত শিশুদের আনন্দ দেওয়ার জন্যই সে সময় খেলনাসদৃশ এই প্যারাসুটগুলো ব্যবহার করা হতো।

পরবর্তীকালে ১৬১৭ সালে ক্রোয়েশিয়ার ফাউস্ট ভ্রানিয়েইস নিজের তৈরি প্যারাস্যুট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন ভেনিসের এক উঁচু টাওয়ার থেকে। তার এই পরীক্ষা সঠিকভাবে কাজ না করলেও প্রবল বায়ুপ্রবাহের কারণে বড় কোনো দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়নি তাকে। ১৭৮৩ সালে আধুনিক ব্যবহারযোগ্য প্যারাসুট উদ্ভাবন করেন ফ্রান্সের লুইস-সেবাস্টিয়েন লিনোরম্যান্ড। তিনি তার আবিষ্কৃত প্যারাসুটের সাহায্যে একটি উঁচু গাছ থেকে লাফ দিয়ে ভূমিতে নেমে আসার জন্য বেশ কিছু পরীক্ষা চালান। এর ঠিক দুই বছর পর ১৭৮৫ সালে ফ্রান্সের জ্যঁ-পিয়েরো ব্ল্যানচার্ড সিল্কের কাপড় এবং নমনীয় কাঠামো ব্যবহার করে নতুন ধরনের একটি প্যারাসুটের পরীক্ষা চালান। এ সময় ব্ল্যানচার্ডের তৈরি প্যারাসুট দিয়ে মোটামুটি নির্বিঘ্নেই বেশ খানিকটা উঁচু থেকে নিরাপদে মাটিতে নেমে আসা সম্ভব ছিল।

১৮৭৩ সালে লুইস সেবাস্তিয়ান সফলভাবে প্রথম ব্যবহারযোগ্য প্যারাস্যুট তৈরি করেন। তার দুই বছর পর ১৮৭৫ সালে জিয়েন ব্লানচার্ড একটি কুকুরকে বাক্সবন্দি করে সফলভাবে প্যারাস্যুটের প্রথম ব্যবহার করেন বলে জানা যায়। সত্যিকার অর্থে প্যারাসুটকে একটি কার্যকরী উদ্ভাবনের পর্যায়ে নিয়ে আসা এবং প্যারাসুট নিয়ে গবেষণার সূত্রপাত হয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। এরপর থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্নভাবে বিবর্তিত হয়ে প্যারাস্যুট আজকের আধুনিক রূপে এসেছে। ১৯১১ সালে প্যারাসুটের আরো কিছু উন্নয়ন সাধন করে এটিকে আরো উঁচুতে নিয়ে যাওয়া এবং বিমান থেকে প্যারাসুটের সাহায্যে প্রথমবারের মতো লাফিয়ে পড়ার কীর্তি স্থাপন করেন গ্রান্ট মর্টন। তিনি প্যারাসুটের সাহায্যে বিমান থেকে লাফিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার ভেনিস শহরে নামেন।

প্যারাস্যুট জাম্পিং

বলা হয়ে থাকে, ১৭৯৭ সালের ২২ অক্টোবর প্রথম প্যারাস্যুট জাম্প করেছিল কোনো মানুষ। সেখান থেকে এখন অব্দি প্যারাস্যুট জাম্প করেছে অসংখ্য মানুষ। ১৯০৬ সালে চার্লস ব্রডউইক প্যারাস্যুট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আধুনিক প্যারাস্যুটের উন্নতি মানুষের দৃষ্টিতে আনেন। প্যারাস্যুট নিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে ১৯১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মারা যান ফ্রেঞ্জ রেইচেল্ট নামের একজন। ২০১২ সালের ১৪ অক্টোবর, ফেলিক্স বমগার্টনার লাফিয়েছেন মহাশূন্য থেকে। প্যারা জাম্পিংয়ে এখন বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, নিত্যনতুন রেকর্ড গড়তে ব্যস্ত বহু স্কাই ডাইভার; নিরাপত্তার কাজে ব্যবহার তো আছেই।

প্যারাস্যুট প্যাকিং

প্যারাস্যুটকে কনটেইনারে প্যাক করতে প্রয়োজন হয় বিশেষ সার্টিফিকেটের। স্কাই ডাইভারের নিরাপত্তার স্বার্থে রিজার্ভ প্যারাসুট প্যাকিং বেশ জটিল প্রক্রিয়ায় করা হয়ে থাকে। রিজার্ভ প্যারাসুট প্যাক করতে পারে শুধু এফএএ সার্টিফিকেট প্রাপ্তরা। এ সার্টিফিকেট পেতে হলে একজন আগ্রহীকে কমপক্ষে ১৮ বছর বয়সী হতে হবে, সেইসাথে ভালো দক্ষতা থাকতে হবে ইংরেজিতে। ২০টি রিজার্ভ প্যারাসুট সফলভাবে প্যাক করতে পারলেই কেবল মিলবে এফএএ সার্টিফিকেট। স্কাই ভাইডিংয়ের লাইসেন্স পেতে হলে আগে প্যারাসুট প্যাকিংয়ের সার্টিফিকেট অর্জন করতে হয়। প্যাকিংয়ে সাধারণত ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মতো সময় প্রয়োজন হয়ে থাকে।

স্কাই ডাইভিং

স্কাই ডাইভিং একটি এডভেঞ্চারাস গেম, যেখানে একজনকে হেলিকপ্টার থেকে লাফ দিতে হয় এবং উচ্চতা কমে গেলে প্যারাসুটের সাহায্যে অবতরণ করতে হয়। স্কাই ডাইভিংয়ের শুরুটা বহু পুরনো। ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে। ফ্রান্সে হট এয়ার বেলুন থেকে ঝাঁপ দিয়ে হয়েছিল শুরুটা। এখন অবশ্য তেমনটা হয় না। বিমান বা উঁচু কোনও জায়গা থেকে ঝাঁপ দেন স্কাই ডাইভার। বর্তমানে স্কাই ডাইভিং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সাধারণত তিন ধরনের স্কাই ডাইভিং কৌশল রয়েছে। প্রথমটা হচ্ছে, ট্যান্ডেম জাম্প যা তুলনামূলক সহজ পদ্ধতি। একজন প্রশিক্ষকের সঙ্গে বাঁধা থাকবেন আপনি। একটাই প্যারাসুট থাকবে। তার দড়ি থাকবে প্রশিক্ষকের হাতে। দ্বিতীয়টা হচ্ছে, স্ট্যাটিক লাইন জাম্প যেখানে বিমানের সঙ্গে একটি শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকবেন আপনি। বিমান থেকে লাফ দেওয়ার নির্দিষ্ট সময় পরে প্যারাসুট খুলবে নিজে থেকেই। এই ধরনের লাফে বেশ কিছু সতর্কতা রয়েছে। তৃতীয়টা হচ্ছে, অ্যাক্সেলারেটেড ফ্রি ফিল যা দুর্বলচিত্তের মানুষের জন্য নয়। এটি বেশ কঠিন প্রক্রিয়া। সঙ্গে কেউ থাকবে না। বিমানের সঙ্গে দড়িও বাঁধা থাকবে না। খুব ভালো প্রশিক্ষণ ছাড়া এমনটা করা বেশ বিপজ্জনক। দক্ষ স্কাই ডাইভিং করেন যারা তারা এটা করার দুঃসাহস দেখান। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্কাই ডাইভিংয়ের বেশকিছু প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে।

বিমানে কেন প্যারাসুট থাকে না

আপনি কি জানেন বিমানে কোনো প্যারাসুটের ব্যবস্থা নেই। প্যারাসুট অনেক বড়, ভারী এবং ব্যয়বহুল। বড় হওয়ায় সিটের নিচে প্যারাসুট বসানো যায় না। রাখতে অনেক জায়গা লাগে। এছাড়া ওজনও অনেক বেশি, যার কারণে প্লেনের ওজন বেড়ে যায়। প্যারাসুট দৈনিক চেকিং এবং রিপ্যাকিং প্রয়োজন। যদি বাণিজ্যিক বিমানে সবাইকে প্যারাসুট সরবরাহ করা হয়, তবে বিমান যাত্রা অনেক ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে। দ্বিতীয় কারণ হলো, প্যারাসুট ব্যবহার করা বিষয়ে যাত্রীদের কোনো জ্ঞান নেই। প্যারাসুট প্রশিক্ষণ ছাড়া, অনেক যাত্রী নিরাপদে অবতরণ করতে সক্ষম হবে না। মাটিতে নামার পরও প্যারাসুট সামলানো খুবই কঠিন। সাধারণ পরিস্থিতিতে প্যারাসুট পরিচালনা করা কঠিন। কল্পনা করুন বিমানে জরুরি অবস্থা হলে যাত্রীরা কীভাবে এটি ব্যবহার করতে সক্ষম হবে। এছাড়া বিমান থেকে লাফ দেওয়ার জন্য সুবিধাজনক জায়গা নেই। এজন্য বিমানটিকে নতুনভাবে ডিজাইন করতে হবে। সাধারণ বিমানে বাইরে বেরোনোর জন্য পাশে দরজা থাকে, এই দরজাগুলো থেকে লাফ দিলে প্লেনের ডানা বা লেজে আঘাত করবে। এজন্য বিমানের পেছনে কেবিনে র‌্যাম্প তৈরি করতে হবে। এমন পরিস্থিতি খুব কমই থাকবে যেখানে প্যারাসুট কারো জীবন বাঁচাতে পারে। এজন্য দিনের আলো ও প্লেনটি বেশ উঁচুতে থাকতে হবে। এছাড়া সবার জন্য লাফ দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময়ও থাকতে হবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আবিস্কার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

2 × three =