ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড ‘গুচি’

নীলাঞ্জনা নীলা

বিশ্বব্যাপী ধনীদের ব্র্যান্ড বলে পরিচিত এটি। আর হবেই না বা কেন। এর এক একটি পণ্য দাম সবার ধরা ছোঁয়ার মধ্যে না। তবে ফ্যাশন সচেতন যে কারো নিজের কালেকশনে গুচি’র পণ্য রাখা এক প্রকার স্বপ্ন। তবে এই সাফল্য পেছনের গল্প অজানা অনেকের কাছে।

এই ব্র্যান্ডটি প্রথম শুরু করেছিল একজন লিফটম্যান, যার নাম ছিল গুচি। যিনি একটি হোটেলে লিফটম্যান এবং পোর্টার হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু কিভাবে কিশোর বয়সে বেড়ে উঠেন কিংবা হোটেলের কাজে যুক্ত হন তা নিয়ে খুব একটা বিস্তারিত তথ্য জানা যায় না। তবে জানা গিয়েছে কিছুদিন হোটেলে কাজ করার পর একটি ফ্যাশন কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। এখানে আগত অতিথিদের ফ্যাশন সেন্স দেখে তিনি খুবই মুগ্ধ হন। এর পর তিনি তার ফ্যাশন লেবেল আনার কথা ভাবলেন। একটি ফ্যাশন কোম্পানিতে কাজ করার সুবাদে তিনি ফ্যাশন সম্পর্কিত অনেক কিছু জেনেছিলেন।

ইতালির ফ্লোরেন্সে ১৯২১ সালে তিনি প্রথম গুচি ব্র্যান্ড চালু করেন। ইতালি থেকে এর কাজ শুরু হলেও গুচি লন্ডনের ফ্যাশন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাদের সব ডিজাইন করে থাকে। গুচির প্রতিষ্ঠাতা হয়ে উঠেন ইতালির নামকরা ডিজাইনার। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পৈতৃক সূত্রে গুচির মালিকানা পান গুচিও গুচির নাতি মরিৎসিও গুচি। আজকের গুচির জনপ্রিয়তার জন্য মরিৎসিও গুচি অনেক ভূমিকা রয়েছে। ১৯৯৩ সালে তিনি বাহরাইনভিত্তিক বিকল্প বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টকর্পের সঙ্গে তখনকার সময়ের ১৭ কোটি ডলারের একটি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর দেড় বছর পর ১৯৯৫ সালে তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। বর্তমানে গুচির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্কো বিজারি ও ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর আলেসান্দ্রো মিশেল। তারাই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন গুচিকে। গুচি’র পেছনে রয়েছে অনেক ক্রিয়েটিভ ব্যাক্তিরা যারা নিজেদের মেধা ও শ্রম দিয়ে গুচি’র মান ধরে রাখছে।

গুচিও গুচি’র তার ব্যবসাকে এতো বড় কিংবা জনপ্রিয় করার পরিকল্পনা ছিল না। বরং তিনি সবসময় নিজের ব্যবসাকে ছোট পরিসরেই রাখতে চেয়েছিলেন। যতদিন গুচি বেঁচেছিলেন ব্র্যান্ডটি শুধু ইতালির মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। ১৯৫১ সালে গুচি মিলান শহরে তাদের তৃতীয় দোকান খুলেন। কিন্তু তার বড় ছেলে আলডো সবসময় চেয়েছিলেন গুচিকে আন্তর্জাতিক পাওয়ার হাউজে রূপ দিতে। সেই উদ্যোগেই আলডো সবসময় কাজ করে গিয়েছেন। ১৯৫৩ সালে আলডো নিউ ইয়র্কে তাদের দোকান খুলেন, এই দোকান শুরু হবার ঠিক দুই সপ্তাহ পর গুচি মারা যান।

পরে আলডো ইউরোপসহ বেশ কিছু দেশে নিজের ব্র্যান্ডের শোরুম খুলেছেন। গুচি মারা যাবার পর ব্যবসার দায়িত্ব তার ছেলেরা তুলে নেন, সবাই দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার পর সবাই গুচিকে নিয়ে নতুন করে ভেবেছেন। কিভাবে গুচির মান আরো ভালো করা যায়, আরো ভিন্নতা আনা যায় তা নিয়ে তাদের ভাবনা। তাদের ভাবনা কিন্তু কখনো বিফলে যায়নি, যত দিন গড়িয়েছে গুচির সাফল্য সবার চোখে পড়েছে। এক সময় এক ব্যক্তির শুরু করা ব্যবসা পারিবারিক ব্যবসায় রুপ ধারণ করেছে। এই পারিবারিক ব্যবসা নিয়েও কিন্তু রয়েছে অনেক আলোচনা সমালোচনা। গুচির ছিল পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে। তিনি মারা যাবার আগে গুচি’র বিভিন্ন পদে তার ছেলেদের দায়িত্ব দিয়ে যান কিন্তু মেয়েকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। ক্ষমতায় থাকার জন্য পরিবারের মধ্যে চলে অনেক রকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

গুচি তৎকালীন চিফ ডিজাইনার ছিলেন পাওলো গুচি। তার স্ত্রী ছিলেন জেনি গুচি। তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হবার পর জেনি একটি বই লেখেন যার নাম ‘গুচি ওয়ারস: হাউ আই সার্ভাইভড মার্ডার অ্যান্ড ইন্ট্রিগ অ্যাট দ্য হার্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ডস বিগেস্ট ফ্যাশন হাউজ’। এই বইতে তিনি গুচি পরিবারের ব্যবসার সাফল্যর গল্প, পাওলোর সাথে বিয়ের গল্প, অবিশ্বাস, বিলাসবহুল জীবনযাত্রা, বিশ্বভ্রমণ, অবশেষে বিবাহ বিচ্ছেদ এবং গুচি পরিবারের বিভিন্ন অজানা ও অবিশ্বাস্য কাহিনী তুলে ধরেন। এই বইটি ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয়, বইয়ের মাধ্যমে তিনি গুচি পরিবারের সব তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। যার মধ্যে দিয়ে পাঠকরা জানতে পেরেছিল একটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের পেছনে কত গল্প থাকতে পারে।

ইউরোপের ফ্যাশন সেন্স ও স্টাইলিং সব সময় খুব জনপ্রিয়। তবে তা আরো জনপ্রিয়তা পেয়েছে গুচি‘র হাত ধরেই। তাই তো ইউরোপকে ফ্যাশন আইকন হিসেবে মানা হয়। গুচি ব্র্যান্ডে হাতব্যাগ, তৈরি পোশাক, জুতা, ঘড়ি, মেকআপ পণ্য ও সুগন্ধিসহ ফ্যাশনের সাথে জড়িত সব কিছুই পাওয়া যায়। ১০০ বছরে (২০২০ সাল শেষে) গুচি কোম্পানির ব্র্যান্ড ভ্যালু দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

গুচি বরাবরই বৈচিত্র্যর দিকে লক্ষ্য রেখেছে। যা তাদের পণ্যকে করেছে অন্যান্য সব ব্র্যান্ড থেকে আলাদা। অনেকে মনে করেন, গুচির পণ্যে যে জিজি লোগোটি রয়েছে তা হয়তো গুচি নিজে ডিজাইন করেছেন। আসলে তা নয়, এটি তার মৃত্যুর পর তাকে সম্মান জানানোর জন্য ডিজাইন করা হয়। ১৯৪০ সালে যখন ফ্যাসিবাদী শাসক ছিল তখন চামড়াজাত পণ্য পাওয়া কঠিন হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় গুচি রেশম পণ্য নিয়ে কাজ শুরু করে।

যাত্রা শুরুর কয়েক দশকে এটি একটি জেনেরিক ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত পায়। কিন্তু স্বীকৃতি পায় ১৯৫৩ সাল থেকে। সেই বছর এলিজাবেথ টেলরের একটি ছবি লাইম লাইটে এসেছিল, সেখানে তাকে দেখা যায় বাঁশের তৈরি একটি ব্যাগ ধরে থাকতে। এরপর ১৯৬১ সালে আমেরিকার ফার্স্ট লেডি জ্যাকলিন কেনেডিকেও একটি গুচি ব্যাগ বহন করতে দেখা যায়। এরপর প্রতিষ্ঠানটি সেই ব্যাগের নাম পরিবর্তন করে রাখে ‘দ্য জ্যাকি’। ধীরে ধীরে নামী সেলিব্রেটিরা এই ব্র্যান্ডের সাথে যুক্ত হতে শুরু করে। ১৯৮১ সালে গুচি প্রথম পরিধানের জন্য রেডি টু ওয়্যার ফ্যাশন শো’য়ের আয়োজন করেছিল। সেইবারের কালেকশনটি ছিল ‘ফ্লোরা’ প্যাটার্নের উপর। যা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফ্যাশন শো’টি ইতালির ফ্লোরেন্সের সালা বিয়ানকা, পালাজো পিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

গুচি’র ব্যবসায় আসল পরিবর্তনটি আসে ১৯৯০ সালে, যখন টম ফোর্ড নামে একজন প্রতিভাবান তরুণ ডিজাইনার কোম্পানিতে আসেন। প্রাথমিকভাবে, তিনি গুচির রেডি টু ওয়্যার কালেকশনের তত্ত্বাবধান করছিলেন। কিন্তু ১৯৯৪ সালে ফ্যাশন হাউসের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োজিত হন। গুচির ‘জিনিয়াস জিন্স’ প্রোডাক্টটি বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল জিন্স পোশাক হিসেবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করে। আলেকজান্ডার ম্যাককুইন এবং স্টেলা ম্যাককার্টনিসহ বিশ্বের অনেক হাই-প্রোফাইল ডিজাইনার গুচিতে কাজ করেন। গুচির অনেকগুলি আইটেম বছরের পর বছর ধরে সংরক্ষণ করা হয়। প্রয়োজন বোধে সেগুলির উন্নয়ন করে নতুনভাবে ডিজাইন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ফ্লোরা স্কার্ফটি ক্রুজ সংগ্রহের জন্য ২০১৫ সালে পুনরায় নতুন করে বানানো হয়েছিল।

২০১৫ সালে ফ্যাশন ডিজাইনার আলেসান্দ্রো মিশেল ক্রিয়েটিভ দিকনির্দেশনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপর থেকে, বিক্রি ১২% বৃদ্ধি পায় এবং গুচি মিলান ফ্যাশন উইকের মতো বিশ্বমানের ইভেন্টগুলিতে আরও বেশি আধিপত্য বজায় রাখতে থাকে। গুচি ২০১৭ সালে লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে একটি ফ্যাশন শো’র আয়োজন করে, যা কোনো ব্রান্ড হিসেবে প্রথম।

বিশ্বের নামকরা সেলিব্রেটিরা গুচির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করছেন। সেলিব্রেটি ছাড়া গুচি’র নিয়মিত কাস্টমাররা রয়েছেন বিশ্বজুড়ে। গুচি পণ্যের দামের জন্য অনেকে এটি কিনতে সক্ষম না হলেও গুচি’র অনেক ক্রেতা রয়েছেন যারা খোঁজে থাকেন কবে গুচি নতুন কী রিলিজ করবে। গুচিতে ফ্যাশনের সাথে জড়িত সবকিছু পাওয়া গেলেও গুচিকে অনেকেই শুধু চেনে ব্যাগের জন্য। গুচি’র একেকটা ব্যাগের দাম শুরু এক লাখ টাকা থেকে। সেলিব্রেটিদের বিভিন্ন বিশেষ ইভেন্টে গুচি’র ব্যাগ বহন করতে দেখা যায়।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ব্র্যান্ড

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × 3 =