মাসুম আওয়াল
দেশের মিডিয়ার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র আফরান নিশো। ছোটপর্দার এক দাপুটে অভিনেতা তিনি। নানা মাত্রিক চরিত্রে অভিনয় করে প্রতিনিয়ত দর্শকের মন জয় করে চলেছেন। এরই মধ্যে চমক দেখিয়েছেন বড় পর্দাতেও। ডিসেম্বর মাসে জন্মেছিলেন এই গুণী অভিনেতা। রঙবেরঙের পক্ষ থেকে রইলো জন্মদিনের ফুলেল শুভেচ্ছা।
টাঙ্গাইলের ছেলে
ছোটপর্দার অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা আফরান নিশোর প্রকৃত নাম আহম্মেদ ফজলে রাব্বি (নিশো)। অভিনয় জগতে নাম লেখানোর পর তার নাম হয়ে যায় আফরান নিশো। প্রায় দুই যুগ ধরে টেলিফিল্ম, নাটক ও টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করেছেন তিনি। দর্শকদের হৃদয় জয় করা এই অভিনেতার জন্মদিন ৮ ডিসেম্বর। ১৯৮০ সালের এইদিনে টাঙ্গাইলে জন্ম নেন নিশো। ভূঞাপুরের শরণে তার বেড়ে ওঠা। কিশোর বয়সেই ঢাকা চলে আসেন। রাজধানীর ধানমন্ডি গভ. বয়েস হাই স্কুল থেকে এসএসসি এবং ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। এরপর ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করেন।
মডেলিং দিয়ে পথচলা শুরু
আফরান নিশো ১৯৯৯ সালের দিকে মডেল হিসেবে কাজ শুরু করেন। মডেলিং থেকে বিজ্ঞাপনচিত্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। অমিতাভ রেজার বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করার মাধ্যমে শুরু হয় তার অভিনয় যাত্রা এবং আফজাল হোসেনের প্রতিষ্ঠান ‘টকিজ’ স্ক্রিন টেস্ট দেওয়ার জন্য তাকে ডাকে। এরপর আরো কয়েকজন নির্মাতার সঙ্গে কাজ করেন তিনি। থাইল্যান্ডে গিয়ে একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে অংশ নেন। এরপরে গাজী শুভ্র, গোলাম হায়দার কিসলু, কিরন মেহেদী প্রমুখ খ্যাতনামাদের পরিচালনায় তিনি বিজ্ঞাপনে অংশ নেন। বাঁধন, আনিকা কবির শখ, নুসরাত ইমরোজ তিশা ও মেহজাবিন চৌধুরীসহ অনেক অভিনেত্রীদের সঙ্গে মডেলিং করেছেন।
শখের বসে অভিনয়ে
ভালোই চলছিল মডেলিং ও বিজ্ঞাপন। হঠাৎ করেই একরকম শখের বসে অভিনয়ে আসেন আফরান নিশো। ২০০৫ সালে গাজী রাকায়াতের পরিচালনায় ‘ঘরছাড়া’ নামের একটি ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে ছোটপর্দায় অভিনয় শুরু হয় তার। শুরুতেই কটাক্ষের শিকার হতে হয় তাকে। ভেঙে না পড়ে উল্টো জিদ চেপে বসে তার। কঠোর পরিশ্রম করে নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করেন অভিনয়ের জন্য। এক সাক্ষাৎকারে নিশো বলেছিলেন, ‘শুরুতে অভিনয় নিয়ে আমি অত বেশি সিরিয়াস ছিলাম না। বিরতি দিয়ে কাজ করতাম। অনেক পরে গিয়ে অভিনেতা হিসেবে সিরিয়াস হই। আশপাশের লোকের একটা কথা আমাকে বদলে দিয়েছে। আমি অভিনয়ে এলে কিছু মানুষ বলতে শুরু করলো, মডেলরা ভালো অভিনেতা হতে পারে না। ব্যস, এ কথায় জেদ চাপল মাথায়। মন দিয়ে কাজ করতে শুরু করলাম। এখনও ভালো অভিনেতা হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। কতটা অভিনেতা হতে পেরেছি তা আপনারাই বলতে পারবেন।’ ধীরে ধীরে ছোটপর্দার অন্যতম সেরা ও দারুণ জনপ্রিয় অভিনেতা হন নিশো। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে আছে অপেক্ষার ফটোগ্রাফি, আঁধার ও আলো, বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল, চলো না বৃষ্টিতে ভিজি, কায়াকর, লোটাকম্বল, বিয়ে পাগল প্রভৃতি।
স্বপ্নে পেলেন গুরুর দেখা
আফরান নিশোর পরিবারেও তেমন শিল্পের চর্চা ছিল না। ছিল না কোনো থিয়েটারের সঙ্গে সম্পর্কও। শৈশব, স্কুল বা কলেজজীবনে কখনো কোনো সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না তিনি। তবে নিশোর মনে গভীরভাবে শিল্পের প্রতি ভালোবাসা ছিল বলে তিনি মডেলিংয়ে এসেছেন, পরে নিজেকে যুক্ত করেছেন অভিনয়ে। কে নিশোর অনুপ্রেরণা? বহুবার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এ বিষয় নিয়ে বলেছেন নিশো। এই অভিনেতার কাছেই শোনা একটি গল্প এমন, একবার লোটাকম্বল নামে একটি নাটকের পাণ্ডুলিপি এসেছে নিশোর হাতে। সেই পাণ্ডুলিপিতে নিশোর চরিত্রের ভাষাটা অন্য রকম। এমন কোনো চরিত্রে আগে তার অভিনয় করা হয়নি। হাতে সময় খুব কম, এর মধ্যেই এই চরিত্রের জন্য তৈরি হতে হবে নিশোকে। কীভাবে নিজেকে তৈরি করবেন, কোন দিক থেকে শুরু করবেন, কোথা থেকে রেফারেন্স নেবেন; কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। অনেক রাত অবধি চিন্তাভাবনা করে নিশো ঘুমাতে গেলেন। স্বপ্নে এলেন হুমায়ুন ফরীদি। বেশি কিছু না, ফরীদি স্বপ্নে নাকি নিশোকে শুধু বলেছিলেন, ‘তুই পারবি। চেষ্টা কর।’ ব্যস, পরদিন গেলেন সেটে। গিয়ে দেখলেন, আগের রাত পর্যন্ত যে বিষয়টা অসম্ভব ঠেকছিল, সেটাই হয়ে গেছে ভীষণ সহজ। এভাবেই হুমায়ুন ফরীদি না থেকেও নিশোর গুরুর ভূমিকা পালন করেছেন। গুরু হুমায়ুন ফরীদির একটি বচনও তার জীবনে ভীষণ প্রভাব ফেলেছে, সেটা হলো, ‘কাজ একটাই করো, মন দিয়ে করো’।
হুমায়ূন ফরিদীর সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগও পেয়েছেন। সেই স্মৃতিচারণ করে আফরান নিশো বলেন, ‘অল্প সময়ের জন্য ফরীদি ভাইয়ের সঙ্গে কাজের সুযোগ পেয়েছিলাম। একদিন ফরীদির সামনেই একটা শট দিচ্ছিলাম। চিত্রগ্রাহক ফ্রেম ঠিক করার জন্য বারবার ডানে চাপতে বলছিলেন। বাধ্য শিল্পীর মতো চেপে যাচ্ছিলাম। কোনোরকমে সেখানে বসে শটটা দিতে শুরু করলাম। তখন হুমায়ুন ফরীদি ভাই দৃশ্যায়ন থামাতে বলেন। আমাকে তিনি বললেন, যেভাবে বসলে তোর স্বাচ্ছন্দ্য, সেভাবে বস। আমি বসলাম। দারুণ দৃশ্যধারণ হলো।’ ফরীদি ভাই আমাকে বললেন, ‘অভিনয়টাকে প্রাধান্য দিতে হবে। অভিনয়ের সঙ্গে কখনো আপস করা যাবে না। শিল্পী যদি অভিনয়ের চেয়ে ডানে চেপে বসার দিকে খেয়াল দেয়, তাহলে তো অভিনয়টা হবে না। এখনও মনে গেঁথে আছে সেসব কথা।’
চলচ্চিত্রে
দেড় বছর আগে ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমা দিয়ে বড়পর্দায় অভিষেক হয় আফরান নিশোর। এতে তার সঙ্গী ছিলেন তমা মির্জা। সিনেমাটি ব্যবসাসফল হয়। কিন্তু তারপরও দেড় বছর নতুন কোনো সিনেমার শুটিং শুরু করতে পারেননি এ অভিনেতা। অনেক জল্পনা-কল্পনা হচ্ছিল তাকে নিয়ে। মাঝে নতুন দুটি সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হওয়ার খবর দিলেও সেগুলোর ছিল না কোনো অগ্রগতি। তাই আফরান নিশোর ফেরা নিয়ে বেশ ধোঁয়াশা তৈরি হয়। অবশেষে শুটিং ফ্লোরে আফরান নিশোর দ্বিতীয় সিনেমা। দুই নায়িকা নিয়ে ‘দাগী’ সিনেমার শুটিং শুরু করেছেন নিশো। কথা ছিল আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েই সিনেমাটির শুটিং শুরু হবে। শোনা যাচ্ছে কিছু জটিলতার কারণে গোপনেই এর অ্যানাউন্সমেন্ট প্রমোর দৃশ্যধারণ শুরু হয়েছে। এটি পরিচালনা করছেন শিহাব শাহীন। এ সিনেমায় আফরান নিশোর নায়িকা তমা মির্জা থাকছেন এমন খবর আগেই জানা যায়। তবে তিনি ছাড়া আরও একজন নায়িকা রয়েছেন এতে। তিনি হলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘ন ডরাই’খ্যাত নায়িকা সুনেরাহ বিনতে কামাল। বর্তমানে এ নায়িকা নাটকের কাজ নিয়ে বেশ ব্যস্ত রয়েছেন। সব কিছু ঠিক থাকলে ‘দাগী’ সিনেমাটি ২০২৫ সালের ঈদুল ফিতরে মুক্তি পাবে।
মা-বাবার কথা
নিশোর বাবা আবদুল হামিদ মিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা। টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি ২০২০ মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমানে নিশোর মা, এক ভাই ও এক বোন রয়েছে। সব মিলিয়ে একেবারে সাদামাটা একটা পরিবারে বেড়ে উঠেছেন তিনি। নিশোর অভিনয়শিল্পী হওয়ার পেছনে তার মায়ের কাছে পাওয়া একটা শিক্ষা ভীষণ কাজে দিয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘মা ছোটবেলা থেকেই শিখিয়েছেন, যা-ই হতে চাও, সেরা হও। মা বলতেন, তুমি যদি মুচিও হও, তাহলে সেরা মুচি হও। ডাক্তার হলেও দেশের সেরা পাঁচ ডাক্তারের একজন হও।’
পরিবার
দীর্ঘ ১৪ বছর প্রেমের পর প্রেমিকাকে বিয়ে করেন আফরান নিশো। তারকাদের স্ত্রী, সংসার নিয়ে ভক্তদের ব্যাপক আগ্রহ থাকলেও নিশো হেঁটেছেন ভিন্ন পথে। নিজের ব্যক্তিগত জীবন সবসময় আড়ালে রাখার চেষ্টাই করেছেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘পেশাগত জীবনে এত সময় দেই যার কারণে সাংসারিক জীবনে খুব একটা সময় দিতে পারি না। সবসময়ই দেখা গেছে কাজের মধ্যে ডুবে থাকি। তবুও স্ত্রী হিসেবে সে এটা মেনে নিচ্ছে। কখনো খারাপ ব্যবহার করছে না। সে জায়গা থেকে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি।’ স্ত্রীর প্রশংসা করে অভিনেতা আরও বলেন, ‘সহধর্মিণী হিসেবে যেভাবে পাশে থাকার কথা, আমার স্ত্রী সবসময়ই সেভাবে পাশে ছিল। আমার কাজে সাহায্য করেছে।’ নিশোর একমাত্র ছেলের নাম নির্ভান। যার বয়স এখন দশ বছর। নিশো কখনোও চান না তার ব্যক্তিজীবনে খ্যাতির আলো পড়ুক। তাই ছেলে আর স্ত্রীকে নিজের ব্যক্তিজীবন আর কর্মজীবনকে আলাদা রাখতে চান সব সময়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি
২০০৩ সাল থেকে নিশো ৮০০টিরও অধিক টেলিভিশন নাটক, টেলিভিশন চলচ্চিত্র, ওয়েব ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন। জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কারও লাভ করেছেন। ‘যোগ বিয়োগ’ (২০১৬) ও ‘বুকের বাঁ পাশে’ (২০১৮) নাটকে অভিনয়ের জন্য ‘শ্রেষ্ঠ টিভি অভিনয়শিল্পী’ হিসেবে তিনি মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার পেয়েছেন।
শেষ কথা
আফরান নিশো তার ভক্ত ও দর্শকদের ভীষণ ভালোবাসেন। অনেক সময় দেখা যায় নিজের শুটিং বন্ধ রাখছেন ভক্তদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য। প্রায় জন্মদিনেই দেখা যায় খোস মেজাজে ভক্তদের সঙ্গে জন্মদিনের কেট কাটছেন আড্ডা দিচ্ছেন। তার আগামীর পথচলা আরও সুন্দর হোক।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: শুভেচ্ছা