রঙ বদলের দৌড় প্রতিযোগিতা

মাহবুব আলম

গিরগিটি ও অক্টোপাস দারুন ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারে। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বদলে ফেলতে পারে নিজেদের গায়ের রঙ। স্বভাবে পার্থক্য থাকলেও সরীসৃপ প্রাণী গিরগিটি ও পানির দানব অক্টোপাসের মধ্যে অদ্ভুত মিল আছে। এই দুই প্রাণী চোখের পলকে গাত্রবর্ণ পরিবর্তন করে পরিবেশের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে। আর বিপদের আঁচ পেলে মুহূর্তের মধ্যে সবুজ হলুদ লাল রঙে নিজেকে পাল্টে ফেলতে পারে। আবার এরা শিকার করার সময়ও রঙ বদলায়।

এই রঙ বদলানোর গিরগিটি ও অক্টোপাসকেও হার মানিয়ে দিয়েছে আমাদের দেশের এক শ্রেণির শিল্পী কবি সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। ৫ আগস্ট গণবিপ্লবের পর দেখা যাচ্ছে এদের রঙ বদলের দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।

এই বিষয়ে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার একটা বিবরণ তুলে ধরলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। ১৯ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবের বারান্দায় এক আড্ডায় হঠাৎ করে একজন নিজেকে নিরপেক্ষ দাবি করে বললেন, সাংবাদিকদের দল করা উচিত না। এই দেখেন আমি কোনো দল করি না, দিব্যি আছি। আমাকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে না। ভয়ে ভয়েও থাকতে হচ্ছে না। এটাই আমার শান্তি। তিনি আরো বলেন, দেখেন সামনের টেবিল একেবারে খালি। এবার যদি শিক্ষা হয়।

এই কথা শুনে একজন বললেন, তা ঠিক আছে কিন্তু আপনি হঠাৎ আমাদের এই টেবিলে? আপনি তো ওই টেবিলে বসেন। এই প্রশ্নে একটু আমতা আমতা করে ওই সাংবাদিক বলেন আমি আসলে সব টেবিলেই বসি। আপনাদের মতো আমার বসার কোনো নির্দিষ্ট টেবিল নেই। তাই মাঝেমধ্যে হেড টেবিলে বসি। কি করবো বলেন শফিক ভাই (শফিকুর রহমান, প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি, সদ্য ভাঙা সংসদের পলাতক এমপি) মুরুব্বি মানুষ ডাকলে তো না করা যায় না। শফিক ভাইয়ের জন্যই বসি। তবে আমি কখনোই শফিক ভাইয়ের সব কথার সঙ্গে একমত হই না। একমাত্র আমিই শফিক ভাইয়ের কথার প্রতিবাদ করি।

এবার এই শফিক ভাইয়ের প্রসঙ্গে একটু বলা দরকার। শফিক ভাই মাদরাসায় পড়া বীর মুক্তিযোদ্ধা দাবিদার কট্টর কমিউনিস্ট বিদ্বেষী, প্রগতিবিরোধী, রামভক্ত হনুমান। কথায় কথায় সবাইকে রাজাকার, বিএনপি-জামাত, জামাত-শিবির বলা তার এক ধরনের মুদ্রাদোষ। নামাজি মানুষ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। কিন্তু কোনদিন কারো সালাম নেন না। সালাম দেনও না। অবশ্য এটা প্রেসক্লাবের মধ্যকার ঘটনা। যাই হোক এই শফিক ভাই একদিন রাজাকার বলতে বলতে মওলানা ভাসানীকেও রাজাকার বলে মন্তব্য করেন। অবশ্য তিনি রাজাকার শব্দটি বলেননি, বলেছিলেন মওলানা ভাসানী কোলাবেরটর ছিলেন। তার এই বক্তব্যের সময় তার টেবিলে আট-দশ জন সাংবাদিক থাকলেও কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি একজন বাদে। কারণ তার টেবিলে কোনো প্রতিবাদ তিনি এলাও করতেন না। যাই হোক এই ঘটনার পর জানা গেল তিনি সরকারের খাতায় ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেও তিনি কখনোই কোনো দিন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় কয়েক বছর আগে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই বাছাই শুরু করলে চাঁদপুরের একাধিক কমান্ডার ও মুক্তিযোদ্ধারা স্পষ্ট করে মন্ত্রণালয়ে জানান শফিকুর রহমান নামের কেউ তাদের এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। এই ঘটনা যখন ঘটে তখন তিনি ওই এলাকার এমপি ছিলেন। যাইহোক, এই শফিকুর রহমানের টেবিলে নিয়মিত আড্ডায় একজন যখন বলেন তিনি নিরপেক্ষ, কোনো দল করেন না তখন তো প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ ওই টেবিলে বসার, আড্ডা দেওয়ার প্রধান যোগ্যতা ছিল কে কত বেশি খালেদা জিয়ার মুণ্ডুপাত করতে পারে। বিএনপি-জামাত আর বামপন্থীসহ অন্যান্যদের চরিত্র হনন করতে পারে। সেই সাথে ছাত্রলীগ যুবলীগ আওয়ামী লীগের কে কতটা পরীক্ষিত সৈনিক। এখানেই শেষ নয়, তাদের প্রতি বছর ১৫ই আগস্ট সহ বিভিন্ন দিবসে ৩২ নম্বর ও টুঙ্গীপাড়ায় মাজারে পুষ্পমাল্য অর্পণে উপস্থিত থেকে প্রমাণ করতে হতো কে কতটা অনুগত সৈনিক। সেই সৈনিকরাই এখন একে একে নিরপেক্ষ সাংবাদিক দাবি করে গাল-গল্প করছে নানাভাবে।

যাইহোক, একজন নিরপেক্ষ সাংবাদিক দাবি করে তার কথা শেষ করতেই ওই টেবিলের দিকে একজনকে এগিয়ে আসতে দেখে সবাই প্রায় একযোগে বলেন, ওই তো আর একজন নিরপেক্ষ সাংবাদিক আসছেন। এ কথা বলতে না বলতেই তিনি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে এদিক ওদিক তাকিয়ে বেশ জোরের সাথেই দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, অবশ্যই আমি নিরপেক্ষ সাংবাদিক। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সবাই একযোগে হো হো করে হেসে ওঠেন এবং বলেন অবশ্যই অবশ্যই। নির্মম হাস্যরসিকতা। কারণ ওই ব্যক্তি এর আগে এই টেবিলে বসতেন না। বলতেন, আপনাদের টেবিলে বসা যায় না। এখানে বিএনপি-জামাতের আড্ডা বসে। একে রঙ বদল না বলে আর কি বলা যায়?

এখানে বলা দরকার গিরগিটি শুধু রঙ পরিবর্তন করতে সক্ষম নয়, ওদের চোখও খুব তীক্ষè। ওদের চোখ ৩৬০ ডিগ্রি দেখতে পায়। ওদের চোখ দুটি অক্ষের থেকে কিছুটা বাইরের দিকে থাকে ফলে চারপাশ মাথা না ঘুরেই সবকিছু দেখতে পারে। আমাদের দেশেও এক শ্রেণির মানুষ আছে ওরা দ্রুত বিপদের গন্ধ পায়। তারা দ্রুত রঙ বদলায়। এটা শুধু এখানকার ঘটনা নয়, অতীতে এরশাদের পতন, বিএনপির ক্ষমতাচ্যুতি, ওয়ান ইলেভেন ও আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের সময়ও দেখা গেছে।

বিশ্বের ২০০ প্রজাতির গিরগিটির মধ্যে আমাদের দেশেই আছে ১০১ প্রজাতির গিরগিটি। এই বিষয়ে এখন রসিকজনরা বলেন ১০১ এর মধ্যে এখন যোগ করতে হবে আরো একটি প্রজাতি। এই প্রজাতির নাম মনুষ্য প্রজাতি। এখানে আরও একটি কথা বলার দরকার তাহলো গিরগিটির জিভ অনেক লম্বা হয়। এই জিভ বাইরে বের করে ওরা শিকার ধরে। কি অদ্ভুত মিল, এক শ্রেণির মানুষের সঙ্গে। যে শ্রেণির জিভ অনেক লম্বা। এদের লোভের কোনো শেষ নেই। জিভের স্বাদ নিতে ওরা এক ফাইভ স্টার হোটেল থেকে আরেক ফাইভ স্টার হোটেলে ঘুরে বেড়ায়। আর শিকারের জন্য হন্যে হয়ে থাকে। তবে একটা পার্থক্য আছে তা হলো Ñ গিরগিটি শুধু অভুক্ত অবস্থায় শিকারের সন্ধান করে। অন্যান্য জীবজন্তুর মতো পেট ভরা থাকলে কখনোই শিকারের বের হয় না। কিন্তু মনুষ্য প্রজাতির গিরগিটির কখনোই পেট ভরে না। ওদের একটা দুইটা নয় দশটা বাড়ি গাড়িতেও পেট ভরে না। ওদের চাহিদা সীমাহীন, লাখ নয় কোটি নয় শত শত কোটি টাকার চাহিদা।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: রম্য রচনা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

thirteen + 13 =