শফি বিক্রমপুরীর বিদায়

মৌ সন্ধ্যা

শফি বিক্রমপুরী ছিলেন বাংলাদেশের একজন আলোচিত ব্যক্তিত্ব। একইসঙ্গে তিনি ছিলেন রাজনীতিবিদ ও চলচ্চিত্রের মানুষ। তার প্রযোজিত অনেক সিনেমা হয়েছিল সুপারহিট। ঢালিউডের মানুষদের কাছে তিনি ছিলেন চোখের মণি। রাজনীতিবিদ হিসেবেও অসংখ্য মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ভীষণ প্রিয় একজন। সম্প্রতি সবাইকে ছেড়ে গুণী এই মানুষটি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। রঙবেরঙ তার প্রতি শোক ও শ্রদ্ধা জানাচ্ছে।

মুন্সিগঞ্জের সেই ছেলেটি

শফি বিক্রমপুরী ১৯৪৩ সালের ৪ জুলাই মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার মত্তগ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। এক বর্ণিল ছেলেবেলা কেটেছে তার।

পরিবেশক হয়ে পথচলা শুরু

শফি বিক্রমপুরীর চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার শুরু হয় একজন পরিবেশক হিসেবে। ১৯৬৪ সালে হলিউডের সিনেমা পরিবেশনার মধ্য দিয়ে পরিবেশনা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। ১৯৬৫ সালে ‘গুনাই বিবি’ সিনেমার একজন সহপ্রযোজক ছিলেন শফি বিক্রমপুরী। ১৯৭২ সালে সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ সিনেমাটির পরিবেশনা করেন তিনি।

প্রযোজক বিক্রমপুরী

প্রযোজক হিসেবেও সফল ছিলেন শফি বিক্রমপুরী। তার প্রযোজনায় নির্মিত ‘বাহাদুর’, ‘ডাকু মনসুর’ ও ‘রাজ দুলারী’ নির্মিত হয়। এ সিনেমাগুলো মুক্তির পর বাংলাদেশের সিনেমা ব্যবসায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

চলচ্চিত্র পরিচালক বিক্রমপুরী

১৯৭৮ সালে ‘রাজ দুলারী’ নির্মাণের মধ্য দিয়ে পরিচালক হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রেও সফল হন তিনি। এরপর শফি বিক্রমপুরী নির্মাণ করেন ‘সবুজ সাথী’, ‘দেনমোহর’, ‘সকাল সন্ধ্যা’, ‘মাটির কোলে’, ‘শশী পুন্নু’, ‘জজ সাহেব’। ১৯৮৯ সালে ঢাকার মালিবাগে ‘পদ্মা’ ও ‘সুরমা’ নামে দুটি সিনেমা হল নির্মাণ করেছিলেন তিনি, যা ওই সময়ে দর্শকে মুখর থাকত।

শফি বিক্রমপুরীর রাজনৈতিক জীবন

১৯৭৯ সালে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ২য় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি নির্বাচনী এলাকা ঢাকা ৫ (শ্রীনগর-লৌহজং) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচন শেষে জিয়াউর রহমানের আহ্বানে এবং সেসময়ের বিএনপির মহাসচিব এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সহযোগিতায় তিনি বিএনপিতে যোগদান করেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় পদে থেকে দায়িত্ব পালন করেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি ন্যায়-নীতিবান, দেশপ্রেমিক সর্বোপরি পরিচ্ছন্ন ও আদর্শবান রাজনীতিবিদ হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন।

শফির লেখালেখি ও সামাজিক কাজ

রাজনীতির পাশাপাশি শেষ জীবনে তিনি সমাজসেবা এবং গ্রন্থ লেখায় ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। তার লেখা অত্যন্ত আলোচিত গ্রন্থ ‘আমার দেখা ঢাকার পঁচাত্তর বছর’ (১৯৪৭-২০২২) চলতি বছর সূচিপত্র প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে। এছাড়া একজন সমাজ সেবক হিসেবে তিনি বিক্রমপুরে প্রতিষ্ঠা করেছেন নাসিমা শফি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেগম ফাতেমা আরশেদ আলী উচ্চ বিদ্যালয়, আল মদিনা জামে মসজিদ এবং নেত্রকোনায় পাঁচকাহনিয়া ফাতেমা আমীর আলী দারুল উলুম মাদ্রাসা এবং দশাল আশরাফুল উলুম হাফেজিয়া মাদ্রাসা।

শফি বিক্রমপুরীর মৃত্যু

বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন খ্যাতনামা চলচ্চিত্রকার ও রাজনীতিবিদ শফি বিক্রমপুরী। ২০২৩ সালের জুন মাসে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত ১ জুন শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর অবস্থার অবনতি হলে ২ জুন তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। সেই সময় বাবার রোগমুক্তির জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে তার ছেলে মো. হাফিজুর রহমান হাফিজ সবার কাছে দোয়াও চেয়েছিলেন। অবস্থার তেমন পরিবর্তন না হওয়ায় তাকে ব্যাংককে নেওয়া হয়েছিল চিকিৎসার জন্য। সুস্থ হয়ে আর দেশে ফেরা হলো না তার। ১৮ অক্টোবর ২০২৩ ব্যাংককের একটি হাসপাতালে ৮১ বছর বয়সে মারা যান শফি। রাজধানীর গুলশানে বসবাস করতেন তিনি। মুন্সীগঞ্জে ১৯ অক্টোবর জানাজার পর তার নিজের নির্মিত মসজিদের পাশে কবর দেয়া হয় তাকে।

শফি বিক্রমপুরীর জন্য শোক

শফি বিক্রমপুরী অনেক জনপ্রিয় শিল্পী ও কুশলীকে চলচ্চিত্রে কাজের সুযোগ করে দিয়েছেন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির পক্ষ থেকে মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়। অন্যদিকে শফি বিক্রমপুরীর মৃত্যুতে পৃথক শোকবার্তা দেন বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক।

একটি স্মৃতিকথা

শফি বিক্রমপুরীর অনেক কিছুই আমাদের অজানা। সম্প্রতি একটি অনলাইন গণমাধ্যমে ‘স্মৃতিতে শফি বিক্রমপুরী’ শিরোনামের একটি লেখা প্রকাশিত হয়। মো. জয়নাল আবেদীন লিখেছেন এটি। যেখানে শফি বিক্রমপুরীর জীবনের খণ্ডাংশ উঠে এসেছে।

জয়নাল আবেদীন লিখেছেন, “জিয়াউর রহমানের আমলে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে শ্রীনগর-লৌহজং আসনে নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে বদনা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন শফি বিক্রমপুরী। সেবারই আমি তার নাম জানি। বাড়ি শ্যামসিদ্ধির সেলামতী গ্রামে।

যদিও বাল্যকাল থেকেই তারা ঢাকায় থাকেন, তার লেখাপড়া বেড়ে ওঠা ঢাকায়। তার সাথে কবে কোথায় আমার পরিচয় হয় তা মনে নেই। তবে ১৯৮০ সালে বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাকালে তার সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের সাংগঠনিক সভায় তিনি নিয়মিত আসতেন। প্রথম ৩/৪ জন জীবন সদস্যদের মধ্যে তিনি একজন। আমাকে তিনি কেন যেন ভালো জানতেন।

বেগম জিয়ার শেষ আমলে যখন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের চাকরি যায় যায় অবস্থা তখন তিনি আমার জন্য হারিস চৌধুরীকে ধরেন যাতে বাধ্যতামূলক অবসরের তালিকায় আমার নাম অন্তর্ভুক্ত না হয়। কৃষি ব্যাংকের একটি গ্রুপ আওয়ামীপন্থীদের তালিকা করে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের হাতে দিয়ে আসতেন। ফরিদ, আজিজ আরশাদ, নূরুল ইসলাম খানকে বাধ্যতামূলক অবসরে দেওয়ার পেছনে কৃষি ব্যাংকের জিয়া পরিষদের গ্রুপটির ইন্ধন রয়েছে। আমি মরহুম শামসুল ইসলাম (মন্ত্রী) ও শফি বিক্রমপুরীর আন্তরিক চেষ্টায় রক্ষা পাই।

শফী বিক্রমপুরীর সাথে সর্বশেষ দেখা হয় গত ১৫ মে জাতীয় প্রেসক্লাবে তার লেখা আমার দেখা ঢাকা’র ’৭৫ বছর বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে। আমাকে তার বই সম্পর্কে মহিউদ্দীন খান মোহনের অনুরোধে কিছু বলতে হয় সে আয়োজনে। লেখক হিসেবে তিনি কিছু কথা বলেন। শরীর খুবই দুর্বল ছিল বিদায়কালে তিনি বলেন, ভাই আমার জন্য দোয়া করিও। সেটাই শেষ দেখা-শেষ কথা।

তিনি বিএনপি করলেও দলকানা ছিলেন না। সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলতেন। আমি আওয়ামীপন্থী জেনেও আমাকে ভালো জানতেন এ কারণেই। তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক-প্রযোজক ছিলেন। চলচ্চিত্র অঙ্গনে একাধিক শফী নামের ব্যক্তিত্ব থাকার কারণে এক সুহৃদের প্রস্তাবে তিনি মূল নামের সাথে বিক্রমপুরী সংযোজন করে শফি বিক্রমপুরী নাম ধারণ করেন। এতে আসল নাম শফীউর রহমান নামে তাকে অনেকে চিনতেন না।

শফি বিক্রমপুরী বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিবেশক সমিতির সভাপতি ছিলেন। পারিবারিক অন্যান্য ব্যবসাও করতেন। কূলিয়ার চরে বরফকল ও মাছ সংরক্ষণ হিমাগার ছিল ঢাকাসহ বিক্রমপুরে স্থাবর বহু সম্পত্তির মালিক হওয়ার পরেও তার মধ্যে কখনও অহংকার দেখিনি। বাবা-মা’র নামে নিজ গ্রামে উচ্চ বিদ্যালয়, আরধীপাড়ায় স্ত্রীর নামে প্রাথমিক বিদ্যালয় করেছেন। শ্রীনগর হরপাড়া-ছনবাড়ী সংলগ্ন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক সংলগ্ন খুবই মানসম্মত দৃষ্টিনন্দন মসজিদ ও মাদ্রাসা করেছেন।

শফি বিক্রমপুরীর স্ত্রী একজন মননশীল নারী। ছোট গল্প লিখেছেন অনেক। এক পুত্র এক কন্যার জনক শফি বিক্রমপুরী অগনিত আত্মীয় স্বজন ছাড়াও শত শত গুণগ্রাহী সুহৃদ রেখে গেছেন। তিনি দীর্ঘ সময় ঢাকাস্থ বিক্রমপুর সমিতির সভাপতি ছিলেন। তিনি প্রচার বিমুখ ছিলেন। নীরবে অনেক দান করতেন। প্রকৃত ভদ্র ও নিরীহ মানুষ ছিলেন শফি বিক্রমপুরী। তার মৃত্যুতে আমি আপনজন হারাবার শোক অনুভব করেছি। তার রুহের মাগফিরাত কামনা করি। পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন।”

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্মৃতিচারণ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two × 2 =