শেয়ারবাজারে ইতিহাসের ভয়াবহ তিন বিপর্যয়ের যতো কারণ

দেশের অর্থনীতির মূল দুটি ধারা মুদ্রা বাজার আর পুঁজি বাজার। একটি অপরটির সাথে সম্পর্কিত। একটিকে পিছনে ফেলে অপরটির উন্নয়ন সম্ভব নয়। পুঁজিবাজারের ইতিহাসে বিপর্যয়ের করুন রেকর্ড ৯৬ সালেরটা ছিলো ভয়াবাহ। তারপর সেটিকে ছাপিয়ে আরও বিপর্যয় হয় ২০১০ সালে, তারপর আর ঘিরে দাড়ানো দূরে থাক অতীতের চেয়েও করুন বিপর্যয়ে একেবারে শেষ এবার।

৯৬ সালে কেবলই কাগজের শেয়ার, নিয়ম-নীতির কোন বালাই নেই। সুযোগ সন্ধানী অনেকে তখন প্রেসে কাগজ ছাপিয়ে ভুয়া শেয়ার সেল করেছে। ৯৬ সালের আগে সাধারণ মানুষেরা পুঁজি বাজার সম্বন্ধে অতোটা জানতেন না ফলে তখনকার কারসাজি চক্র প্রতারিত করে মানুষের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একদম সহজ ভাবে।
৯৭ সনে প্রতিষ্ঠিত হল নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ও পুঁজি বাজারের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ।

২০১০ সালে বিভিন্ন ব্যাংক এবং নন ব্যাংকিং ইন্সটিটিউশনে আমানতের ১০ শতাংশ পুঁজি বাজারে বিনিয়োগ করা যেত। কিছু বিনিয়োগকারী অসৎ কর্মচারীর যোগসাজসে অনেক বেশী ঋণ নিয়ে মুনাফা অর্জন করে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক যখন পলিসি পরিবর্তন করে কোম্পানির পেইড আপ ক্যাপিটালের ২৫ শতাংশ এক্সপোজার লিমিট করে সমন্বয় করার জন্য ৬ মাস সময় বেঁধে দেয় এবং অনুসন্ধানী টিম গঠন করে বিভিন্ন তদন্ত বসায় তখন সমস্ত শেয়ার বিক্রি করে মার্কেট থেকে সটকে পড়ে। তা ছাড়া তখন ছিল পুঁজি প্রবাহের তুলনায় শেয়ারের অপ্রতুলতা।

সুযোগ সন্ধানী গোষ্ঠী সময়ের সৎ ব্যবহারে নিজেদের অর্থের পাহাড় গড়ে তুলে আর নিরীহ বিনিয়োগকারীরা হঠাৎ সঙ্কুচিত খারাপ মার্কেটে ঋণের চাপে পড়ে পুঁজি হারায়।

অতীতে এই দেশকে দেশের সহজ সরল মানুষদের বার বার লুণ্ঠন করেছে বর্গী, বেনিয়া, ইংরেজ শাসকেরা। কিন্তু স্বাধীন উত্তর দেশে দীর্ঘ ৪৮ বছর পরে পুঁজি বাজারে বর্তমানের শোষণ যেন ইতিহাসের সমস্ত রেকর্ড অতিক্রম করেছে। বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে পুঁজি বাজারে ২০২০ সালের ধসের মূল কারণ হচ্ছে নানা অনিয়ম।

১) মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভুয়া অডিট রিপোর্টের মাধ্যমে দুর্বল কোম্পানির শেয়ার পাবলিক লিস্টিং এর মাধ্যমে বাজারে আনা।

২) পেইড আপ ক্যাপিটাল অর্থাৎ কোম্পানি মূলধনকে প্লেসমেন্ট শেয়ার এবং মিথ্যা তথ্য দিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বড় করা।

৩) প্লেসমেন্ট শেয়ার বিতরণে অনিয়ম। নিয়ম বহির্ভূতভাবে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিতরণ। প্লেসমেন্টের মাধ্যমে যে টাকাগুলো বাজার থেকে বের হয়ে গেছে তা আর পুঁজিবাজারে ফিরে আসেনি।

৪) সেকেন্ডারি মার্কেটে বাণিজ্য শুরু হওয়ার পর পুনরায় মেনিপুলেট করে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করা।

৫) রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান আইসিবি যা পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা এবং দুঃসময়ে বাজারকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য সৃষ্টি, তা খারাপ শেয়ার মেনিপুলেট করার ক্ষেত্রে ডাম্পিং স্টেশন হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষায় বেশী মনোযোগী হয়ে লোকসানজনক অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া।

বাজার মূলধন গত ১ বছরে এক লক্ষ কোটি টাকা কমে গেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আজ অবধি কোন কোম্পানির স্পন্সর ডিরেক্টর, অডিটর, ইস্যু ম্যানেজার কাউকে আইনের আওতায় আনা হয়নি কিংবা দৃশ্যমান কোন তদন্ত হয়নি ফলে বিনিয়োগকারীদের মাঝে এক ধরনের আস্থাহীনতা এবং আতঙ্কগ্রস্থতা দেখা দিয়েছে।

উপরন্তু এই খারাপ বাজারে আরও দুর্বল কোম্পানি আনার সম্ভাবনার কথা শুনা যাচ্ছে।

দুর্বল মৌল ভিত্তির কোম্পানির মাধ্যমে যারা শেয়ার বাজারকে লুণ্ঠন করলো অসহায় বিনিয়োগকারীদের পথে বসাল তাদের বিচার না করে মার্কেট গতিশীল করা সম্ভব নয়।

এদেশে আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই। কোম্পানিগুলোতে সুশাসন নেই। ‘’জোর যার মুল্লুক তার’’ মতো করে একের পর এক দুর্বল কোম্পানির শেয়ার বাজারে এসে প্লেসমেন্ট শেয়ারের মাধ্যমে পেইড আপ ক্যাপিটাল বাড়িয়ে মেনিপুলেসনের মাধ্যমে বাজার থেকে ৬০/৭০ গুণ বেশি টাকা তুলে নিয়ে গেছে। যে টাকাগুলো আর বাজারে ফেরত আসেনি। অনেকগুলো কোম্পানির শেয়ার বর্তমানে অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে এসেছে। এভাবে চলতে চলতে এক সময় সৃষ্টি হয়েছে প্রচণ্ড তারল্য এবং আস্থার সংকট। কোম্পানিগুলোতে সুশাসন নেই তাই জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতাও নেই, কোন নিয়ম-নীতির বালাই নেই। প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি নিয়ে বাজারে আসলেও নিজেদের সমস্ত শেয়ার বিক্রি করার পর কেবলই লোকসানের হিসাব। পুরনো ভালো কোম্পানিগুলো আবার এই সুযোগে সমস্ত আয় খরচ দেখিয়ে বিনিয়োগকারীদের প্রাপ্য মুনাফা থেকে বঞ্চিত করছে।

কিছু নাম সর্বস্ব কোম্পানি আবার রাইট শেয়ার এবং ডিভিডেন্ড শেয়ারের মাধ্যমে মার্কেট থেকে আরও বেশি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।

ডিএসই এবং বিএসইসি-তে পর্যবেক্ষণ সফটওয়্যার আছে, সবকিছু তাদের নখ দর্পণে। কারসাজিকারকদের তথ্য প্রকাশ করুন। বিচারহীনতার সংস্কৃতি আর কতকাল?

বিনিয়োগকারীদের জিম্মি করে কারসাজির মাধ্যমে কারা এই বাজারকে লুটে নিল তাদের রিক্ত-নিঃস্ব,সর্বস্বান্ত করলো জাতি আজ জানতে চায়।

সমস্ত সরকারী নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা, বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশন, বিভিন্ন সংস্থা, সর্ব শেষ আশ্রয়স্থল মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের নিরন্তর চেষ্টা অব্যাহত রাখছে অসহায় মানুষ।

সর্বশেষ মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল, প্রত্যাশা এবং আস্থার জায়গা মানবতার বাতিঘর মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বিনিয়োগকারীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে, পুনরায় আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেছে। এই মুহূর্তে রক্ত শূন্য পুঁজি বাজারে তারল্য ইঞ্জেক্টের বিকল্প নেই। এখন কেবলই অপেক্ষার পালা, দেখা যাক নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান সবাই মিলে পুঁজিবাজার আর তাঁর অসহায় বিনিয়োগকারীদের রক্ষার জন্য কি সুফল বয়ে আনতে পারে।

সুউচ্চ ভবনে আগুন লাগলে মানুষ যেমন দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে ছোটছুটি করে, বাঁচার তাগিদে লাফিয়ে পড়ে আত্মহুতি দেয়, ঠিক একইভাবে পুঁজি বাজারের বিনিয়োগকারীরা অর্থনৈতিক নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে ৪০০০ ইনডেক্সে হাতে থাকা সমস্ত শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছিলেন ন্যূনতম মূলধনটুকু রক্ষার আশায়। আজ বিনিয়োগকারীরা কারসাজির সুষ্ঠু তদন্ত চায়, যারা তাঁদের সর্বস্বান্ত করে পথে বসিয়েছে সেই অসৎ মানুষদের বিচার চায়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

7 + eleven =