সবচেয়ে ছোট পাখি হামিংবার্ড

পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট পাখি হামিংবার্ড। এই পাখির বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে ট্রকিডি যা মেলিসুগা গণের অন্তর্গত এক প্রজাতির মৌপায়ী পাখি। গোলাম মোর্শেদ সীমান্তের প্রতিবেদনে পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট পাখিটাকে নিয়ে নানা অজানা তথ্য জানার চেষ্টা করবো এবারের আয়োজন।

কেন নাম তার হামিংবার্ড

হামিংবার্ড যখন উড়ে তখন এই খুদে পাখিরা ঘন ঘন নিজেদের ডানা ঝাপটায়। অনেকগুলো পাখি একসঙ্গে ডানা ঝাপটালে এক ধরনের তীব্র গুঞ্জন সৃষ্টি হয়। এজন্যই এদেরকে ‘হামিংবার্ড’ বলা হয়। ইংরেজিতে ‘হামিং’ শব্দের অর্থ গুনগুন। সেজন্য নামকরণ করা হয় এটি। হামিংবার্ড ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি গতিতে উড়তে পারে। সেকেন্ডে ৭০ বারের মতো ডানা ঝাপটাতে সক্ষম এই পাখিটি।

হাঁটতে পারে না হামিংবার্ড

হামিংবার্ড হাঁটতে পারে না। তাদের ছোট পা শুধুমাত্র বসার সময় পার্চিং এবং পাশে সরানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। তারা হাঁটতে বা লাফিয়ে উঠতে পারে না। তবে হামিংবার্ড একমাত্র পাখি যারা সামনে, পেছনে, ওপরে ও নিচে সবদিকেই পূর্ণগতিতে চলাচল করতে পারে। যা এককথায় বিস্ময়কর ব্যাপার। শীত সহ্য করতে পারে না বলে এদের কিছু প্রজাতি হাজার হাজার কিলোমিটার পথ উড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় গরমের দেশে। শীতপ্রধান দেশে তারা আবহাওয়া সহ্য করতে পারে না।

৩৩০ এর বেশি প্রজাতির হামিংবার্ড

হামিংবার্ড আকৃতিতে ছোট হলেও পৃথিবীতে ৩৩০ এর বেশি প্রজাতির হামিংবার্ড রয়েছে। যার মধ্যে ‘কিউবান বি’ প্রজাতির হামিংবার্ড সবচেয়ে ছোট। ‘কিউবান বি’ প্রজাতির হামিংবার্ড আকৃতিতে খুবই ছোট হলেও শরৎ এবং বসন্তকালীন পরিযাত্রার সময় এরা মেক্সিকো উপসাগর পাড়ি দেয়। এদের দৈর্ঘ্য মাত্র ২ ইঞ্চি অর্থাৎ একটা মৌমাছির সমান। এদের কেবল আমেরিকার ট্রপিক্যাল অঞ্চলে পাওয়া যায়। হামিংবার্ড মিনিটে ২৫০ বার শ্বাস নেয় এবং ওড়ার সময় তা আরও বেড়ে যায়। এদের হৃদস্পন্দনের হার মিনিটে ১২০০ বিটের বেশি। তুলনায়, একজন মানুষের গড় হৃদস্পন্দন বিশ্রামে প্রতি মিনিটে মাত্র ৬০ থেকে ১০০ বিট। একটি হামিংবার্ডের দেহে প্রায় ৯০০টি পালক থাকে যা বিশ্বের যেকোনো পাখির প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে কম সংখ্যক পালক। হামিংবার্ড যখন ইচ্ছা তখন তাদের রং ফ্ল্যাশ বা লুকিয়ে রাখতে পারে। একটি হামিংবার্ডের মস্তিষ্ক তার শরীরের ওজনের ৪.২% যা পাখির রাজ্যে সবচেয়ে বড়। তারা মানুষের চেয়ে আরও ভালো শুনতে এবং দেখতে পারে। তাদের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি রয়েছে।

মধুপায়ী পাখি

হামিংবার্ডের প্রধান খাদ্য ফুলের মধু। হাওয়ায় ভেসে থেকে ঠোঁট ঢুকিয়ে এরা মধু খায়। লম্বা সরু ঠোঁট ফুলের মধ্যে থেকে মধু খেতে সাহায্য করে। একটা হামিংবার্ড দিনে প্রায় ১৫০০ ফুল থেকে মধু আহরণ করে খায়। তবে মধু খাওয়ার সময় এরা ফুল থেকে যতটা সম্ভব নিজের দূরত্ব বজায় রাখে এবং শূন্যে ভাসমান অবস্থায় এরা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে। সাধারণত মধুপায়ী মনে করা হলেও ৮৫ শতাংশ হামিংবার্ডই ফুলের মধ্যে বাস করা ছোট ছোট পোকা খায়। হামিংবার্ডদের খাবার হজম করার ক্ষমতা অবিশ্বাস্য রকম। সারাদিন এরা নিজের শরীরের ওজনের সমান খাবার খেতে পারে। দিনে ৬-৮ বার খাবার খেয়ে থাকে পাখিটি।

মানুষ পোকা ভেবেছিল হামিংবার্ডকে

ইতিহাস থেকে জানা যায়, বিশ্ববিখ্যাত নাবিক কলম্বাস যখন জাহাজে চড়ে আমেরিকার উপকূলবর্তী দ্বীপে পৌঁছান তখন সেই নতুন দেশে ছোট্ট একধরনের পাখি দেখে অবাক হয়ে যান। ফুলের সামনে উড়ে বেড়ানো এ পাখিটিকে দেখে তার ভ্রমণ সঙ্গীরা অনেকেই অজানা পোকা ভেবে ভুল করেন। ফুলের সামনে উড়ে বেড়ানো এ পাখিটিকে দেখে তার সাথীরা অনেকেই অজানা পোকা ভেবে ভুল করেছিলেন। কিন্তু এটা আসলে ছিল হামিংবার্ড। পরে পাখিটি সকলের কাছে আস্তে আস্তে পরিচিতি লাভ করে।

হামিংবার্ডের রয়েছে তাপ বের করার জন্য জানালা

প্রতি সেকেন্ডে অন্তত সত্তর বার ডানা ঝাপটায় বিশ্বের দ্রুততম পাখি হামিংবার্ড। স্বাভাবিকভাবে এত দ্রুত গতির কারণে পাখিটির অতিমাত্রায় উত্তপ্ত হয়ে যাবার কথা। কিন্তু দেখা যায় সেটা হচ্ছে না। এটা কিভাবে সম্ভব হয়? একটি থার্মাল ক্যামেরায় ধারণ করা রঙ্গিন ভিডিও চিত্রের মাধ্যমেই আবিষ্কৃত হয়েছে হামিংবার্ডের অতিমাত্রায় উত্তপ্ত না হওয়ার কারণ। ছবিতে দেখা যায় পাখিটির উত্তাপ বের করে দেবার জন্য ‘জানালা’ রয়েছে। এসব জানালা রয়েছে তার চোখের পাশে, কাঁধের সংযোগস্থলে, পায়ে এবং পায়ের পাতায়। যুক্তরাষ্ট্রের অরিগনে জর্জ ফক্স ইউনিভার্সিটিতে এই সমীক্ষাটি চালানো হয়েছিল ২০১৫ সালে। গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছিল রয়্যাল সোসাইটি ওপেন সাইন্স নামক একটি জার্নালে।

হামিংবার্ডের মস্তিষ্কের ওজন

একটা হামিংবার্ডের শরীরের যা ওজন তার শতকরা ৪.২ শতাংশ হলো এদের মস্তিষ্ক। সাধারণত এত বড় মস্তিষ্কের অধিকারী অন্য কোনো পাখিকে দেখতে পাওয়া যায় না। এদের মস্তিষ্ক এতটাই পরিষ্কার যে এরা কোন কোন ফুল থেকে আগেই মধু খেয়ে গেছে সেটা দিব্যি মনে রাখতে পারে। এমনকি সেই ফুলে আবার কখন মধু আসবে, এরা তা-ও বলে দিতে পারে। এদের শ্রবণশক্তি এবং দৃষ্টিশক্তি মানুষের চেয়ে অনেক বেশি প্রখর হলেও ঘ্রাণশক্তি খুবই দুর্বল। যার ফলে অনেক সময়ই অনেক কিছুর ঘ্রাণ অনুভব করতে পারে না।

রকেটের আর হামিংবার্ডের উড়ে চলা প্রায় একই সূত্রে

আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম বিস্ময়কর আবিষ্কার রকেটের উড়ে চলা আর হামিং বার্ডের উড়ে চলা প্রায় একই সূত্রে গাঁথা। কারণ রকেট যেমন নিচ থেকে সোজা ওপরে ওঠার ক্ষমতা রাখে, ঠিক তেমনিভাবে হামিংবার্ডও তাদের স্পেসিফিক গ্রাভিটি বাড়িয়ে ভূমি থেকে সোজা ওপরের দিকে উঠতে পারে। আবার ওপর থেকে সোজা নিচের দিকে নামতে পারে। হামিংবার্ডের আরও দুইটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এরা অনেক দিন পর্যন্ত না খেয়ে থাকতে পারে। কোনো রকমের বিশ্রাম ছাড়াই একটানা উড়তে পারে প্রায় হাজার মাইল পর্যন্ত। একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, সেকেন্ডে সর্বনিম্ন ১২ থেকে সর্বোচ্চ ৯০ বার পর্যন্ত এরা ডানা ঝাপটাতে পারে। যেটা অন্য পাখিদের জন্য একেবারেই অসম্ভব।

ক্ষুদ্রতম ও বৃহত্তর হামিংবার্ড

হামিংবার্ড প্রজাতিরই সব থেকে বড় পাখিকে বলা হয় জায়ান্ট (দৈত্যাকার) হামিংবার্ড, যারা লম্বায় ৮.৫ সেমি থেকে ১৩ সেমি পর্যন্ত হয় এবং ওজনে সর্বোচ্চ ১৮-২৪ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। তাদের এই ওজনের শতকরা ৩০ শতাংশই হলো পেশি; যা এদেরকে উড্ডয়নের কাজে সাহায্য করে থাকে। ক্ষুদ্রতম হামিংবার্ড প্রজাতি হল মৌমাছি হামিংবার্ড। যার দৈর্ঘ্য ৫ সেমি (২ ইঞ্চি) আর ওজন ২ গ্রাম-এর কম।

হামিংবার্ডের আয়ু

হামিংবার্ডের গড় আয়ু ৩-৫ বছর হলেও, কিছু কিছু হামিংবার্ড এক বছরের মধ্যেই মারা যায়। আবার অনেক হামিংবার্ড একটানা ৮-১০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। মোটাদাগে বলা যায় একটি হামিংবার্ডের গড় আয়ু প্রায় ৪ বছর। একটি মহিলা হামিংবার্ড ১২ বছরের বেশি বেঁচে ছিল।

হামিংবার্ড শরীরের ওজন দ্বিগুণ করতে পারে

হামিংবার্ডরা প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৩ বার তাদের জিভ ভিতরে এবং বাইরে নাড়িয়ে ফিডারে পাওয়া অমৃত পান করে। তারা একদিনে তাদের শরীরের ওজন দ্বিগুণ করতে পারে। মূলত সারা শরীরের ওজন বাড়িয়ে ফেলতে সক্ষম প্রাণীটি।

সবচেয়ে ছোট ডিম পাড়ে হামিংবার্ড

হামিংবার্ড সব পাখির মধ্যে সবচেয়ে ছোট ডিম পাড়ে। তাদের ডিমগুলি ১/২ ইঞ্চিরও কম লম্বা হয় তবে ডিম পাড়ার সময় মায়ের ওজনের ১০ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। একটি হামিংবার্ড ডিম একটি জেলি বিন-এর থেকেও ছোট হয়। আধা গ্রাম হয় প্রতিটি ডিমের ওজন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: জানা অজানা 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

sixteen − 14 =